প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক ছিলেন। তবে কবিতাতেই আল মাহমুদ জ্বলে উঠেছিলেন বারুদের মতো। কবি আল মাহমুদের নির্বাচিত ১০টি কবিতায় চোখ রাখা যাক।
–
একুশের কবিতা
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায় ?
বরকতের রক্ত।
হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে !
প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে
ছড়াও ফুলের বন্যা
বিষাদগীতি গাইছে পথে
তিতুমীরের কন্যা।
চিনতে না কি সোনার ছেলে
ক্ষুদিরামকে চিনতে ?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে
মুক্ত বাতাস কিনতে ?
পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায়
ঝাঁপ দিল যে অগ্নি,
ফেব্রুয়ারির শোকের বসন
পরলো তারই ভগ্নী।
প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, আমি
জন্মেছি এই বঙ্গে।
–
নোলক
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?
-হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে
শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে।
জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক
সবুজ বনের হরিণ টিয়ে করে রে ঝিকমিক।
বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই,
আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে যেতে চাই।
কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন
আমরা তো সব পাখপাখালি বনের সাধারণ।
সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি নাতো!
ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও, হাত পাতো হাত পাতো
বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক
হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ।
এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা
আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।
–
পাখির মতো
আম্মা বলেন, পড়রে সোনা
আব্বা বলেন, মন দে;
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
আমার কেবল ইচ্ছে জাগে
নদীর কাছে থাকতে,
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মতো ডাকতে।
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলীর কূলটায়,
দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি
ফেরেস্তারা উল্টায়।
তখন কেবল ভাবতে থাকি
কেমন করে উড়বো,
কেমন করে শহর ছেড়ে
সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো!
তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি না হয় পাখিই হবো,
পাখির মতো বন্য।
–
সোনালি কাবিন-০১
সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি,
আত্নবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারিদিকে চতুর ভুক্রুটি;
ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন,
ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি;
দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন?
আমার তো নেই সখি, যেই পণ্যে অলংকার কিনি।
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না;
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা
পরাজিত নয় নারী, পরাজিত হয় না কবিরা;
দারুন আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।
–
সোনালি কাবিন-০২
হাত বেয়ে উঠে এসো হে পানোখী, পাটিতে আমার
এবার গোটাও ফণা কালো লেখা লিখো না হৃদয়ে;
প্রবল ছোবলে তুমি যতটুকু ঢালো অন্ধকার
তার চেয়েও নীল আমি অহরহ দংশনের ভয়ে।
এ কোন্ কলার ছলে ধরে আছো নীলাম্বর শাড়ি
দরবিগলিত হয়ে ছলকে যায় রাত্রির বরণ,
মনে হয় ডাক দিলে সে -তিমিরে ঝাপ দিতে পারি
আচল বিছিয়ে যদি তুলে নাও আমার মরণ।
বুকের ওপরে মৃদু কম্পমান নখবিলেখনে
লিখতে কি দেবে নাম অনুজ্জ্বল উপাধিবিহীন?
শরমিন্দা হলে তুমি ক্ষান্তিহীন সজল চুম্বনে
মুছে দেবো অদ্যাক্ষর রক্তবর্ণ অনার্য প্রচীন।
বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত করো কলাবতী
জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী।
–
সোনালি কাবিন-০৩
ঘুরিয়ে গলার বাঁক ওঠো বুনো হংসিনী আমার
পালক উদাম করে দাও উষ্ণ অঙ্গের আরাম
নিসর্গ নমিত করে যায় দিন, পুলকের দ্বার
মুক্ত করে দিবে এই শব্দবিদে কোবিদের নাম।
কক্কার শব্দের শর আরণ্যক আত্নার আদেশ
আঠারোটি ডাক দেয় কান পেতে শোনো অষ্টাদশী,
আঙুলে লুলিত করো বন্ধবেণী, সাপিনী বিশেষ
সুনীল চাদরে এসো দুই তৃষ্ণা নগ্ন হয়ে বসি।
ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দু’টি জলের আওয়াজ–
তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়,
চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাজ
উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়,
ঠোঁটের এ লাক্ষারসে সিক্ত করে নর্ম কারুকাজ
দ্রুত ডুবে যাই এসো ঘূর্ণ্যমান রক্তের ধাঁরায়।
–
সোনালি কাবিন-০৪
এ তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলো সুন্দরী
মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গায়,
ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি
কত অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়।
কবির কামনা হয়ে আসবে কি, হে বন্য বালিকা
অভাবে অজগর জেনো তবে আমার টোটেম
সতেজ খুনের মতো এঁকে দেবো হিঙ্গুলের টিকা
তোমার কপালে লাল, আর দীন-দরিদ্রের প্রেম।
সে-কোন গোত্রের মন্ত্রে বলো বধূ তোমাকে বরণ
করে এই ঘরে তুলি? আমার তো কপিলে বিশ্বাস,
প্রেম কবে নিয়েছিলো ধর্ম কিংবা সংঘের স্মরণ?
মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস।
যতক্ষণ ধরো এই তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়ন
তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস।
–
জেলগেটে দেখা
সেলের তালা খোলা মাত্রই এক টুকরো রোদ এসে পড়লো ঘরের মধ্যে
আজ তুমি আসবে। সারা ঘরে আনন্দের শিহরণ খেলছে। যদিও উত্তরের বাতাস
হাড়েঁ কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে বইছে, তবু আমি ঠান্ডা পানিতে
হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। পাহারাদার সেন্ট্রিকে ডেকে বললাম,
আজ তুমি আসবে। সেন্ট্রি হাসতে হাসতে আমার সিগ্রেটে
আগুন ধরিয়ে দিল। বলল, বারান্দায় হেটেঁ ভুক বাড়িয়ে নিন
দেখবেন, বাড়ী থেকে মজাদার খাবার আসবে।
দেখো, সবাই প্রথমে খাবারের কথা ভাবে।
আমি জানি বাইরে এখন আকাল চলছে। ক্ষুধার্ত মানুষ
হন্যে হয়ে শহরের দিকে ছুটে আসছে। সংবাদপত্রগুলোও
না বলে পারছে না যে এ অকল্পনীয়।
রাস্তায় রাস্তায় অনাহারী শিশুদের মৃতদেহের ছবি দেখে
আমি কতদিন আমার কারাকক্ষের লোহার জালি
চেপে ধরেছি।
হায় স্বাধীনতা, অভুক্তদের রাজত্ব কায়েম করতেই কি আমরা
সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলাম।
আর আমাকে ওরা রেখেছে বন্দুক আর বিচারালয়ের মাঝামাঝি
যেখানে মানুষের আত্মা শুকিয়ে যায়। যাতে
আমি আমরা উৎস খুঁজে না পাই।
কিন্তু তুমি তো জানো কবিদের উৎস কি? আমি পাষাণ কারার
চৌহদ্দিতে আমার ফোয়ারাকে ফিরিয়ে আনি।
শত দুর্দৈবের মধ্যেও আমরা যেমন আমাদের উৎসকে
জাগিয়ে রাখতাম।
চড়ুই পাখির চিৎকারে বন্দীদের ঘুম ভাঙছে।
আমি বারান্দা ছেড়ে বাগানে নামলাম।
এক চিলতে বাগান
ভেজা পাতার পানিতে আমার চটি আর পাজামা ভিজিয়ে
চন্দ্রমল্লিকার ঝোপ থেকে একগোছা শাদা আর হলুদ ফুল তুললাম।
বাতাসে মাথা নাড়িয়ে লাল ডালিয়া গাছ আমাকে ডাকলো।
তারপর গেলাম গোলাপের কাছে।
জেলখানার গোলাপ, তবু কি সুন্দর গন্ধ!
আমার সহবন্দীরা কেউ ফুল ছিড়েঁ না, ছিঁড়তেও দেয় না
কিন্তু আমি তোমার জন্য তোড়া বাঁধলাম।
আজ আর সময় কাটতে চায়না। দাড়ি কাটলাম। বই নিয়ে
নাড়াচাড়া করলাম। ওদিকে দেয়ালের ওপাশে শহর জেগে উঠছে।
গাড়ীর ভেঁপু রিক্সার ঘন্টাধ্বনি কানে আসছে।
চকের হোটেলগুলোতে নিশ্চয়ই এখন মাংসের কড়াই ফুটছে।
আর মজাদার ঝোল ঢেলে দেওয়া হচ্ছে
গরীব খদ্দেরদের পাতে পাতে।
না বাইরে এখন আকাল। মানুষ কি খেতে পায়?
দিনমজুরদের পাত কি এখন আর নেহারির ঝোলে ভরে ওঠে?
অথচ একটা অতিকায় দেয়াল কত ব্যবধানই না আনতে পারে।
আ , পাখিরা কত স্বাধীন। কেমন অবলীলায় দেয়াল পেরিয়ে যাচ্ছে
জীবনে এই প্রথম আমি চড়ুই পাখির সৌভাগ্যে কাতর হলাম।
আমাদের শহর নিশ্চয়ই এখন ভিখিরিতে ভরে গেছে।
সারাদিন ভিক্ষুকের স্রোত সামাল দিতে হয়।
আমি কতবার তোমাকে বলেছি, দেখো
মুষ্টি ভিক্ষায় দারিদ্র্য দূর হয় না।
এর অন্য ব্যবস্হা দরকার, দরকার সামাজিক ন্যায়ের।
দুঃখের শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে।
আ , যদি আমার কথা বুঝতে।
প্রিয়তমা আমার,
তোমার পবিত্র নাম নিয়ে আজ সূর্য উদিত হয়েছে। আর
উষ্ণ অধীর রশ্মির ফলা গারদের শিকের ওপর পিছলে যাচ্ছে।
দেয়ালের ওপাশ থেকে ঘুমভাঙ্গা মানুষের কোলাহল।
যারা অধিক রাতে ঘুমোয় আর জাগে সকলের আগে।
যারা ঠেলে।
চালায়।
হানে।
ঘোরায়।
ওড়ায়।
পেড়ায়।
আর হাত মুঠো করে এগিয়ে যায়।
সভ্যতার তলদেশে যাদের ঘামের অমোঘ নদী।
কোনদিন শুকোয় না। শোনো, তাদের কলরব।
বন্দীরা জেগে উঠছে। পাশের সেলে কাশির শব্দ
আমি ঘরে ঘরে তোমার না ঘোষণা করলাম
বললাম, আজ বারোটায় আমার দেখা।
খুশীতে সকলেই বিছানায় উঠে বসলো।
সকলেরই আশা তুমি কোন না কোন সংবাদ নিয়ে আসবে।
যেন তুমি সংবাদপত্র! যেন তুমি
আজ সকালের কাড়জের প্রধান শিরোনামশিরা!
সূর্য যখন অদৃশ্য রশ্মিমালায় আমাকে দোলাতে দোলাতে
মাঝ আকাশে টেনে আনলো
ঠিক তখুনি তুমি এলে।
জেলগেটে পৌছেঁ দেখলাম, তুমি টিফিন কেরিয়ার সামনে নিয়ে
চুপচাপ বসে আছো।
হাসলে, ম্লান, সচ্ছল।
কোনো কুশল প্রশ্ন হলো না।
সাক্ষাৎকারের চেয়ারে বসা মাত্রই তুমি খাবার দিতে শুরু করলে।
মাছের কিমার একটা বল গড়িয়ে দিয়ে জানালে,
আবরা ধরপাকড় শুরু হয়েছে।
আমি মাথা নাড়লাম।
মাগুর মাছের ঝোল ছড়িয়ে দিতে দিতে কানের কাছে মুখ আনলে,
অমুক বিপ্লবী আর নেই
আমি মাথা নামালাম। বললে, ভেবোনা,
আমরা সইতে পারবো। আল্লাহ, আমাদের শক্তি দিন।
তারপর আমরা পরস্পরকে দেখতে লাগলাম।
যতক্ষণ না পাহারাদারদের বুটের শব্দ এসে আমাদের মাঝখানে থামলো।
–
আমি আর আসবো না বলে
আর আসবো না বলে দুধের ওপরে ভাসা সর
চামোচে নিংড়ে নিয়ে চেয়ে আছি। বাইরে বৃষ্টির ধোঁয়া
যেন সাদা স্বপ্নের চাদর
বিছিয়েছে পৃথিবীতে।
কেন এতো বুক দোলে? আমি আর আসবো না বলে?
যদিও কাঁপছে হাত তবু ঠিক অভ্যেসের বশে
লিখছি অসংখ্য নাম চেনাজানা
সমস্ত কিছুর।
প্রতিটি নামের শেষে, আসবো না।
পাখি, আমি আসবো না।
নদী আমি আসবো না।
নারী, আর আসবো না, বোন।
আর আসবো না বলে মিছিলের প্রথম পতাকা
তুলে নিই হাতে।
আর আসবো না বলে
সংগঠিত করে তুলি মানুষের ভিতরে মানুষ।
কথার ভেতরে কথা গেঁথে দেওয়া, কেন?
আসবো না বলেই।
বুকের মধ্যে বুক ধরে রাখা, কেন?
আর আসবো না বলেই।
আজ অতৃপ্তির পাশে বিদায়ের বিষণ্ণ রুমালে
কে তুলে অক্ষর কালো, ‘আসবো না’
সুখ, আমি আসবো না।
দুঃখ, আমি আসবো না।
প্রেম, হে কাম, হে কবিতা আমার
তোমরা কি মাইল পোস্ট না ফেরার পথের ওপর?
–
একা
তোমার কাছে যাব বলে পথে নেমে
হঠাৎ দেখি সারা শরীর উঠল ঘেমে ।
ঘাম ঝরছে, নাম ঝরছে পোশাক বেয়ে
এমন সময় সাঁঝের পাখি উঠল গেয়ে ।
কী নাম যেন ওই পাখিটার, সাঁঝের কোকিল ?
ডাকছে একা বুকের ভেতর, স্তব্ধ নিখিল ।
পথের বাঁকে পাব কাকে কে আর আছে
আমায় দেখে সন্ধ্যাকালীন মৃত্যু নাচে ।
হায় রে মরণ, কী অকারণে নাচছ তুমি ?
কাঁপছে সবই, পায়ের নিচে মাতৃভূমি ।
কারা যেন ছায়ার মতন আছে কাছেই
ছড়িয়ে আছে ঘাসের ওপর গাছে গাছেই ।
আমি তো সেই পথের মানুষ পথেই আছি
হাত বাড়ালেই পাবে বুকের কাছাকাছি ।
কেবল তোমার মুখের মায়া ডাক দিয়েছে
হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি মরণ হাঁক দিয়েছে ।
এবার নামুক নিগূঢ় আঁধার আমায় ঢেকে
সব চলে যাক আলোর সাথে- আমায় রেখে।