রমাদানে সাধারণত যে ১৫টি ভুল হয়ে থাকে

মুফতী মুহাম্মদ ইসমাঈল

চলছে সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমাদান। মহিমান্বিত এ মাসে রোজা রেখে অশেষ সওয়াব অর্জন করা যায়। ইবাদতের বসন্ত পবিত্রতম এ মাসে মানুষ ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ইসলামি শরিয়া বিরোধী প্রচলিত এমন কিছু কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে যায়, যা রমজান মাসের মর্যাদা ও পরিত্রতাকে ক্ষুন্ন করে। প্রকৃত মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো এ মাসে সিয়াম পালনের পাশাপাশি প্রচলিত ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা এবং এসব বিষয় সম্পর্কে অপরকে নিরুৎসাহিত করা।

রমাদান মাসে মানুষের পক্ষ থেকে সাধারণত যেসব  ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকে সেসবের মধ্য থেকে অন্যতম হলো :

১. রমাদানকে প্রথাগত অনুষ্ঠান মনে করা
অনেকেই রমাদান মাসকে ইবাদাতের বদলে প্রথাগত অনুষ্ঠান মনে করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্তÍ উপোস থাকেন শুধুমাত্র আশপাশের সবাই রোযা রাখে বলে। এটা ভুল ধারণা। মনে রাখুন, এই মাসটি মুমিনের অন্তর ও আত্মাকে সকল প্রকার খারাপ কাজ থেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য আল্লাহর অনেক বড় নেয়ামত।

২. পানাহারের ব্যাপারে অতিমাত্রায় চাপে থাকা
কারো কারো ক্ষেত্রে রমাদান মাসের পুরোটাই খাবার ঘিরে আবর্তিত হয়। সালাত, কুরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদাতের ব্যাপারে যতœশীল হওয়ার বদলে চিন্তা ভাবনার পুরোটা জুড়েই থাকে ‘খাওয়া-দাওয়া’। এভাবে আমরা উপোস থাকার মাসকে ভোজের মাসে পরিণত করেছি। পক্ষান্তরে, রমাদানের মুখ্য উদ্দেশ্য ভুলে যাচ্ছি। মনে রাখতে হবে, এটাও এক ধরনের অপচয় এবং সীমালঙ্ঘন।

৩. সারা দিন রান্না করে কাটানো
কোনো কোনো মা-বোন রমাদানে দিন-রাত রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ফলে দিন শেষে তারা এতটাই ক্লান্তÍ হয়ে পড়েন যে এশার সালাত ও তারাবি পড়তে পারেন না, তাহাজ্জুদ কিংবা কুরআন তিলাওয়াতও সম্ভব হয় না। মনে রাখুন, এই মাস মাগফিরাত এবং মুক্তি লাভের মাস। তাই, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করে আমলের প্রতি মনোযোগী হন।

৪. মাত্রাতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়া
অনেকে সাহরির সময় প্রচুর খাওয়া-দাওয়া করেন। তারা ভাবেন, সারা দিন ক্ষুধার্ত অনুভব না করার এটাই একমাত্র পথ, আর কতক মানুষ ইফতারের সময় ভরপুর খেয়ে সারাদিন না খাওয়ার অভাব মিটিয়ে নেন। এটা সম্পূর্ণ সুন্নাহ্ বিরোধী। মনে রাখবেন, পরিমিতিবোধ সব কিছুর চাবিকাঠি।

৫. সারা দিন ঘুমিয়ে কাটানো
রমাদান মাস অত্যন্ত মূল্যবান সময়। আমাদের অনুধাবন করার পূর্বেই এই মাগফিরাত ও মুক্তির মাস শেষ হয়ে যাবে। সারা দিন ঘুমিয়ে কাটানো উচিত নয়। রমাদানের প্রতিটি মূহুর্ত আল্লাহর ইবাদাতে কাটান। যাতে এই মাসের সর্বোচ্চ সাওয়াব লাভ করা যায়।

৬. রোযা রেখে খারাপ কাজ করা
রোযা রাখার উদ্দেশ্য শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকা নয় বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাকওয়া অর্জন। অনেকে রোযা রেখেও খারাপ কাজ বর্জন করে না। মিথ্যাচার, মারামারি, গীবত, প্রতারণা, চুরি, যিনাসহ যাবতীয় পাপকর্মে লিপ্ত থাকে। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও এর উপর আমল করা বর্জন করে না ও মূর্খতা পরিহার করে না, তার পানাহার হতে বিরত থেকে উপবাস করা আল্লাহর নিকট প্রয়োজন নেই।”(বুখারি)

৭. ধূমপান করা
ধূমপান রমাদান মাসেই হোক বা এর বাইরে হোক, সবর্দা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এতে শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি ইবাদতেও বিঘœ ঘটে। ধূমপায়ীদের আশপাশে যারা থাকেন তাদের জন্যও ক্ষতিকর। অযথা অর্থ অপচয়ের একটি মাধ্যমও বটে। আর পবিত্র কুরআনে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই ধূমপান বর্জন করা উত্তম।

৮. ইচ্ছাকৃতভাবে সাহরি বাদ দেওয়া
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “সাহরি খাও, কারণ এর মধ্যে বরকত রয়েছে।”(বুখারি, মুসলিম) অন্যত্র রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “আমাদের সাওম আর আহলে কিতাবদের সাওম পালনের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হচ্ছে সাহরি গ্রহণ।” (মুসলিম)

৯. সাহরি না খাওয়ার কারণে রোযা না রাখা
অনেকে সাহরি খাওয়ার না কারণে রোযা পালন করেন না। এটা এক ধরনের খোড়া অযুহাত। এমন তো নয়, যে কয়েক মুঠো খাবার না খেলে আমরা মরে যাব। আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য সবকিছুর উর্দ্ধে।

১০. ইফতার করতে বিলম্ব করা
অনেকে ইফতারের সময় মাগরিবের আযান শেষ হওয়া পর্যন্তÍ বসে থাকেন, আযান শেষ হলে ইফতার করেন। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর আযানের সাথে সাথে রোযা ভাঙা (ইফতার করা) সুন্নাহ সম্মত। হযরত আনাস (রা.) বলেন,“ আল্লাহর রাসূল (সা.) এটাই করতেন। (মুসলিম)

১১. ইফতার খেতে গিয়ে মাগরিবের জামাত ছুটে যাওয়া
অনেকে ইফতারিতে এত বেশি খাবার নিয়ে বসেন যে, সেগুলো শেষ করতে গিয়ে মাগরিবের জামাত ধরতে পারেন না। এটা একেবারেই অনুচিত। রাসূল (সা.) কয়েক টুকরা খেজুর মুখে দিয়ে ইফতার করে মাগরিবের নামাযে চলে যেতেন। অতপর নামায শেষ করে অবশিষ্ট ইফতার খেতেন।

১২. দুআ কবুল হওয়ার সুযোগ ছেড়ে দেওয়া
ইফতারের সময় রোযাদার ব্যক্তির দুআ আল্লাহর নিকট কবুল হয়। অনেকে এই সময়ে দুআ না করে খাবার পরিবেশন, কথাবার্তা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকে, যা উচিত নয়। রাসূল (সা.) বলেন, “তিন ধরনের ব্যক্তির দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না- ১) একজন পিতার দুআ, ২) রোযাদার ব্যক্তির দুআ, ৩) মুসাফিরের দুআ। (বায়হাকি)

১৩. পরীক্ষা কিংবা কর্মব্যস্ততার জন্য রোযা না রাখা
পরীক্ষা কিংবা কর্মব্যস্ততার কারণে রোযা না রাখা শরীয়ত সম্মত নয়। সকালে পড়ালেখা করতে কষ্ট হলে রাতে করুন। মনে রাখবেন, পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার চেয়ে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা মূল লক্ষ্য। পড়ালেখা করার মধ্য দিয়েও যদি আমরা রোযা রাখার মত ফরয ইবাদাতের চেষ্টা করি, আল্লাহ আমাদের জন্য তা সহজ করে দিবেন।

১৪. স্বাস্থ্য কমানোর উদ্দ্যেশ্যে রোযা রাখা
স্বাস্থ্য কমানোর জন্য রোযা রাখা উচিত নয়। এটি একটি বড় ভুল। রোযা পালন করার একমাত্র উদ্দ্যেশ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। যদি কেউ স্বাস্থ্য কমানোর জন্য রোযা রাখে তাহলে তা ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে না।

১৫. শুধু ২৭ রমাদানের রাতকে লাইলাতুল কদর মনে করে ইবাদত করা
অনেকে কেবল ২৭ রমাদান রাতেই লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য ইবাদত করেন। অন্যান্য বিজোড় রাতগুলিকে প্রাধান্য দেয় না। রাসূল (সা.) বলেছেন,“রমাদানের শেষ দশ রাত্রির বিজোড় রাতগুলিতে লাইলাতুল কদর তালাশ কর।”(বুখারি ও মুসলিম)

১৫. ঈদের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে রমাদানের শেষাংশে অবহেলা করা
অনেকে রমাদানের শেষ দশ দিন লাইলাতুল কদরের তালাশ না করে ঈদের নতুন কাপড় কেনা,খাবারের আয়োজন, মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে সময় কাটিয়ে দেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত,“যখন রমাদানের শেষ দশক শুরু হত রাসূল (সা.) লুঙ্গি শক্ত করে বাঁধতেন, স্ত্রীদের সাথে অন্তরঙ্গ হওয়া থেকে বিরত থাকতেন। রাত্রি জাগরণ করতেন এবং তাঁর পরিবারকে জাগিয়ে তুলতেন।” (বুখারি,মুসলিম)

লেখক : বিশিষ্ট দাঈ ও প্রিন্সিপাল, আন-নূর কালচারাল সেন্টার, নিউইয়র্ক

এ জাতীয় আরো সংবাদ

সোমবার থেকে সারাদেশে কঠোর লকডাউন

আনসারুল হক

কোরবানির পশুর ধরণ ও বয়স সর্ম্পকিত বিধান

আনসারুল হক

মানব সেবায় আল্লাহর সন্তুষ্টি

নূর নিউজ