রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে যাচ্ছে কওমি মাদ্রাসাগুেলো

শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কওমি মাদ্রাসাগুলোকে একটি কাঠামোয় ফিরিয়ে আনার কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পর্যবেক্ষণ নিয়ে শিক্ষা আইনের যে খসড়া পুনর্গঠন করা হচ্ছে তাতে কওমি থাকছে গুরুত্বের সঙ্গে। আইন সম্পন্ন হলে কওমি শিক্ষা পুরোপুরি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

গত বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত সংক্রান্ত বৈঠকে কওমি মাদ্রাসা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ‘সরকারের নিয়ন্ত্রণে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কার্যক্রম উন্নয়ন করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। কারণ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। তাই সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে শিক্ষা কার্যক্রমের উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই সিদ্ধান্তের আলোকে কওমি শিক্ষার বিষয়টি আইনের খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।’

প্রসঙ্গত, গত বছরের চূড়ান্ত করা শিক্ষা আইনের খসড়ায় উল্লেখ ছিল, ‘সরকার কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রমের মানোন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’

সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পর্যবেক্ষণে কওমি শিক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে খসড়াটি পরিমার্জনের কথা বলা হয়।

জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কওমি শিক্ষা নিয়ে অনেক রকম মত আছে। কিন্তু অনেক ছেলেমেয়ে যেখানে লেখাপড়া করছে তাদের বাদ দিয়ে শিক্ষা আইন করলে আইনটি অসম্পূর্ণ থাকে। তবে এখনই বেশি বলার সময় আসেনি।’

শিক্ষাবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের সন্তান কোথায় কী লেখাপড়া করছে তা আমাদের জানা দরকার। কওমিসহ দেশের সব শিক্ষা ধারাকে একটি ছাতার নিচে এনে যার যার নিজস্ব স্বাতন্ত্র বজায় রেখে চালাতে হবে। সবাই যেন তা জানে। এই শিক্ষা ধারাকে একটি রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে আসতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তাদের আয়ের উৎস কী, তাদের পাঠ্যক্রম কী, কী শেখাচ্ছেন আমাদের তো জানতে হবে।’

রাশেদা কে চৌধুরী আরও বলেন, ‘এটি তাদের কল্যাণেই করা প্রয়োজন। অধিকাংশ মানুষের মনের মধ্যে তাদের নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। জঙ্গি প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠবে না যদি তারা একটি কাঠামোর মধ্যে থাকে। তারা যদি স্বচ্ছ থাকেন তাহলে প্রশ্ন ওঠবে না। তাদের শিক্ষাক্রমে বেকার তৈরি হচ্ছে। তাই শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাঠামোর মধ্যে থাকা প্রয়োজন, কারণ শিক্ষার্থীরা আমাদের সন্তান।’

২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজত কাণ্ডের ঘটনায় শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা হয়েছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সফল করার লক্ষ্যে। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিবিরোধী আন্দোলন এবং গত বছর মামুনুল হককে গ্রেফতারের ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের দিয়ে সহিংসতা চালানো হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

ওই ঘটনার পর বিভিন্ন মহল থেকে দাবি ওঠে কওমি শিক্ষাকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনার। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জন্মদিন উপলক্ষে গত বছর ৩ মে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত আলোচনা সভায়ও কওমি শিক্ষাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি জানানো হয়।

ওই সভায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর যে শিক্ষা ভাবনা ছিল, তার গঠিত ড. কুদরত-ই-খোদা শিক্ষা কমিশনের যে শিক্ষা আমরা পাই, তার আলোকে ২০১০ সালে আমরা যে শিক্ষানীতি করেছি, তা অনুসরণ করার চেষ্টা আমরা করছি। তার বিপরীতে শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি অংশ বিশেষত কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কওমিদের যে কর্মকাণ্ড সেগুলো সকল আলোচকের মাধ্যমে ওঠে এসেছে। একদিকে দেশটিকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আরেক দিকে একটি চক্র দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। সেই কাজের জন্য বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসাগুলোর শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে।

শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেছিলেন, ‘যেকোনও শিক্ষাই হোক, সেখানে যদি মানবিকতার শিক্ষা না দেওয়া হয়, সমাজ সম্পর্কে শেখানো না হয়, দেশের প্রতি ভালোবাসা শেখানো না হয়, শিক্ষার্থীরা পরমতসহিষ্ণুতা যদি না শেখে, তাহলে তাকে শিক্ষা বলা যায় না। কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কীভাবে চালাবেন— তার চেয়ে বড় হচ্ছে মানবিকতার বিষয়গুলো অবশ্যই থাকতে হবে। ’

কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডাটাবেইজ প্রস্তুত

মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় রাজনীতিতে যুক্ত করা ও সহিংসতায় ব্যবহারের অভিযোগের পর গত বছর ২১ জুন দেশের সব মাদ্রাসা নিবন্ধনের আওতায় আনার জন্য একটি কমিটি গঠন করে সরকার। এরপর কওমি মাদ্রাসাসহ সব ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডাটাবেইজ প্রস্তুত শুরু করা হয়। কওমি, নুরানী, দীনিয়া, ফোরকানিয়া ও ইবদায়িসহ সকল ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ডাটাবেইজও প্রস্তুতও করা হয়।

ডাটাবেইজ অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ১৯ হাজার ১৯৯টি। এর আগে ২০১৫ সালের হিসাবে, সারা দেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। গত পাঁচ বছরে মাদ্রাসার সংখ্যার বাড়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে বলে জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে এর আগে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিলেন, ‘আমরা চাই শিক্ষার মূল ধারায় কওমিসহ সব ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যুক্ত হোক। আর সে কারণেই একটি সমন্বিত নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নীতিমালা তৈরির জন্য ১৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কওমি শিক্ষা নিয়ে প্রশ্নোত্তর সংসদে

গত ২৩ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসাগুলোকে একটি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালনা করা প্রয়োজন। কওমি মাদ্রাসাসহ ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যকরণ এবং সরকারি নিবন্ধনের আওতায় আনার প্রয়োজন রয়েছে। এ লক্ষ্যে সমন্বিত একটি নীতিমালা প্রণয়ন এবং কওমি মাদ্রাসা সংক্রান্ত বর্তমানে আলাদাভাবে পরিচালিত ছয়টি বোর্ডকে সমন্বিত করে একটি কমিটি গঠনের বিষয়টি সরকারের পর্যালোচনাধীন রয়েছে।’

এ জাতীয় আরো সংবাদ

দেশে ফিরেছেন ২৩ হাজার ৫২৬ হাজি

নূর নিউজ

লকডাউনের প্রথম দিনে রাজধানীতে ৭৫৫ জন আটক

আনসারুল হক

চিকিৎসকদের জন্য চ্যালেঞ্জের ২০২০

আনসারুল হক