সুফিয়ান ফারাবী
সারাবিশ্বের সবচে’ আলোচিত বিষয় এই মুহূর্তে ইউক্রেণ-রাসিয়া যুদ্ধ। নানা শঙ্কা আর সংশয় দূরে রেখে দুই পক্ষই যুদ্ধের ময়দানে একে অপরের উপর হামলা করছে। এই যুদ্ধকে অসম যুদ্ধ বলা হলেও এখন পর্যন্ত ময়দানে টিকে আছে ইউক্রেণ। এই অসম যুদ্ধের বিষয়টি উল্লেখ করে বরাবরের মতো রাসিয়ার সমালোচনা করছে মার্কিন ও তার মিত্ররা।
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও জাতিংঘের নিন্দার পাশাপাশি ইউক্রেণকে যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে সহযোগিতাও করছে কয়েকটি দেশ।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে এবার মুসলিম দেশগুলোও নানাভাবে এই যুদ্ধ বন্ধে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্র তাদের আয়োজনে রাসিয়া ও ইউক্রেণের মাধ্যে সমযোতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আজকের এই প্রতিবেনে থাকছে মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর কার কী অবস্থান এই যুদ্ধ নিয়ে?
সৌদি আরব
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) রাশিয়ার নেতা ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপে এ প্রস্তাব দেন তিনি।
এ ছাড়া সৌদি যুবরাজ সংকটের ‘রাজনৈতিক সমাধান’ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এ সময় তিনি তেলের বাজার স্থিতিশীল করতে ওপেক ও রাশিয়াসহ তেল উৎপাদনকারী গোষ্ঠীর প্রতি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
যুবরাজ তেলের বাজারের ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সৌদির আগ্রহের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
এদিকে, বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) ইউক্রেনে হামলা বন্ধ করতে এবং সরাসরি বৈঠকে বসতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আহ্বান জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। একই সঙ্গে কিয়েভকে সামরিক সহায়তা বাড়ানোর জন্য পশ্চিমাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
তুরস্ক
কূটনৈতিক উপায়ে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন বন্ধ করতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে তুরস্ক।
জাতিসংঘের মহাসচিবকে এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ফোন করেছিলেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগ্লু। খবর দ্যা হুরিয়াতের।
ফোনালাপে তিনি দুই পক্ষকে দ্রুত যুদ্ধবিরতিতে রাজি করে সেখানে জরুরি ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা করেন।
এর পর যুদ্ধবিরতি নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও ফোনে কথা বলেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এছাড়া, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী অলেস্কি রেজনিকভের সঙ্গে কথা বলেন তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হুলুসি আকার।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই দুই পক্ষকে শান্ত থাকার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। কারণ, রাশিয়া এবং ইউক্রেন- দুই প্রতিবেশীর সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক তুরস্কের।
এ কারণেই এ যুদ্ধ থামাতে মরিয়া তুরস্ক কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।
পাকিস্তান
ইউক্রেন নিয়ে চলমান উত্তেজনা কমানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই। তবে সহিংসতার দায় রাশিয়ার ওপর চাপানোর বিষয়টি সাবধানতার সঙ্গে এড়িয়ে গেছে তারা।
গত রোববার পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশির সঙ্গে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবার টেলিফোনে কথা হয়। আলাপে যুদ্ধ বন্ধে পাকিস্তানের আহ্বানের বিষয়টি নতুন করে তুলে ধরেছেন কোরেশি। এ ছাড়া এ ইস্যুতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে একাধিক বিবৃতি এসেছে।
রাশিয়া–ইউক্রেন সংকট নিয়ে পাকিস্তানের দেওয়া নানা বিবৃতির যে ভাষা, তার মিল রয়েছে সম্প্রতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভোটাভুটিতে ভারতের অবস্থান এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আলাপচারিতার সঙ্গে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে গত রোববার কথা বলেন নরেন্দ্র মোদি। সেখানে তিনি ইউক্রেনে ‘সহিংসতা’ বন্ধের প্রয়োনীয়তা তুলে ধরেন। তবে এর দায় রাশিয়ার ওপর চাপানোর বিষয়টি এড়িয়ে যান। দুদেশের শীর্ষস্থানীয় নেতার আলাপের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ‘অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধে ও সংলাপে ফিরতে তিনি (মোদি) আবারও আহ্বান জানিয়েছেন এবং শান্তি ফিরিয়ে আনতে যেকোনো প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে ভারতের সদিচ্ছা প্রকাশ করেছেন।’
এর দুদিন আগেই ইউক্রেনে পুরোদমে হামলা শুরু করে রাশিয়া। সে সময় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও একই সুরে কথা বলেছিলেন মোদি। ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার সেনা প্রত্যাহারে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আনা খসড়া প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকেও বিরত ছিল ভারত।
এদিকে চলমান সংকটের মধ্যে রাশিয়া সফরে যান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। সেখানে গ্যাস পাইপলাইনের একটি প্রকল্প নিয়ে পুতিনের সঙ্গে আলোচনা হয় তাঁর। পাশাপাশি আফগানিস্তানসহ আঞ্চলিক নানা বিষয়ে কথা বলেন তিনি।
পুতিন-ইমরান বৈঠকের পর একটি বিবৃতি প্রকাশ করে মস্কো। বিবৃতিতে ইউক্রেন সংকটের বিষয়টি পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। পাকিস্তানও রুশ হামলার বিষয়টি সামনে আনতে বেশ সতর্কভাবে এগিয়েছে। ইউক্রেনের বর্তমান পরিস্থিতিকে শুধু ‘দুঃখজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছে দেশটি।
এ বিষয়ে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়, ‘সংঘর্ষে কারও স্বার্থ নেই বলে জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আর সংঘর্ষ বাধলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপরে সব সময় বড় অর্থনৈতিক ধাক্কা আসে। সংলাপ ও কূটনীতির মাধ্যমে বিবাদের সমাধানে পাকিস্তান বিশ্বাসী।’
বাংলাদেশ
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হামলা বন্ধ ও সেখান থেকে রুশ সেনাদের সরিয়ে নিতে বুধবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সমর্থনে একটি প্রস্তাব পাস হলেও, ওই প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল বাংলাদেশ।
ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ডাকা জরুরি অধিবেশনে পাস হওয়া ওই প্রস্তাবে ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে ১৪১টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।
নিউইয়র্কের একটি কূটনৈতিক সূত্র এই সংবাদদাতাকে জানান, এই প্রস্তাবের পক্ষে ভারত, পাকিস্তান ও চীনসহ ৩৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল।
এদিকে এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় রাশিয়াসহ বেলারুশ, ইরিত্রিয়া, উত্তর কোরিয়া ও সিরিয়া।