জনপ্রিয় লেখক তৈরি না হলে হুমকির মুখে পড়বে বাঙালির সভ্যতা ও সংস্কৃতি

আহমদ ছফা, হুমায়ূন আহমেদ, আল মাহমুদ ‌চলে গেছেন জাগতিক নিয়মেই। কিন্তু তাদের কোন প্রতিচ্ছবি এত বছরেও আমরা দেখিনি। ‌বিষয়টি নিয়ে আমাদের চিন্তা করা দরকার। ‌ভাবা দরকার। কেন জনপ্রিয় লেখক তৈরি হচ্ছে না, এটা নিয়ে গবেষণাও হতে পারে।

একবার ভাবুন তো, বই মেলায় অন্যপ্রকাশের কোনো স্টল নেই। মিসির আলি, হিমু কিংবা শুভ্র সেজে মেলায় আসেননি হুমায়ূন আহমেদ। মধ্যাহ্ন, দেয়াল, হোটেল গ্রেভার ইন, জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুল অথবা ফাউন্টেন পেন, কাঠপেন্সিল, এবং আমি -এসব কোন বই-ই পাঠকরা মেলায় খুঁজে পাচ্ছেন না। তখন বিষয়টা কী দাঁড়াবে?

 

আপনি আপনার মত করে ভাবুন। তবে আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, যে পরিমান পাঠক অমর একুশে বই মেলায় মিলিত হয়, এর ১০ ভাগ মানুষও আসবেনা। আরো স্পষ্ট করে বললে, ৫০ শতাংশ পাঠক মেলায় যায় নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের বই কিনতে। ‌তারা প্রত্যেকেই হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রগুলো ধারণ করে। কারো মনের ভেতর মিসির আলি, কেউ নিজেকে হিমু ভেবে খালি পায়ে হাঁটে, কেউ রুপা হয়ে ল্যান্ডফোনের পাশে অপেক্ষায় থাকে।

বাংলাদেশের মানুষ যখন বই পড়া মানে শুধু মাত্র পাঠ্যবই বা আমপারা-সিপারা বুঝতো তখন তিনি মানুষকে বুঝিয়েছিলেন “তুমি হয়তো একজন মিসির আলি নয়তো হিমু”। জনপ্রিয় লেখকের বই ছাড়া বাংলা একাডেমির পক্ষে মেলার আয়োজন করা একেবারেই সম্ভব না। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হলে আমি অ্যাক্যাডেমিক্যালি হুমায়ূন আহমেদের উপর ডক্টরেট করতাম।

বাজার দখলে এখন পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদ একজন দাপুটে লেখক হলেও আধুনিক বাংলার লেখক হিসেবে সাহিত্যের গভীরতা ছুঁতে পেরেছিলেন আহমদ ছফা।‌ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়েছেন কিন্তু গাভী বিত্তান্ত পাঠ করেন নি, এটা বেমানান। বাঙালি জাতিকে সবচেয়ে ভালো বুঝেছিলেন তিনি।

আমার ধারণা সারাজীবন বিপত্নীক থাকা এই লেখক সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর মানুষকে নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে গবেষণা করেছিলেন। বাঙালি জাতির যাপিত জীবন নিয়ে তিনি যেভাবে লিখেছেন আর কোন লেখক এত গভীরতা স্পর্শ করতে পারেননি।

আহমদ ছফা, বদরুদ্দীন উমর, হুমায়ুন আজাদ তারা ছিলেন প্রকৃত সাহিত্যিক।‌ তাদের বই ছাড়া মেলা চলবে ঠিক, কিন্তু অন্তঃসারশূন্য হবে।‌ সাহিত্যের মহোৎসবের এই মেলায় তারা সূর্যের মতো। ‌সবাইকে আলো দেয়। ‌

এক্ষেত্রে আল মাহমুদের বিষয়টি এজন্য এনেছি, বাঙালি পাঠকদের বিশাল অংশ মৌলিক সাহিত্য বা প্রকৃত কবি খুঁজে বেড়ায়। তাদের কাছে হুমায়ূন আহমেদ কিংবা আহমদ ছফা লেখক বটে কিন্তু সাহিত্যিক নন। কাবিলের বোন, কবির মুখ, সোনালি কাবিন পড়ে তারা যতটা তৃপ্তি পান অন্য কোন লেখকের সাহিত্যে এতটা মজা পান না। আল মাহমুদ তাদের কাছে একটি চেতনা। একটি জগত কিংবা পৃথিবী। সুতরাং আল মাহমুদ বাদ দিলে বই মেলায় সকল শ্রেণীর পাঠকের সমাগম ঘটানো সম্ভব হবে না।

এই গুটিকয়েক লেখক যা লিখেছেন তা দিয়েই আমাদের বইমেলা চলছে। তাদের বইগুলো বাজারে আছে বলেই এখনো বইমেলা জমে ওঠে। পাঠকেরা মেলায় আসে। বইয়ের গন্ধ শুঁকে।

কিন্তু এভাবে আর কতবছর, কতদিন, কতক্ষণ। আমাদের শূন্যতা অনুভব করা দরকার। হুমায়ূন আহমেদ, আহমদ ছফা, আল মাহমুদের প্রতিচ্ছবি তৈরি করা দরকার। ‌কেন পেশাদার লেখকের আবির্ভাব হচ্ছে না তা নিয়ে ভাবা দরকার। রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে শূন্যতা কোথায়। ‌কী করলে পেশাদার লেখকের দেখা পাবে বাঙালি পাঠক সমাজ। ‌কেনইবা পেশাদার লেখক তৈরি হচ্ছে না এই জবাবদিহিতা করতে হবে রাষ্ট্রকেই।

এই সমস্যা থেকে উত্তরণে প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে হলেও পাঠকপ্রিয় লেখক তৈরি করা দরকার। ‌ উদীয়মান তরুন লেখকদের ইচ্ছে মত লিখতে দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে তাদেরকে মূল্যায়ন করতে হবে। মৌলিক সাহিত্যের লেখক কিংবা কবিকে খুঁজে বের করতে হবে। ‌

তা না হলে সংকটে পড়বে বাঙালি জাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। অন্য জাতির মনোভাব ঢুকবে বাঙালি জাতির মনে। তারা যা দেখাবেন আমরা তাই দেখব এবং পড়বো। ভাবনায় যা দিবেন আমরা হয়তো তাই ভাববো।

তবে শুধু জনপ্রিয় লেখক তৈরি করলেই হবে না আমাদের প্রয়োজন সৃজনশীল ও মৌলিক সাহিত্যিক। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় গত ৪-৫ বছর যেসব বইগুলো সর্বাধিক বিক্রিত বা বেস্ট সেলার বইয়ের তালিকায় উঠেছিল সেগুলোর একটিও মৌলিক সাহিত্য ছিল না। সস্তা কিছু বিষয় তুলে এনে অনেকে রাতারাতি তারকা লেখক বনে গিয়েছিলেন। আবার অনেক ইসলামিক স্কলারকেও দেখেছি শত শত পৃষ্ঠার বই লিখতে। পাঠকরাও তাদের বই লুফে নিয়েছিলেন। যদিও এর পেছনে সঙ্গত কারণ ছিল।

তাদের বই কেন বেস্টসেলারের তালিকায় ছিল তা নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই। এই প্রসঙ্গটি শুধুমাত্র তাদের জন্য বলছি যারা একথা বলে প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, ” প্রতিবছর বইমেলায় নির্দিষ্ট কিছু লেখকের বই মানুষ প্রচুর ক্রয় করছে।” তারা আসলে সাহিত্য আর রচনার মধ্যে পার্থক্যটা ধরতে পারেনি হয়তো। সাহিত্য জ্ঞানের একটি মৌলিক শাখা। এখানে ধর্ম আছে। কিন্তু সেটাও হতে হবে ধর্মীয় সাহিত্য।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলাম অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে। ‌তার ভাষায়, ভালো লেখক তৈরি হচ্ছে না এ বিষয়টি আমি মানতে রাজি নই। তিনি মনে করেন, যারা ভালো লিখতে পারছে, পাঠকের মনের চাহিদা বুঝতে পারছে, তাদের আগ্রহ বাড়ছে। তবে একটা শূন্যস্থান যে তৈরি হয়েছে এটা অস্বীকার করা যায় না।

একজন প্রকাশক হিসেবে মাজহারুল ইসলাম হয়তো তার মনের কথা তুলে ধরেছেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় তরুণ ভালো লেখকরা এখনো পাঠকদের হৃদয় ছুঁতে পারেনি।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

রোজা আসার আগে যে ১১ প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি

আনসারুল হক

বাংলাদেশ আইম্মাহ্ পরিষদের ফেনী জেলা কমিটি গঠিত

নূর নিউজ

শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা, বিএনপির ৭ নেতাকর্মীর জামিন স্থগিত

আনসারুল হক