জাতীয় কবি ও আমাদের দায়িত্ববোধ

মাওলানা ইউসুফ নূর

কবি নজরুল ইসলাম এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব। তিনি হাই স্কুলের গন্ডি পার হতে পারেন নি কিন্তু তার লেখা কবিতা ও সংগীত বাংলা ও বিশ্ব সাহিত্যের এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী অধ্যায়। বেকারী শ্রমিক নজরুলের নামে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য কলেজ ও একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।বিশ্ব ইতিহাসে এর নজির নেই।

বিদ্রোহী কবির রণসংগীত যেমন আমাদের সংগ্রামী চেতনাকে আন্দোলিত করে তেমনি তার ইসলামী কাব্য আমাদের আধ্যাত্মিক খোরাক যোগায়। আদিল মাহমুদ যথার্থ লিখেছেন:

বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠীর নবজাগরণের প্রতীক নজরুল ইসলাম।তিনি মুসলিম ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সঙ্গে কোরআন ও হাদিসের আলোকে লিখেছেন সাড়া জাগানো কালজয়ী ইসলামি গান, গজল ও হামদ-নাত।

বাংলা ভাষায় যে সব গীতিকার ইসলামি গান লিখেছেন, তাদের মধ্যে নজরুলের নাম সকলের আগে চলে আসে । ইসলামের এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নেই, যা নিয়ে তিনি গান কিংবা কবিতা লেখেননি।

কাজী নজরুল ইসলামের লেখা প্রথম ইসলামী গান ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ এবং ‘ইসলামের ওই সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর’ যখন মরমী শিল্পী আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে গ্রামোফোনে রেকর্ড হয়ে বাজারে বের হলো, তখন বাঙালি মুসলমানদের মনে সে কী প্রাণের জোয়ার!

দীর্ঘদিনের ঘুমন্ত নির্জীব মুসলমানরা যেন হঠাৎ করে জেগে উঠল নতুন কোনো এক জীয়নকাঠির পরশে। অনেক প্রতীক্ষার পর অনেক ক্লান্তি শেষে তারা যেন কাছে পেল তাদের নব মুক্তির আহ্বায়ককে।

কাজী নজরুলের ইসলামি গানের মূল ভিত্তিই ছিল কুরআন ও হাদিস। অনেক ক্ষেত্রেই সেই নির্যাস প্রায় অনুবাদের ভাষা। কুরআনের নির্দেশনা ‘ হে নবী, বলুন, যদি তোমরা আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও, তাহলে আমারই অনুসরণ করো, আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন।’ কাজীর কথায় সেই নির্যাসই দৃশ্যমান-
‘আল্লাহকে যে পাইতে চায় হজরতকে ভালবেসে, খোদার হাবিব শেষ নবী তুই হবি নবীর হাবিব।’

নজরুল আল্লাহর শ্রেষ্ঠ্যত্বের পাশাপাশি তার সৌন্দর্যও বর্ণনা করেছেন। আল্লাহর সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি লিখেছেন: ‘হে চির-সুন্দর, বিশ্ব চরাচর তোমার মনোহর রূপের ছায়া, রবি শশী তারকায় তোমারই জ্যোতি ভায়রূপে রূপে তব অরূপ কায়া।’

নজরুল কেবল আল্লাহর সৌন্দর্যই বর্ণনাই করেননি, তাঁর ওপর ভরসা রাখারও আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন: ‘ও মন, কারো ভরসা করিসনে তুই এক আল্লাহর ভরসা কর, আল্লাহ যদি সহায় থাকেন ভাবনা কিসের, কিসের ডর।’

আল্লাহ প্রেম হল সকল প্রেমের ঊর্ধ্বে। আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই জীবনের মূল মন্ত্র। ইসলামি গানে কবির ভাষায়— ‘আল্লাহ আমার প্রভু আমার নাহি নাহি ভয়, আমার নবী মুহাম্মদ, যাঁহার তারিফ জগৎময়।’

‘মাগো আমায় শিখাইলী কোন্ আল্লাহ নাম, জপিলে আর হুঁশ থাকে না ভুলি সকল কাম।’

আল্লাহ কোরআনে ঘোষণা করেছেন়- ‘লা খওফুন আলাইহিম’ অর্থাৎ তাদের (মুমিন মুসলমান) কোনো ভয় নেই। কবি আল্লাহর ঘোষণাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন। তাই তিনি হাশরের মাঠে ভয়ে ভীত না হয়ে বরং আল্লাহর সাক্ষাতে খুশি হয়ে উঠবেন।

তার একটি ইসলামি গানে তিনি সেই কথাই বর্ণনা করেছেন: ‘যে দিন রোজ হাশরে করতে বিচার তুমি হবে কাজী, সে দিন তোমার দিদার আমি পাবো কি আল্লাজি, সে দিন নাকি তোমার ভীষণ কাহহার রূপ দেখে, পীর পয়গম্বর কাঁদবে ভয়ে ইয়া নফসি ডেকে, আমি তোমায় দেখে হাজারবার দোজখ যেতে রাজি।’
আল্লাহ প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পেয়ারে নবীজী মোহাম্মদ (সা.) এর প্রতি ভালোবাসাও কবির ইসলামি গানে প্রতীক হয়ে উঠেছে। নবীজীকে নিয়ে তিনি নাত লিখেছেন ১০০র বেশি। নবীজীর প্রশংসা ও স্তুতিবাক্যে রচিত এই গানগুলির জন্য মুসলিম সমাজ তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

তিনি লিখেছেন: ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এল রে দুনিয়ায়, আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়।’
‘মুহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে, তাই কি রে তোর কণ্ঠেরই গান এমন মধুর লাগে।’
নবীজীকে নিয়ে লিখা নজরুল ইসলামের আরও কয়েকটি বিখ্যাত সংগীত—

‘মুহাম্মদ বোল রে মন নাম আহমদ বোল।’
‘তৌহিদেররই মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম।’
‘তোমার নামে একি নেশা হে প্রিয় হযরত।’ ‘
এ কোন মধুর শারাব দিলে আল-আরাবী সাকি।’
‘মোহাম্মদ নাম যতই জপি ততই মধুর লাগে।’

‘ইয়া মুহাম্মদ বেহেশত হতে খোদায় পাওয়ার পথ দেখাও’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

আল্লাহ ও নবীজীর শানে সংগীত রচনার পাশাপাশি নজরুল মুসলিম জাতির পরিচয়, তাদের অতীত, মুসলমানদের বিভিন্ন পর্ব ইত্যাদি নিয়ে চমৎকার সব গান লিখেছেন। মুসলমানদের পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন: ‘ধর্মের পথে শহীদ যাহারা আমরা সেই সে জাতি, সাম্য-মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি।’
নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, ঈদ, কোরবানী, মহররম, রবিউল আউয়াল নিয়েও প্রচুর ইসলামি গান ও গজল লিখেছেন কবি। ঈদ নিয়ে তাঁর লেখা— ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’ এ গানটি না শুনলে ঈদের আনন্দই যেন অপূর্ণ থেকে যায়।

নবীজীর আবির্ভাবের আনন্দঘন দিনটি অর্থাৎ ১২ই রবিউল আউয়াল সম্পর্কে তিনি লিখেছেন— ‘আসিয়াছেন হাবিবে খোদা, আরশ পাকে তাই ওঠেছে শোর; চাঁদ পিয়াসে ছুটে আসে আকাশ পানে যেমন চকোর।’

‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর, বদনসীন আয়, আয় গুনাহগার নতুন করে সওদা কর।’ কাজী নজরুল ইসলাম ইসলামি গজল ও গানে আমাদের যা দিয়েছেন তা অতুলনীয়। ইসলামি গানের ভাণ্ডার তিনি পূর্ণ করেছেন তার শক্তিশালী কলমের ডগায়। ইসলামের প্রতি তার গভীর অনুরাগ থেকেই তিনি ইসলামি গানের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন।

ইসলামের প্রতি তার ভক্তি-ভালোবাসা, শ্রদ্ধার প্রতিফলন দেখতে পাই, তিনি যখন আল্লাহর কাছে যাওয়ার ব্যাকুল আশায় মগ্ন, তখন তিনি লেখেছেন— ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই। (তথ্যসূত্র: দৈনিক যুগান্তর )

আল্লাহ্ তাঁর এই আকুল প্রার্থনা কবুল করছেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তার কবর বিদ্যমান। আল্লাহর রহমতে কয়েক বছর পূর্বে কবির মাজারে ফাতেহা পাঠ করার সুযোগ হয়।

আলকুরআন আলেম সমাজ ও নজরুল
নজরুল বিশ্বাস করতেন,শুধু ইসলামী গান লিখে মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনা শানিত করা যাবে না।তাদের নিয়ে আসতে হবে কুরআনের ছায়াতলে এবং ছড়িয়ে দিতে হবে আলকুরআনের অমীয় বাণী। তাই তিনি রচনা করলেন আমপারার কাব্যানুবাদ। আমার মতে এটা নজরুলের এক অমর সৃষ্টি। আর সবচে’বড় কথা,তিনি এটি উৎসর্গ করেছিলেন “বাংলার নায়েবে নবী আলেম সমাজের প্রতি”।কিন্তু দু:খের বিষয়,আলেমগণ নজরুলের যথাযথ মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছেন। কবি নজরুল নিস্পাপ ছিলেন না।তার আমলি ত্রুটি -বিচ্যুতি অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কিন্তু তার অবদানকে অস্বীকার করা অনভিপ্রেত।

অপরদিকে উর্দুভাষী মুসলমানদের সচেতনতা দেখুন।তারা কবি ইকবালের অনেক চিন্তাধারার সাথে একমত না হলে ও তার কাব্য প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।আলেমদের সমর্থনে ইকবাল হয়ে উঠলেন প্রাচ্যের ইসলামী কবি আর তার কবিতাসমগ্র ইসলামী উর্দু সাহিত্যের কাননকে করেছে ফলে ফুলে সুশোভিত। ইকবালের কবিতা ও ব্যক্তিত্বকে আরব জাহানে সুপরিচিত করে দিয়েছিলেন আল্লামা আবুল হাসান নদবি রহ:। তিনি লিখেছেন:আমি ইকবালকে ভালবাসি।তবে তার অন্ধভক্ত নই।তার অনেক দর্শন ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক বিধায় তা সমর্থন করা যায় না।কিন্তু তার নবীপ্রেম ও মুসলিম রেনেসাঁর চেতনা ও অমর কাব্য প্রতিভাকে অবমূল্যায়ন করা উচিৎ নয়। (দেখুন নকুশে ইকবাল)

আল্লামা নদবি রহ বাংলাদেশ সফরে এসে নজরুল ও ফররুখের প্রতি আলেমদের অবহেলা দেখে আফসোস করেছিলেন।তিনি সকলকে নজরুল ও ফররুখের কাব্যগ্রন্থগুলোকে আরবি অনুবাদ করার ও আহবান জানিয়েছিলেন। মাওলানা সুলতান জওক কিছু কাজ ও করেছেন। আপনারা শুনে আশ্চর্য হবেন,ভারতের আলেমরা দেশজবোধ থেকে রবীন্দ্রনাথের কাব্যসমগ্র ও আরবিতে ভাষান্তর করেছেন।

বাংলাদেশী তরুণ আরবি সাহিত্যিকদের প্রতি আমাদের আহবান,আসুন,আমরা ও আমাদের নজরুলকে তুলে ধরি আরব বিশ্বে। এতে বৃদ্ধি পাবে আমাদের ইসলামী পরিচিতি, উজ্জ্বল হবে জাতির ভাবমূর্তি এবং সমৃদ্ধ হবে আলেমদের অবদান।

লেখক: প্রবন্ধকার ইমাম -খতিব,আরবি প্রশিক্ষক ও অনুবাদক,কাতার ধর্মমন্রণালয়, নির্বাহী পরিচালক, আলনূর কালচারাল সেন্টার কাতার।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

রামু লেখক ফোরামের সাহিত্য সাময়িকী পুষ্পকলি’র মোড়ক উন্মোচন

নূর নিউজ

কাতারে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতের সাথে আল নূর সেন্টার দায়িত্বশীলদের সৌজন্য সাক্ষাত

আনসারুল হক

জনপ্রিয় লেখক তৈরি না হলে হুমকির মুখে পড়বে বাঙালির সভ্যতা ও সংস্কৃতি

নূর নিউজ