পৃথিবীর চারজন বড় বড় শাসকের অন্যতম একজন নমরুদ। প্রায় ৪০০ বছর রাজত্ব করেছিলো সে। খলিলুল্লাহ হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সময়কালের শাসক ছিলো নমরুদ। ইবরাহিম আ. যখন আল্লাহর একত্ববাদের দিকে আহ্বান করলেন, তখন বাদশাহ নমরুদ একত্ববাদের আহ্বানকারী হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘সে কেমন প্রভু? যার প্রতি তুমি মানুষকে আহ্বান করছ? আমাকে তাঁর কিছু বৈশিষ্ট্য শোনাও।
তখন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম বললেন, ‘জীবন-মরণের সব শক্তি তারই হাতে। তিনি সমগ্র সৃষ্টির নিয়ন্ত্রণকর্তা ও পালনকর্তা। কারো সাধ্য নেই যে তার এ ক্ষমতার মধ্যে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করবে। হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের এ প্রশ্নের উত্তরেই নির্ধারিত হয়েছিল যে, একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী শুধুই আল্লাহ তাআলা
তারপরও নমরুদ নিজেকে জীবন-মৃত্যুর ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবি করে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুজন কয়েদিকে ডেকে এনে একজনকে ফাঁসি আর একজনকে ক্ষমা করে মুক্তির নির্দেশ দেয়। আর বলে আমি নিজেও মানুষকে জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটাই।
সঙ্গে সঙ্গে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম বললেন, ‘জীবন-মৃত্যুর বিষয়টি থাকুক। মানুষের সাধারণ বুঝের প্রতি খেয়াল করে তিনি বললেন, ‘প্রকৃতির সাধারণ একটি ক্ষেত্রে তোমার শক্তি পরীক্ষা করে দেখাও। নমরুদ নিজেকে সূর্যদেবীর অবতার মনে করত।
সূর্যকে দেবতা মানার এ ভ্রান্ত আকিদার মূলে কুঠারাঘাত করতেই তিনি নমরুদকে বললেন, ‘(আমি যার দিকে মানুষকে আহ্বান করি সে আল্লাহ তাআলা পূর্ব দিক থেকে সূর্য উদিত করেন। তুমি যদি সত্যিই নিজেকে রব ও সূর্য দেবীর অবতার হিসেবে দাবি কর তবে, একবারের জন্য হলেও পশ্চিম দিক থেকে সূর্যকে উদিত করে দেখাও।
হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের এ দাবির ফলে নমরুদ হতবুদ্ধি হয়ে যায়। তার দাবি পূরণে অপারগ হয়ে যায়। তা করে দেখানো দূরের কথা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের কথা শুনেই নমরুদ নির্বাক ও হতবম্ভ হয়ে যায়। এ বিষয়টি পবিত্র কোরআনে তুলে ধরা হয়েছে এভাবে-
اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡ حَآجَّ اِبۡرٰهٖمَ فِیۡ رَبِّهٖۤ اَنۡ اٰتٰىهُ اللّٰهُ الۡمُلۡکَ ۘ اِذۡ قَالَ اِبۡرٰهٖمُ رَبِّیَ الَّذِیۡ یُحۡیٖ وَ یُمِیۡتُ ۙ قَالَ اَنَا اُحۡیٖ وَ اُمِیۡتُ ؕ قَالَ اِبۡرٰهٖمُ فَاِنَّ اللّٰهَ یَاۡتِیۡ بِالشَّمۡسِ مِنَ الۡمَشۡرِقِ فَاۡتِ بِهَا مِنَ الۡمَغۡرِبِ فَبُهِتَ الَّذِیۡ کَفَرَ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ
অর্থ : আপনি কি ওই ব্যক্তিকে দেখেননি, যে ইবরাহীমের সাথে তার রব সম্বন্ধে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল, যেহেতু আল্লাহ তাকে রাজত্ব দিয়েছিলেন। যখন ইবরাহীম বললেন, ‘আমার রব তিনিই যিনি জীবনদান করেন ও মৃত্যু ঘটান, সে বলল, আমিও তো জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই। ইবরাহীম বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদয় করান, তুমি সেটাকে পশ্চিম দিক থেকে উদয় করাও তো। তারপর যে কুফরী করেছিল সে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। আর আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না। (সুরা বাকারা, আয়াত, ২৫৮)
নমরুদ রেগে গিয়ে ইবরাহিম আ.-কে আগুনে নিক্ষেপ করলো। আল্লাহ তায়ালা জ্বলন্ত আগুনকে তার খলিলের জন্য শীতল করে দিলেন। মহান আল্লাহ আগুনকে নির্দেশ দেন—‘হে অগ্নি, তুমি হজরত ইবরাহিমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৬৯)
হজরত ইবরাহিম (আ.) এর একত্ববাদের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে নমরুদ উল্টো আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণার ধৃষ্টতা দেখিয়ে বাহিনী প্রস্তুত করলো। এই ঘোষণার পর সে আকাশের দিকে তীর নিক্ষেপ করলো। এই সময় হজরত ইবরাহিম (আ.) দূরে আকাশের দিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন।
দূরে কালো রঙের একটা মেঘ দেখা যাচ্ছিল, যখন সেটা কাছে চলে এলো, লাখ লাখ মশার গুনগুন শব্দে ময়দান মুখরিত হলো। কিন্তু নমরুদ অবজ্ঞার সুরে বলল, এ তো মশা! তুচ্ছ প্রাণী, তা-ও আবার নিরস্ত্র। এ সময়ের মধ্যে নমরুদের প্রত্যেক সৈন্যের মাথার ওপর মশা অবস্থান নিল।
তাদের বুঝে ওঠার আগেই মশাগুলো তাদের নাক দিয়ে মস্তিষ্কে প্রবেশ করল। তারপর দংশন করা শুরু করল। সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলো। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তীরন্দাজরা ঊর্ধ্বে তীর নিক্ষেপ আর পদাতিক সেনারা নিজেদের চারপাশে অন্ধের মতো তরবারি চালাল, যার ফলে একে অপরকে নিজেদের অজান্তেই আহত বা নিহত করে ফেলল।
মশার সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে নমরুদ পালিয়ে প্রাসাদে চলে এলো। এ সময় একটি দুর্বল লেংড়া মশা তাকে তাড়া করল এবং কিছুক্ষণ মাথার চারপাশে ঘুরে নাক দিয়ে মস্তিষ্কে ঢুকে পড়ল। এরপর মগজে দংশন করা শুরু করল। নমরুদ যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উন্মাদের মতো প্রাসাদে প্রবেশ করল এবং যন্ত্রণায় দিশাহারা হয়ে পায়ের জুতা খুলে নিজের মাথায় আঘাত করতে শুরু করল। অবশেষে মাথায় মৃদু আঘাত করার জন্য একজন সার্বক্ষণিক কর্মচারী নিযুক্ত করল নমরুদ।
সুদীর্ঘ ৪০ বছর তাকে এই দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল। অবশেষে মাথার আঘাতের ব্যথায় নমরুদের মৃত্যু হয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির, পৃষ্ঠা. ৬৮৬)