টালমাটাল রাজনীতি। বাতাসে নানা গুঞ্জন। কী হচ্ছে, কী হবে এমন প্রশ্নের সহজ উত্তরও কারও কাছে নেই। জাতীয় নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস বাকি। এখনো নির্বাচন আয়োজনের পদ্ধতি নিয়ে টানাপড়েন চলছে। সরকার বলছে সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই নির্বাচন হবে। বিএনপিসহ প্রায় সব বিরোধী দলের দাবি প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। সংসদ ভেঙে দিতে হবে। নির্দলীয় সরকার গঠন করে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে।
দুই পক্ষের এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মধ্যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সোচ্চার পশ্চিমা দেশগুলো। তারা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের কথাও বলছেন।
নির্বাচনের আগে বিরোধীদের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা এবং সংঘাত সহিংসতামুক্ত পরিবেশ প্রত্যাশা তাদের। এসব দেশের দূতেরা বিরামহীন চেষ্টা চালাচ্ছেন তাদের অবস্থানের পক্ষে। সর্বশেষ অনেকটা কড়া বিবৃতি এসেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় থেকে। এমন অবস্থায় বলা হচ্ছে সরকার বিরোধীদের চেয়ে বিদেশিদের চাপ অনুভব করছে বেশি। সামনে নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে এলে এই চাপ আরও বাড়বে। ঘরে বাইরে চাপ বাড়লে কী করবে সরকার? এই প্রশ্ন এখন সবার সামনে।
সরকার সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, যতো চাপই আসুক সরকার সংবিধান অনুযায়ী একটি নির্বাচন আয়োজনের পথেই হাঁটবে। সেখানে বিএনপি অংশ না নিলে বেশিসংখ্যক দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হবে। সরকারের একটি ঊর্ধ্বতন সূত্র সম্প্রতি মন্তব্য করে, বিদেশিরা এখন আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছে না। সব দল অংশ না নিলেও নির্বাচন অবৈধ হবে না। একান্তই যদি এই চেষ্টা ব্যর্থ হয় তাহলে সরকারের সামনে আর কি বিকল্প আসতে পারে এমন আলোচনাও আছে রাজনৈতিক মহলে। বলা হচ্ছে, তখন কি সরকার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসবে। প্রধানমন্ত্রী কি প্রেসিডেন্ট হয়ে যেতে পারেন? তখন হয়তো নির্বাচন আয়োজনের বিকল্প পথ বের হতে পারে। রাজনৈতিক মহলে শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও সরকারি দলের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এমন কোনো ইঙ্গিত মিলছে না। সম্প্রতি একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মন্তব্য করেন, যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হলে জরুরি অবস্থা জারি হতে পারে।
উল্লেখ করা যায় যে, স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয় হিসেবেই দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পরপরই ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হন। তার অবর্তমানে ১০ই এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করা হয়। মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত ওই সরকারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। তবে তার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু ১২ই জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ওইদিনই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই দায়িত্বে তিনি ছিলেন ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি পর্যন্ত। ওইদিনই বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবার দায়িত্ব নেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে সপরিবারে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুতে সপরিবারে হত্যার পর প্রেসিডেন্ট শাসিত শাসন ব্যবস্থাই বলবৎ ছিল। মাঝে বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে প্রেসিডেন্ট হন জিয়াউর রহমান।
জিয়াউর রহমান আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট হন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ তাকে হটিয়ে ক্ষমতা দখন করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পরের বছরের ১১ই ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন। ১১ই ডিসেম্বর তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। ৮৬ সালে জাতীয় পার্টি গঠন করে তিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর গণআন্দোলনে পতনের আগ পর্যন্ত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন। এরশাদের পতনের পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন ১৯৯১ সালের ৯ই অক্টোবর পর্যন্ত। ১৯৯১ সালের ২০শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ সময় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। এরপর থেকে দেশে আর প্রেসিডেন্ট শাসিত ব্যবস্থা ফিরে আসেনি।
বিরোধীদের আন্দোলন কৌশল নিয়েও চলছে নানা গুঞ্জন। আগস্টের শুরুতে সিরিজ কর্মসূচির বিষয়টি আলোচনায় ছিল। সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচির খবরও বেরিয়েছিল। এখন আবার বলা হচ্ছে, এ মাসের মাঝামাঝি বা শেষদিকে আন্দোলন কর্মসূচি পুরোমাত্রায় জোরদার হতে পারে। জামায়াতের ভূমিকা নিয়েও চলছে আলোচনা। একটি সূত্র বলছে, জামায়াতের সঙ্গে শাসকদলের বোঝাপড়ার আলোচনা ভেস্তে গেছে। কানাডার আদালতের একটি রায় নিয়েও তৈরি হয়েছিল নানা গুজব। স্যাংশন নিয়ে গুজবের তো শেষ নেই। ফেসবুক খুললেই দেখা যায় নানা নাম। কোনটি যে গুজব আর কোনটি সত্য বুঝা সত্যিই দুষ্কর।
সূত্রঃ মানবজমিন