পবিত্র কোরআন মানবজাতির প্রতি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ দান। মানবজাতির পথপ্রদর্শনের জন্য তিনি কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। যেন মানুষ আল্লাহর কোরআন পাঠ করে সত্যের দিশা পায় এবং তাঁর নৈকট্য লাভ করতে পারে। বর্তমানে বহু মানুষ কোরআনকে খ্যাতি ও অর্থ উপার্জনের মাধ্যম বানাচ্ছে।
কোরআন সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান না থাকার পরও তারা কেবল জাগতিক উদ্দেশ্যে কোরআনের অনুলিপি তৈরি করছে। এ ক্ষেত্রে শরিয়তের বিধি-বিধান ও আরবি ভাষার বিধিবদ্ধ নিয়মের তোয়াক্কা পর্যন্ত করছে না, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
অনুলিপি তৈরির বিধান
কোরআনের অনুলিপি তথা মুসহাফ তৈরি করা বৈধ এবং শরিয়তের দৃষ্টিতে মর্যাদার বিষয়। কেননা নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-কে কোরআন লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। সাহাবিদের মধ্যে যারা ওহি লিপিবদ্ধ করত তাদের বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখা হতো।
জায়েদ বিন সাবিত (রা.) বলেন, আবু বকর (রা.) আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, তুমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে ওহি লিপিবদ্ধ করতে। সুতরাং তুমি কোরআনের আয়াতগুলো খোঁজ কোরো। এরপর আমি খোঁজ করলাম। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৯৮৯)
পরবর্তী যুগে সাহাবিরাও কোরআনের অনুলিপি তৈরি করেছিলেন। যেমন আনাস বিন মালিক (রা.)-এর দীর্ঘ হাদিসে এসেছে, ‘যখন মূল লিপিগুলো থেকে কয়েকটি পরিপূর্ণ অনুলিপি তৈরি হয়ে গেল, তখন উসমান (রা.) মূল লিপিগুলো হাফসা (রা.)-এর কাছে ফিরিয়ে দিলেন। তারপর তিনি কোরআনের লিখিত মাসহাফগুলোর একেকটি একেক প্রদেশে পাঠিয়ে দিলেন। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৯৮৭)
লিপিকারের মর্যাদা
কোরআনের অনুলিপি তৈরি করা শুধু বৈধ নয়; বরং তা সওয়াবের কাজ। ড. সালিহ বিন মুহাম্মদ আর-রাশিদ বলেন, ‘আলেমরা এ বিষয়ে একমত যে কোরআনের অনুলিপি তৈরি করা ও সুন্দরভাবে তা সম্পন্ন করা মুস্তাহাব; বরং একাধিক আলেম বলেছেন, কোরআনের অনুলিপি তৈরি করা বড় সওয়াবের কাজ। ’ (আল-মুতহাফ ফি আহকামিল মুসহাফ, পৃষ্ঠা ৬৭১)
সর্বোচ্চ সতর্কতা আবশ্যক
কোরআনের অনুলিপি তৈরিতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেন তাতে কোনো ভুল থেকে না যায়; ঠিক যেমনটি মহানবী (সা.) করতেন। জায়েদ বিন সাবিত (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে ওহি লিপিবদ্ধ করতাম। লিখে শেষ করার পর তিনি বলতেন, পড়ো! আমি তা পড়তাম। তাতে কোনো বিচ্যুতি হলে তিনি সংশোধন করে দিতেন। অতঃপর আমি তা মানুষের সামনে প্রকাশ করতাম। ’ (আল-মুজামুল কাবির : ৫/১৪২)
লিপিকারের গুরু দায়িত্ব
কোরআনের অনুলিপি তৈরি করা কোনো সাধারণ কাজ নয়। এটা অত্যন্ত গুরু দায়িত্ব। যে ব্যক্তি কোরআনের অনুলিপি তৈরি করতে চায়, তার জন্য এই দায়িত্বের ভার অনুধাবন করা আবশ্যক। যেমন জায়েদ বিন সাবিত (রা.) অনুধাবন করেছিলেন।
তিনি বলেন, আবু বকর সিদ্দিক (রা.) আমাকে বললেন, তুমি একজন বুদ্ধিমান যুবক। তোমার ব্যাপারে আমার কোনো সংশয় নেই। তদুপরি তুমি রাসুল (সা.)-এর যুগে ওহির লেখক ছিলে। সুতরাং তুমি কোরআন অংশগুলো তালাশ করে একত্র কোরো। আল্লাহর শপথ! তারা যদি আমাকে একটি পর্বত এক স্থান হতে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিত, তবে তা আমার কাছে কোরআন সংকলনের নির্দেশের চেয়ে কঠিন বলে মনে হতো না। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৯৮৬)
অনুলিপি তৈরির শর্ত
উল্লিখিত হাদিস (বুখারির ৪৯৮৬ নং) দ্বারা প্রমাণিত হয়, কেবল যোগ্য ব্যক্তিরাই কোরআনের অনুলিপি তৈরি করতে পারবে এবং তা ব্যক্তিগত উদ্যোগের পরিবর্তে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। বিশেষজ্ঞ আলেমরা বলেন, কোরআনের অনুলিপি তৈরির জন্য ব্যক্তিকে নিম্নোক্ত বিষয়ের জ্ঞান লাভ করতে হবে। তা হলো—
ইতিহাস
ব্যক্তি কোরআন লিপিবদ্ধ করার ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হবে। বিশেষত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ থেকে উসমান (রা.)-এর যুগ পর্যন্ত কিভাবে কোরআন লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল, কোরআন সংকলনের ক্ষেত্রে সাহাবিরা কোন কোন মূলনীতি অনুসরণ করেছিলেন এবং নবীজি (সা.) ও সাহাবিদের যুগে কোন পদ্ধতিতে কোরআনের অনুলিপি তৈরি করা হতো তা জানা আবশ্যক।
আরবি ভাষার লিখন পদ্ধতি
আরবি ভাষা লেখার যে পদ্ধতি আছে তা রপ্ত করা। যেমন আরবি বর্ণগুলো মুক্ত ও যুক্ত অবস্থায় কিভাবে লেখা হয়। হরকত, সাকিন, তাশদিদ, তানভিন ও হামজা ব্যবহারের নিয়ম কী ইত্যাদি।
আরবি ভাষার পঠন পদ্ধতি
আরবি ভাষার কোন বর্ণের উচ্চারণ কেমন হয় এবং অন্য বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হলে তার উচ্চারণে কী পরিবর্তন আসে তা জানা আবশ্যক। কেননা বর্ণের উচ্চারণের ওপর নির্ভর করে তা লেখার নিয়ম পাল্টে যায়।
আরবি শব্দভাণ্ডার
যে কোরআনের অনুলিপি তৈরি করবে, তার জন্য আরবি শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে জানাও আবশ্যক। যেন উচ্চারণে কাছাকাছি শব্দগুলো লেখার ক্ষেত্রে তার ভুল না হয়। (আল-মুয়াসসার ফি ইলমি রাসমিল মুসহাফ ও জাবতিহি, পৃষ্ঠা ২৮৬-৩০৬)
রসমে উসমানি
ইসলামী আইনজ্ঞরা এ বিষয়ে একমত যে কোরআনের অনুলিপি ‘রসমে উসমানি’ অনুসারে হওয়া আবশ্যক। তাই কেউ কোরআনের অনুলিপি তৈরি করতে চাইলে তাকে অবশ্যই ‘রসমে উসমানি’ জানতে হবে।
রসমে উসমানি কী?
রসমে উসমানি হলো কোরআনের বিধিবদ্ধ লিখন পদ্ধতি। সাহাবিরা এই পদ্ধতিতে কোরআনের অনুলিপি করার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন। ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান ইবনে আফফান (রা.)-এর যুগে তাদের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে এটাকে রসমে উসমানি বলা হয়। আবার কোরআনের বিধিবদ্ধ নিয়ম হওয়ায় তাকে ‘রসমে কোরআনি’-ও বলা হয়। (বিস্তারিত দেখুন : আল-মুতহাফ ফি আহকামিল মুসহাফ, পৃষ্ঠা ৫২২)
রসমে উসমানির গুরুত্ব
বেশির ভাগ আলেম এ বিষয়ে একমত যে উসমান (রা.)-এর যুগে কোরআনের যে অনুলিপির (রসমে উসমানি) ব্যাপারে সাহাবিরা একমত হয়েছিলেন, পরবর্তীদের জন্য তা অনুসরণ করা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে কোনো শব্দ-বাক্য তো দূরের কথা, কোনো বর্ণেরও পার্থক্য করা যাবে না। ইমাম মালেক (রহ.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, মানুষ যেসব বর্ণ উদ্ভাবন করেছে তা কি কোরআনে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে? তিনি বলেন, না। এটি প্রথম পদ্ধতি (রসমে উসমানি) অনুসারে লিখতে হবে। (আল-মুকান্নাআ : ৯/১০)
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) বলেন, ‘ওয়াউ, ইয়া, আলিফি অথবা অন্য কোনো বর্ণের ক্ষেত্রে মুসহাফে উসমানির লিখন পদ্ধতির বিপরীত করা হারাম। ’ (আল-বুরহান : ১/৩৭৯)
কতটা অনুসরণ আবশ্যক
কোরআন গবেষক আলেমরা বলেন, কোরআনের অনুলিপি তৈরির ক্ষেত্রে রসমে উসমানি বা মুসহাফের উসমানির অসুরণ করতে হবে প্রতিটি বর্ণে ও হরকতে। যেমন আরবি ‘সালাত’ দুই ভাবে লেখা যায়।
ক. আরবি শব্দের তৃতীয় বর্ণে আলিফ দিয়ে, খ. আরবি শব্দের তৃতীয় বর্ণে ওয়াউ দিয়ে। তবে রসমে উসমানিতে যেহেতু শব্দটি ওয়াউ দিয়ে লেখা হয়েছে, তাই শুদ্ধ হলেও কোরআনের অনুলিপিতে সালাত শব্দটি আলিফ দিয়ে লেখা যাবে না। (আল-মুহাররার ফি উলুমিল কোরআন, পৃষ্ঠা ২২৬)
আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন