জামায়াতের সঙ্গে সৃষ্ট দূরত্ব কমাতে বিএনপি নেতাদের নির্দেশ

সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন করছে বিএনপি। তবে দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামী এই মুহূর্তে তাদের সঙ্গে নেই। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর থেকে দীর্ঘদিন রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে ছিল জামায়াত। তবে কিছুদিন ধরে আলাদা কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য জানান দিতে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন বাতিল হওয়া দলটি। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জামায়াতকে আবারও কাছে টানতে চাইছে বিএনপির হাইকমান্ড। আলাপ-আলোচনা করে পুরোনো মিত্রের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচাতে এরই মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

জানা গেছে, গত ডিসেম্বরে যুগপৎ আন্দোলনের শুরুতে দুটি কর্মসূচিতে বিএনপির সঙ্গে ছিল জামায়াত। এরপর থেকে তারা এককভাবে কর্মসূচি পালন করছে। গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে ১০ দফার ভিত্তিতে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। এর আগের দিন গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে জোট বিলুপ্তির ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর থেকে আন্দোলন বা কর্মসূচি নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেনি বিএনপি। বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি জামায়াত।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ  বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলন শুরুর সময় আমরা আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের আমির গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ার পর যুগপৎ আন্দোলন যে প্রক্রিয়ায় চালিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, বিএনপি ঠিক সেভাবে ভূমিকা পালন করেনি। কারণ, যুগপৎ আন্দোলন হবে উভয়ের আলোচনার ভিত্তিতে। যেহেতু বিএনপি যুগপতের প্রধান শরিক, তাদের পক্ষ থেকে সেভাবে যোগাযোগ না রাখায় জামায়াত নিজস্ব স্টাইলে আন্দোলন শুরু করে। এখনো সেটা অব্যাহত আছে। রাজনীতিতে যে যার ধারায় রাজনীতি করবে, এখানে মনোমালিন্যের কোনো বিষয় নেই। আমরা আমাদের রাজনীতি করছি, বিএনপি তাদের রাজনীতি করছে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দুটি ঘটনার কারণে দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের রাজনৈতিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়। প্রথমত, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে যখন জামায়াতের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা হচ্ছিল, তখন জামায়াতের পক্ষ থেকে ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপিকে কর্মসূচি দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। তবে জামায়াতের সেই অনুরোধে সাড়া না দিয়ে চুপ ছিল বিএনপি। এই বিষয়টিকে তখন সাংগঠনিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভালোভাবে নেয়নি জামায়াত। দ্বিতীয়ত, বিদেশিদের পরামর্শ, অভ্যন্তরীণ নানামুখী চাপ এবং যুগপৎ আন্দোলনের কোনো কোনো শরিকের আপত্তির কারণে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে বিএনপি।

তবে বিএনপির অনেক নেতার দাবি, জামায়াত কার্যত বিএনপির সঙ্গেই রয়েছে। সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় বোঝাপড়ার ভিত্তিতে কৌশলের অংশ হিসেবে এককভাবে কর্মসূচি করছে জামায়াত। তারাও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে মাঠে রয়েছে, যেটি বিএনপিরও দাবি। তা ছাড়া জামায়াতের সঙ্গে তাদের যোগাযোগও রয়েছে। জামায়াত নেতারাও বলছেন, তাদের সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের যোগাযোগ আছে। বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে তারাও একদফার আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কৌশলে হলেও আবার যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হবেন তারা।

সূত্র জানায়, একদফার ভিত্তিতে চূড়ান্ত আন্দোলন শুরুর প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য দলের নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দুই দলের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব ঘুচিয়ে আন্দোলনে জামায়াতকে পাশে রাখার উদ্যোগ নিতে বলেছেন তিনি। তার নির্দেশনার পর ইতোমধ্যেই জামায়াতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন বিএনপি নেতারা।

জানা গেছে, ঢাকায় গত ২৮ জুলাই বিএনপির মহাসমাবেশের আগের দিন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের কথা হয়। তখন জামায়াতের পক্ষ থেকে বিএনপির হাইকমান্ডকে জানানো হয় যে, তারা কৌশলগত কারণে আপাতত আলাদাভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবে। তাদের অন্যতম দাবি হচ্ছে, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। ভবিষ্যতে পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হলে তখন বিএনপির সঙ্গে একদফার আন্দোলনেও তারা সম্পৃক্ত হবেন।

জামায়াত ইসলামী সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে তারা অটল। আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে বিএনপির মতো তারাও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। সরকার স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে আন্দোলনের মাধ্যমে পদত্যাগে বাধ্য করার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন তারা। জামায়াতের দুই দায়িত্বশীল নেতা বলেন, তাদের চলমান আন্দোলনের মূল লক্ষ্য এই সরকারের পতন।

এক দশক পর জামায়াত ঢাকায় প্রকাশ্যে সমাবেশ করে গত ১০ জুন। তাদের এই সমাবেশের ব্যাপারে পুলিশ অনুমতি দিয়েছিল। সরকারের অনুমতি দেওয়া ও জামায়াতের সমাবেশ করার বিষয় নিয়ে সে সময় রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা হয়। সরকারের সঙ্গে জামায়াতের আঁতাতের বিষয়টিও তখন আলোচনায় আসে। দীর্ঘদিন পর জামায়াতকে প্রকাশ্যে সমাবেশের অনুমতির পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও তখন বলেছিলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগ স্পষ্ট।’ বিএনপি মহাসচিবের এমন বক্তব্যে দুই দলের মধ্যে তখন নতুন করে ‘মনোমালিন্য’ দেখা দেয়। এ নিয়ে জামায়াতের প্রতিক্রিয়ার পর বিএনপি মহাসচিব তার বক্তব্যের ব্যাখ্যাও দেন। মির্জা ফখরুল তখন বলেন, ‘আমরা যুগপৎভাবে আন্দোলন করছি, আমরা জোটবদ্ধ আন্দোলন করছি না। সব রাজনৈতিক দল যারা মনে করে যে, এই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা উচিত, তারাই আন্দোলন করতে পারে, এটাই স্বাভাবিক। জামায়াতও নিজস্ব জায়গা থেকে আন্দোলন করছে। এখন আরও অনেক দল যারা যুগপৎ আন্দোলনে নেই, কিন্তু তারাও আন্দোলন করছে, আমরা সবাইকে স্বাগত জানিয়েছি।’

জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীকে যেভাবে চতুর্দিক থেকে চেপে ধরা হয়েছে, তাতে দলটির যে নতুন প্রজন্ম তারা তাদের নাগরিক অধিকারের দাবিতে তো আন্দোলন করতে পারে। এই নতুন প্রজন্মের কেউ যদি দলবদ্ধভাবে এগিয়ে আসে, বিএনপি তাদের স্বাগতই জানাবে। এখানে দূরত্ব বা মনোমালিন্য কিংবা ভালো-খারাপের তো কোনো ব্যাপার নেই।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামীর মতো জাতীয় পার্টিও তো একদফার আন্দোলনে নেই। কিন্তু জাতীয় পার্টিও তো বলছে যে, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। এই দাবিতে কেউ যদি আমাদের সঙ্গে একমত হয়, আমরা তাদের অবশ্যই স্বাগত জানাব। যার যার অবস্থান থেকে সবাই যদি সমস্বরে কথা বলে, সেখানেও একটা ঐক্যতান শুরু হয়। গান এক কণ্ঠে হয়, দ্বিকণ্ঠে হয় আবার সমবেত কণ্ঠেও হয়। সুতরাং তাতে কোনো সমস্যা হয় না।

এদিকে গত জুনে ঢাকায় অনুমতি পেলেও পরবর্তীতে সিলেট ও চট্টগ্রামে সমাবেশের অনুমতি পায়নি জামায়াত। এ ছাড়া পুলিশের অনুমতি না পাওয়ায় গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় অনুষ্ঠেয় সমাবেশের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি স্থগিত করে জামায়াত। আগামী ৪ আগস্ট ঢাকায় সমাবেশের নতুন তারিখ ঘোষণা করেছে দলটি।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

ঈদুল ফিতরের ছুটিতে কর্মস্থলে থাকতে হবে চাকরিজীবীদের

আনসারুল হক

রাজধানীতে ইসলামী আন্দোলন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ভ্যান বিতরণ

নূর নিউজ

বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না বলে তারা এখানে এসেছে: আমীর খসরু

নূর নিউজ