রেশমশিল্পে মুসলমানদের অবদান

ইতিহাসের বিখ্যাত সিল্ক রোডের কথা কে-ই বা শোনেনি? খ্রিস্টপূর্ব ১৩০ অব্দে চীনের হান রাজবংশ এই বাণিজ্যপথের সূচনা করে এবং ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল।

ছয় হাজার চার শ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথ যুক্ত করেছিল এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাকে। ঐতিহাসিক এই বাণিজ্যপথের নামকরণ থেকেই প্রাচীন বাণিজ্যে রেশম বা সিল্কের গুরুত্ব অনুভব করা যায়। যুগ যুগ ধরে রেশম আভিজাত্যের প্রতীক। রাজপরিবার ও অভিজাত শ্রেণিই ছিল তার প্রধান ব্যবহারকারী।

রেশম কেন জনপ্রিয় : প্রাচীনকাল থেকে এখন পর্যন্ত রেশম জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলো, তা তুলা বা অন্যান্য উপকরণের তুলনায় ‘রঞ্জক’ শোষণ করে। ফলে নিখুঁত রং প্রকাশ পায়। রেশম অগ্নি প্রতিরোধ। রেশমের কাপড়ে আগুন দিলে তা নিজ থেকে নিভে যায়। অন্যদিকে রেশম সুতা অনেক বেশি মজবুত। একই ব্যাসের একটি স্পাতের চেয়ে রেশম বেশি শক্তিশালী।

রেশম শিল্পের বিকাশ : খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার থেকে তিন হাজার অব্দে চীনে রেশম উৎপাদন শুরু হয়। তবে হাজার বছর ধরে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের কাছে একটি রহস্যই হয়ে ছিল। তিন শ খ্রিস্টাব্দে জাপান রেশম উৎপাদনে সক্ষম হয় এবং ৫২২ খ্রিস্টাব্দে বাইজান্টাইনরা কিছু রেশম পোকা সংগ্রহে সক্ষম হয় এবং বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে রেশম উৎপাদন শুরু হয়। সে সময় স্পেনসহ ভূমধ্য সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে রেশম চাষ শুরু করে। তবে তার প্রধান কেন্দ্র ছিল রাজধানী শহর। চীনা রূপকথা অনুসারে রাজকুমারী সি লিংশি তুতগাছের নিচে বসে গরম চা খাচ্ছিলেন। আর তখন গাছ থেকে একটি রেশম পোকার বাসা তার চায়ের মধ্যে পড়ে এবং সুতা ছাড়তে শুরু করে। এরপর রাজকুমারী তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে।

মুসলিম বিশ্বে রেশমশিল্প : ৬২২ খ্রিস্টাব্দে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুসলিমরাও রেশম উৎপাদনের কৌশল লাভ করে। বিশেষত রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল মুসলিম শাসনাধীন হওয়ার পর মুসলিমরা এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। মুসলিম শাসকরা সিল্কশিল্পের আধুনিকায়ন করেন এবং স্পেন, পারস্য, ভারত ও বৃহৎ তুর্কি অঞ্চলসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তা ছড়িয়ে দেন। প্রাচীনকাল থেকে মুসলিমসমাজে রেশমের বহুল ব্যবহার দেখা যায়। বর্তমানে পবিত্র কাবার গিলাফও রেশম কাপড় দিয়ে তৈরি হয়।

মুসলিমবিশ্বের বিখ্যাত রেশমকেন্দ্র

মুসলিম শাসকদের মাধ্যমে যেসব অঞ্চলে রেশমশিল্পের বিকাশ ঘটে এবং যেসব অঞ্চল রেশমশিল্পের প্রধান প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়, তার কয়েকটি নিম্নে তুলে ধরা হলো।

১. আন্দালুস : আল-আন্দালুস বা মুসলিম স্পেনে রেশমশিল্পের উত্থান ঘটে সবচেয়ে দ্রুত। কেননা রোমান সাম্রাজ্যের অধীন থাকায় এই অঞ্চলে পূর্ব থেকেই সীমিত পরিসরে রেশমের উৎপাদন ছিল। ৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম বাহিনী স্পেন জয় করে। কিন্তু তারও দুই শ বছর আগে থেকে স্পেনে ‘তিরাজ’ নামক বিশেষ তাঁত ছিল। মুসলিম সেই তাঁতশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ফলে কর্ডোভা, গ্রানাডা, মালাগা ও আলমেরিয়াতে রেশম উৎপাদন শুরু হয়। ৯৬১ খ্রিস্টাব্দে কর্ডোভা মসজিদসংলগ্ন এলাকায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রথম রেশম কারখানা স্থাপন করেন দ্বিতীয় আবদুর রহমান। মুসলিমরা উন্নতমানের একটি আনুভৌমিক তাঁত আবিষ্কার করে। ফলে তাঁতিরা উন্নতমানের উৎপাদনে সক্ষম হয়। স্পেনের দক্ষ কারিগররা উন্নতমানের রেশমি পোশাক ও মনোমুগ্ধকর নকশা করত। যার বিশেষ কদর ছিল ইউরোপ ও মুসলিম বিশ্বের রাজা-বাদশাহদের দরবারে। স্পেনে আগত বিদেশি অতিথি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদেরও রেশম উপহার দেওয়া হতো। খোলা বাজারে রেশম বিক্রির আগে ‘আল-হোন্দিগাসে’ (পণ্য যাচাই ও সংরক্ষণ কেন্দ্র) তার মান যাচাই করা হতো। গ্রানাডার রেশমের মূল্য ছিল সবচেয়ে বেশি। জেনোজ ব্যবসায়ীরা মুসলিম স্পেনের রেশম সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে দেয়।

২. কায়রো : মামলুক রাজবংশ যখন মিসর ও সিরিয়া (১২৫০-১৫১৭ খ্রি.) শাসন করত, তখন তারা মোঙ্গলদের পরাজিত করে। এ সময় ইরান ও ইরাক থেকে সিল্কশিল্পের বহু দক্ষ ও অভিজ্ঞ কারিগর কায়রোতে পালিয়ে আসে। মামলুকদের সহযোগিতায় মধ্যযুগের সবচেয়ে বড় সিল্কশিল্প গড়ে ওঠে মিসরে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে সিল্কের ব্যবহারও তখন শুরু হয়। যেমন অফিস ও পদবি চিহ্নিত করা, রাজ দরবারের প্রত্যেক সদস্যের পেছনে রেশমের কাপড় ঝুলিয়ে রাখা ইত্যাদি। কারো পদোন্নতি হলে তাকে সিল্কের পোশাকের একটি পূর্ণাঙ্গ সেট দেওয়া হতো। যার মধ্যে মাথার টুপি থেকে পায়ের চপ্পল পর্যন্ত থাকত। খ্রিস্টীয় ১৩ শতকে রেশমের বিশেষ ধরনের টুপির প্রচলন হয়। যাতে খলিফার উদ্ধৃতি ও শিকার প্রাণীর অঙ্কিত থাকত। সিরিয়ার দামেস্ক থেকে সবচেয়ে বেশি সিল্ক ইউরোপে যেত। ইরাকের মাসুলে বিশেষ ধরনের সিল্ক আবিষ্কার করেন, যাকে মাসুলের সঙ্গে মিলিয়ে মসলিন বলা হয়।

৩. কাসান : সাফাভিদ শাসনকালকে পারস্যের সিল্কশিল্পের স্বর্ণযুগ মনে করা হয়। ফরাসি পরিব্রাজক টাভেরনিয়ার উল্লেখ করেছেন, ‘সাফাভিদ ইরানে অন্য যেকোনো শিল্পের চেয়ে মানুষ রেশমশিল্পের সঙ্গে বেশি যুক্ত ছিল। ’ স্যার জন চার্ডিনের বর্ণনা মতে, শুধু কাসান শহরের ‘শ্রমিক নিবাসে’ এক হাজার রেশমকর্মীর ঘর ছিল। মূলত সাফাভিদ আমলেই পারস্যবাসী রেশমশিল্পে তাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেয়েছিল। প্রথম শাহ আব্বাসের দূরদর্শী নেতৃত্বে রাজধানী ইস্পাহান রেশমশিল্পের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। এ ছাড়া রাজকীয় নির্দেশে ইয়াজদ ও কাসানে অসংখ্য রেশম কারখানা গড়ে ওঠে। পরিব্রাজক চার্ডিন আরো উল্লেখ করেন, ‘পারস্যের রেশমশিল্পীরা স্বর্ণ ও রৌপ্যের সুতায় এমব্রয়ডারি করত। এর নকশাগুলোও ছিল চিত্তাকর্ষক, ব্যতিক্রম ও সৃজশীল। ’ ইরানি রেশমের কদর তখন এত বেড়েছিল যে ডেনমার্কের রাজপ্রাসাদের একটি পুরো কক্ষ রেশম দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছিল। শাহ আব্বাসের সময় ইউরোপে রেশমের তৈরি পোশাকের পাশাপাশি কাঁচামালও রপ্তানি হতো। খ্রিস্টীয় ১৬ শতকে স্বাক্ষরসংবলিত রেশমের প্রচলন ঘটে।

৪. মুর্শিদাবাদ : মোগল আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে সিল্কে বা রেশমের ব্যাপক প্রচলন ঘটে। রেশমি কাপড়ে তৈরি শামিয়ানা ছিল মোগল রাজ দরবারের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এমনকি মোগল সম্রাটরা ভ্রমণে বের হলেও রেশমের শামিয়ানা তাদের সঙ্গী হতো। মোগলরা রেশম পোশাক ও কাপড় প্রধানত আমদানি করত। তবে দিল্লি, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, গুজরাটসহ মোগল ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রে রেশম উৎপাদন হতো। মোগল সম্রাটদের উদ্ভাবিত রেশমের মধ্যে চান্দেরি ছিল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়।

৫. বুরসা : রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে উসমানীয়রা রেশমশিল্পের জ্ঞান লাভ করেছিল। তার পরও উসমানীয় শাসকরা বাণিজ্যিক খাত হিসেবে রেশমশিল্পকে গুরুত্ব দিত। রাজপরিবারেও এর বিশেষ মূল্যায়ন ছিল। এমনকি তোপকাপি রাজপ্রাসাদে রেশম গবেষণার জন্য স্বতন্ত্র সেল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তুর্কি রেশমের প্রধান গ্রাহক ছিল ইউরোপ। তুরস্ক ও পারস্যে উৎপাদিত রেশম বুরসা হয়ে ইউরোপে যেত এবং রাষ্ট্রীয়ভাবেই তার মান নিয়ন্ত্রণ করা হতো।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

খালেদা জিয়াকে বিদেশে যেতে দিতে প্রধানমন্ত্রীকে জাতিসংঘের চিঠি

নূর নিউজ

ইউপিতে বিজেপি হারতে যাচ্ছে, অখিলেশ যাদব

নূর নিউজ

যুদ্ধের ‘দ্বিতীয় পর্ব’ ঘোষণা নেতানিয়াহুর

নূর নিউজ