কী হচ্ছে জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতারাও জানেন না

ক’মাস বাদে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। রাজনীতির পাড়ায় ‘বি টিম’ খ্যাত জাতীয় পার্টি কার সঙ্গে জোট বাঁধছে- আওয়ামী লীগ না-কি বিএনপি? এনিয়ে ফিসফাঁস চলছেই। গত দুই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে থেকেও তারা বিরোধী দল। তবে দলটির অধিকাংশ নেতাই থাকতে চান ক্ষমতার বলয়েই। আবার জাতীয় পার্টির শীর্ষ দুই মুখ চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও বিরোধীদলীয় নেতা রওশনের নেতৃত্বের টানাটানি নিয়েও কথার ঘোড়া প্রায়শই ছোটে জোর গতিতে। ৩০০ আসনে নির্বাচন-এই কথায় কেন্দ্রীয় নেতারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তারা বলছেন, এটা শুধুই রাজনৈতিক বচন।

বরাবরই জিএম কাদের সরকারবিরোধী কথা বলে আসছেন। তবে দলের নেতাকর্মীরা মনে করেন, বিরোধী কথা বললেও তিনি মূলত সরকারের পক্ষেই আছেন। আবার যেসব নেতা বিএনপি’র সঙ্গে জোট বাধার পক্ষে মত দিয়েছেন তারাও আছেন কিছুটা চাপে।

তবে তাদের একজন বলেন, শেষ পর্যন্ত বিএনপি’র অবস্থা ভালো হলে নেতারা সেদিকে ঝুঁকতেও হয়তো পিছপা হবেন না।
সম্প্রতি জিএম কাদেরের ভারত সফর নিয়েও নেতাকর্মীদের মধ্যে আগ্রহ ব্যাপক। তবে তারাও বলছেন, প্রতিবেশী দেশটা থেকে কী বার্তা পেয়েছেন চেয়ারম্যান এটা তারাও জানেন না। বিএনপি’র পক্ষে পরোক্ষভাবে মত দেয়া সেই নেতা বলেন, মহাসচিব জোর দিয়ে বলছেন রাজনীতিতে টিকে থাকতে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা জরুরি। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, তাহলে বিএনপি’র অবস্থান ভালো হলে এই দলটি কেন নয়?

দ্বাদশ নির্বাচন নিয়ে পার্টি চেয়ারম্যান সহসাই বলছেন- ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতারাই এই কথার খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ভোটের মাঠেও দলটার অবস্থা একেবারেই নাজুক। চলতি বছর হয়ে যাওয়া সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে দলটির ভোটব্যাংক যে তলানিতে সেটাও প্রমাণ হয়েছে।

আবার ভারত সফরে থাকা অবস্থায় রওশন এরশাদ সাক্ষাৎ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। চাউর হয়েছে, সেসময় জিএম কাদেরের বিভিন্ন সময় দেয়া সরকারবিরোধী বক্তব্যের পেপার কাটিং দিয়েছেন তিনি। এরপরই তিনি পার্টি চেয়ারম্যান হিসেবে নিজেকে জাহির করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেন। এনিয়ে জলঘোলা হয় বেশ। এরপর তিনি বলেন, এটা ভুলে গিয়েছে। মূলত এটা হবে সম্মেলন প্রস্তুতির প্রধান। আবার শোনা যায়, সম্প্রতি জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছে। নিজেদের মধ্যে বিরোধ ভুলে একসঙ্গে রাজনীতি করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে এই বিষয়টির নিয়ে কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। জানা যায়নি সত্যতাও।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্মেলন নিয়েও দলটির তেমন কোনো তোরজোড় নেই। আবার দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্যদের নিয়েও বৈঠকে বসেছিলেন জিএম কাদের ও মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু।

কোন জোটে ভিড়বে দলটি? গত ৫ই আগস্ট বনানীর চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে সাংগঠনিক বৈঠক ছিলো দলটির। নানা বিষয়ে আলোচনার ইস্যু থাকলেও মূলত আলোচনা হয়েছে কোন জোটে, কীভাবে যাবে তা নিয়ে। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, সদস্যদের বড় একটি অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধার পক্ষে রায় দিয়েছেন। আলোচনা হয়েছে বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধার বিষয়েও। আর পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বরাবরই বলে আসছেন, এককভাবে ৩০০ আসনে নির্বাচনে যাবে। কিন্তু মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর কথার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি পার্টি চেয়ারম্যানের।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনে যাওয়ার কথা বলেন অনেক সদস্য। তবে চেয়ারম্যানের সরকারের সঙ্গে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলা হলে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, তবে কেন চলমান সময়ে ও উপনির্বাচনে একসঙ্গে গেলো? এই প্রশ্নের পর কিছুটা বিব্রত হন তিনি।

বেশ কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরাসরি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধার কথা বলা না হলেও অনেকেই আকার-ইঙ্গিতে তা প্রকাশ করেছেন। ঠিক তেমনি বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধার কথাও উঠে।

বৈঠকে অংশ নেয়া একাধিক নেতা বলেন, প্রায় তিনঘণ্টা ধরে চলা এই আলোচনায় চেয়ারম্যান ও মাহসচিব ভিন্ন ভিন্ন কথা বলেছেন। চেয়ারম্যান বরাবরের মতো, নিজেদের স্বকীয় রাজনীতি করে যাবার পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি বৈঠকে বলেন, জাতীয় পার্টি নিজস্ব আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করবে। কারো বি-টিম হয়ে তারা রাজনীতি করতে চায় না। প্রায়শই গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্যের মতো তিনি বলেন, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের পক্ষে আমরা।

আর বৈঠকে মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু বলেন, শুধু আদর্শ দিয়ে রাজনীতি হয় না। রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকতে হলে আমাদেরকে সংসদে থাকতে হবে। সেই হিসাব করেই আমাদের রাজনীতি করা উচিত। বৈঠক অংশ নেয়া কয়েকজন নেতা জানান, কেউই আওয়ামী লীগের পক্ষে বা বিপক্ষে বলেন নাই। তবে সরকারপন্থি নেতারা সরাসরি না বললেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধার কথা বলেন। আবার কোনো এক সদস্য বিএনপির বর্তমান অবস্থান তুলে ধরে তাদের সঙ্গে জোটে যাওয়া যায় কি-না তা নিয়েও প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। বৈঠকে পক্ষে, বিপক্ষে নানা কথা ওঠায় কিছুটা কৌশল অবলম্বন করেন জিএম কাদের।

এসময় চেয়ারম্যানের কথার প্রেক্ষিতে এক সদস্য বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে না থাকার কথা বারবার বলা হলেও কেন উপনির্বাচনগুলোতে গেলাম সরকারের সঙ্গে? এই প্রশ্নের পরই কথার মোড় ঘুরিয়ে নেন কাদের। আবার এরশাদ পত্মী রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কারণে অনেক নেতা বিপরীতার্থক কথার সম্মুখীন হন, যা নিয়েও ক্ষোভ বাসা বাঁধছে বলে জানা যায়।

বৈঠকের বিষয়ে প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. আবুল কাশেম বলেন, বৈঠকে দলের ভবিষ্যত, রাজনীতি কীভাবে চলবে তা নিয়ে কথা হয়েছে। আমাদের মহাসচিব ও চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটাই আমাদের সিদ্ধান্ত। আমি মনে করি সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত এরকমই চলবে। প্রেসিডিয়াম ও সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, আমরা এককভাবে ৩০০ আসনে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এরমধ্যে যদি জোটের পরিকল্পনা হয় তাহলে প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলবে। আমাদের যদি কোনো জোটে যেতে হয় আমরা কোনদিকে যাব। ওখানে যারা বক্তৃতা দিয়েছেন তাদের মিশ্র একটা প্রতিক্রিয়া ছিল।

প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা বলেন, আমি পুরোসময় ছিলাম না। যতক্ষণ ছিলাম কোনো প্রেসিডিয়াম সদস্য আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির সঙ্গে জোটে যাওয়ার কথা বলেন নাই। বলেছে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কোনদিকে যাব। প্রেসিডিয়াম ও সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু বলেন, আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব যেভাবে সাধারণত বক্তব্য দেন সেভাবেই আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সদস্যরা তাদের মতামত ভাসাভাসা দিয়েছেন। যাতে বক্তব্য পক্ষে কিংবা বিপক্ষে না যায়।

বৈঠকে অংশ নেয়া একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, জাতীয় পার্টি বরাবরের মতোই ক্ষমতার বলয়ে থাকার চিন্তা করছে। যেহেতু বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগ কিছুটা চাপের মুখে আছে সেহেতু শীর্ষ নেতারা পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করছেন। বৈঠকে সবার সামনে ফরমাল আলোচনা হলেও আসল আলোচনা হচ্ছে বৈঠকের বাইরে। কয়েকজন মিলে। তিনি কিছুটা ক্ষোভ নিয়েই বলেন, দলের তো ভোট কমছেই। কিন্তু দলটার গুরুত্ব আছে। আমাদের নীতি নির্ধারকরা এবারও ক্ষমতার বলয়ে আসার চিন্তা করছেন। যোগাযোগ রাখছেন আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু’দলের সঙ্গেই। সুযোগ বুঝেই ইউটার্ন নেবেন তারা।

নির্বাচন যতো ঘনিয়ে আসছে তৃণমূল নেতাকর্মীদের দলের অবস্থান স্পষ্টকরণের চাপ বাড়ছে। তারা বলছেন, নির্বাচন ঘিরে যখন বড় দুই দল মাঠে অবস্থান শক্ত করেছেন, আমরা জানিই না কোন দলের সঙ্গে আমরা আছি। এমনকি চেয়ারম্যানের ৩০০ আসনে নির্বাচন করার ঘোষণাতেও ভরসা রাখতে পারছেন না তারা। রংপুরের জাতীয় পার্টির তৃণমূলের প্রবীন রাজনীতিবিদ আকবর আলী বলেন, এভাবে চলতে থাকলে জননেতা এরশাদের জনপ্রিয়তা ধুলায় মিশে যাবে। জাতীয় পার্টি হারিয়ে যাবে। নির্বাচন ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। কেন্দ্রীয় নেতারা পরিপাটি বক্তব্য দিচ্ছেন। সবই হচ্ছে শুধু দলের অবস্থান পরিষ্কার করছেন না। আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের মানসিক দুর্বলতাও বাড়ছে।

দিন যতো গড়াচ্ছে ততই নেতাকর্মীদের মধ্যে অস্বস্থিকর অবস্থা বাড়ছে। সম্প্রতি দলটির চেয়ারম্যান কার্যালয় ও কাকরাইল পার্টি অফিসে বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এটা স্পষ্ট যে, তাদের মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করছে। গত সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী ও চলতি নির্বাচনেও মনোনয়ন প্রত্যাশী এক নেতা বলেন, আমরা একটা স্পষ্ট বার্তা চাই। আমরা কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছ থেকে জানতে চাই নির্বাচনে আমাদের অবস্থান কী হবে? আর এই বার্তা আমরা এখনই চাই। তাদের শুধু এককথা এই সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে আমরা নেব। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, তাহলে কি আমরা প্রেসক্রিপশনের অপেক্ষায় থাকব? আমাদের মেরুদণ্ড কি এতোটাই দুর্বল? প্রয়াত চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের নানা গুণগান গাওয়ার পর তিনি বলেন, আমাদের দলটার অবস্থান এতোটাও ঠুনকো নিশ্চয়ই নয়। আমরা বিরোধী দল। তিনি আরও প্রশ্ন রেখে বলেন, একটা গণতান্ত্রিক দেশের বিরোধী দল কেন অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে?
দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আমরা সংলাপ বা আলোচনার মাধ্যমে সংবিধানের ভেতরে থেকে সমস্যার সমাধান করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাই। তিনি বলেন, আমরা ৩০০ আসনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।

সূত্র: মানবজমিন

এ জাতীয় আরো সংবাদ

চট্টগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ

নূর নিউজ

সমুদ্র অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শক্তিশালী নৌবাহিনীর বিকল্প নেই: প্রধানমন্ত্রী

নূর নিউজ

রমজানের টেলিভিশনে অশ্লীলতা বন্ধ রাখতে হবে: চরমোনাই পীর

নূর নিউজ