আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ রহ. এর জীবন ও কর্ম

আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ রহ.। বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির আলেমদের একজন। তিনি এক বর্ণাঢ্য ও সমৃদ্ধ জীবনের অধিকারী। দাওয়াত-তাবলিগ, ওয়াজ-নসিহত, সমাজ সংস্কার, শিক্ষকতা, রচনা ইত্যাদি বিষয়ে সরব পদচারণা ছিল তাঁর। এখানে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের সামান্যকিছু তুলে ধরা হয়েছে।

জন্ম:
আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ রহ. ১৯৪৭ সালের ২ জানুয়ারি তাঁর মরহুম পিতার তৎকালীন বাসস্থান কিশোরগঞ্জের শহীদী মসজিদ সংলগ্ন বাসায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হযরত মাওলানা আতহার আলী (রহ.) ছিলেন হযরত হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী (রহ.) এর বিশিষ্ট খলিফা। উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেম এবং রাজনীতিবিদ মাওলানা আতহার আলী (রহ.) আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়া ও শহীদী মসজিদসহ অসংখ্য মসজিদ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এছাড়া তিনি নেজামে ইসলাম পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং তৎকালীন পাকিস্তানের গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন।

প্রাথমিক শিক্ষা:
মরহুম পিতার নিকটেই হাতেখড়ি নেন আযহার আলী আনোয়ার শাহ। এছাড়া পিতার বিশিষ্ট খলিফা হযরত মাওলানা ক্বারী নিছার আলী (রহ.) এর নিকট তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভের সুযোগ পান। প্রাথমিক বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন সুপণ্ডিত মাস্টার আব্দুর রশিদ (রহ.) এর নিকট।

কুরআন হিফজ:
আযহার আলী আনোয়ার শাহ প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর পিতার প্রতিষ্ঠিত আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ায় কালামে পাক হিফজ শুরু করেন। ১৯৬১ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাত্র দেড় বছরে তিনি হেফজ সমাপ্ত করেন। তাঁর হেফজ এর ওস্তাদ ছিলেন হযরত মাওলানা হাফেজ নুরুল ইসলাম (রহ.)।

মাধ্যমিক শিক্ষা:
আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়াতেই আযহার আলী আনোয়ার শাহর মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু হয়। এ সময় তিনি ইসলামি উলুমের সর্ব বিষয়ের সুপণ্ডিত বহু গ্রন্থের প্রণেতা বিশিষ্ট লেখক ও সাহিত্যিক সায়্যিদ আব্দুল আহাদ কাসেমি (রহ.) এর সান্নিধ্য লাভ করেন। কাশেমি (রহ.) এর সরাসরি তত্বাবধানে তিনি এক বছরে একাধিক জামাত (ক্লাস) সমাপ্ত করতে সক্ষম হন।

প্রখর মেধা ধী-শক্তি এবং প্রচণ্ড স্মরণ শক্তির অধিকারী হওয়ায় আনোয়ার শাহ মাত্র দুই বছরেই ১৯৬৪ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।

উচ্চ শিক্ষা:
উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশে আযহার আলী আনোয়ার শাহ তাঁর পিতার নির্দেশে চলে যান পাকিস্তানের করাচিতে। সেখানের বিশ্বখ্যাত বিদ্যাপীঠ ‘জামিয়া আরাবিয়া ইসলামিয়া নিউটাউন’ এ ১৯৬৪ সালে তিনি ভর্তি হন। সেখানে তিনি ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। অর্জন করেন হাদীস ও তাফসির বিষয়ে বিশেষ পাণ্ডিত্য ও দক্ষতা।

সেখান থেকে তিনি ফেফাকুল মাদারিস (পাকিস্তান মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড) এর অধীন গৃহীত দাওরায়ে হাদীস (তাকমিল) এর কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। সে সময় হাদীস বিষয়ে তাঁর ওস্তাদ ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ আন্তর্জাতিক ইলমি ব্যক্তিত্ব আল্লামা ইউসুফ বিন্নুবী (রহ.), আল্লামা ওয়ালী হাসান টুংকি (রহ.) ও ইদরীস মিঠারি (রহ.) প্রমুখ। ইলমে তাফসিরে তাঁর ওস্তাদ ছিলেন হাফিজুল হাদীস আল্লামা আবদুল্লাহ দরখাস্তী (রহ.)।

এছাড়া সেখানে প্রেরিত মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন খ্যাতিসম্পন্ন ওস্তাদের কাছে আযহার আলী আনোয়ার শাহ ১৯৬৬ সালে আরবি সাহিত্য ও তাজবিদুল কুরআন শিক্ষা লাভ করেন। ইলমে ক্বেরাত ও তাজবিদে তাঁর ওস্তাদ হলেন কারী আতা সোলাইমান রিযক্ব আল মিশরী (রহ.) ও ইররাহিম আবদুল্লাহ (রহ.)।

খেলাফত লাভ:
শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি আত্মশুদ্ধির লক্ষ্যে বাইয়াত হন হাকিমুল উম্মত হযরত থানভী (রহ.) এর বিশিষ্ট খলিফা মুহিউস্সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.) এর হাতে। দীর্ঘ সাধনার পর তিনি তাঁর নিকট থেকে খেলাফত লাভ করেন।

এছাড়াও তিনি খেলাফত লাভ করেন হযরত জাফর আহমদ উসমানী (রহ.) এর খলিফা কটিয়াদীর হযরত খাজা শামছুল হক (রহ.), হযরত আতহার আলী (রহ.) ’র খলিফা সিলেটের হযরত মাওলানা আবদুল মান্নান (রহ.) ও হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াহার (রহ.) এর খলিফা ময়মনসিংহের হযরত মাওলানা ফয়জুর রহমান (রহ.) এর নিকট থেকে।

কর্মজীবন:
শিক্ষা জীবন শেষ করে ১৯৬৮ সালে তিনি সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ায় যোগ দেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জামিয়া ইমদাদিয়া বন্ধ হয়ে গেলে নবীজীর (সা.) সুন্নাত অনুযায়ী কিছুদিন তিনি কাপড়ের ব্যবসা করেন।

১৯৭৫ থেকে ৭৬ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহের জামিয়া ইসলামিয়ায় মুহাদ্দিস ও নাযেমে তালিমাত (শিক্ষা সচিব) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে জামিয়া ইমদাদিয়া আবার চালু হলে তিনি ১৯৭৭ সালে সেখানে আবার মুহাদ্দিস হিসেবে যোগ দেন।

আযহার আলী আনোয়ার শাহ ১৯৭৯ সালে আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ায় ভাইসপ্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব নেন। জামিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা আহমদ আলী খান (রহ.) স্বাস্থ্যগত কারণে দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করলে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে কিছুদিন আল্লামা আনোয়ার শাহ প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৩ সালে জামিয়ার মজলিসে শুরার সিদ্ধান্তে তিনি প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি জামিয়া ইমদাদিয়ার প্রিন্সিপাল ও মহাপরিচালক হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তাঁর দায়িত্বকালে আল-জামিয়াতুল ইমদাদিয়াকে শিক্ষা-দীক্ষা ও অবকাঠামোর দিক থেকে উন্নতির চরম শিখড়ে নিয়ে যান। জামিয়া ইমদাদিয়াকে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় (কওমী) প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

আযহার আলী আনোয়ার শাহ শহীদী মসজিদের মুতাওয়াল্লী, ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কিশোরগঞ্জ ইমাম উলামা পরিষদ এর সভাপতি ছিলেন।

এছাড়াও নুরুল উলুম কুলিয়ারচর মাদরাসা, জামিয়া ইসলামিয়া গাইলকাটা মাদরাসায় দীর্ঘদিন তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহের অনেক মাদরাসার পরিচালনা কমিটির সভাপতিসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।

আযহার আলী আনোয়ার শাহ ইসলামী আন্দোলনের যোগ্য কর্মী তৈরির লক্ষ্যে যেমনি দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারে কাজ করেছেন, তেমনি অসহায় দরিদ্র ও দুর্যোগপূর্ণ মানুষের পাশে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন।

ইন্তিকাল:
দেশবরেণ্য আলেম কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শহীদী মসজিদের খতিব আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ ৭৩ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ২০২০ সনের ২৯ জানুয়ারি, বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

জানাজা ও দাফন:
বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) দুপুর ২টায় কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে জানাজা শেষে পার্শ্ববর্তী বাগেজান্নাত কবরস্থানের পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে দেশবরেণ্য আলেম আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ-কে দাফন করা হয়।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

শিশুর খৎনা করানো হয় কেন?

নূর নিউজ

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় হজযাত্রীরা যা করবেন

নূর নিউজ

ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে জাকাতের টাকা দেওয়া যাবে?

নূর নিউজ