আল্লামা শিব্বির আহমদ রহ.: জীবন ও কর্ম

ইমামুন্ নাহবি ওয়াস্ সারফি
আল্লামা শিব্বির আহমদ রহ. : জীবন ও কর্ম

সমকালকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ব্রত নিয়ে যারা পথ চলেন, তাদের হাতে বিনির্মিত হয় ভবিষ্যৎ-আগামী দিনের কর্মপন্থা। উম্মাহের জন্য দিলের দরদ ও তড়পান যারা লালন করেন, আপন বিভায় তারা পথ দেখান মানুষকে ঐতিহ্যবিস্মৃত জাতিকে। তারা হয়ে ওঠেন মানুষের আস্থা ও ভরসার প্রতিক। হয়ে ওঠেন ভালোবাসা ও স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের ইমাম আল্লামা শিব্বির আহমদ হাফি.এর জীবনও তেমনি বৈচিত্রময়। মুহিউস সুন্নাহ আব্দুল হালিম রহ. ও হাফেজ্জী হুজুর রহ. কর্তৃক প্রাপ্ত ওয়ারাসাত তিনি দু’হাতে বিলিয়েছেন আজীবন।

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে যার আলোক ইতোমধ্যে পৌঁছে গিয়েছে ভিনমুলুকেও। তালিম-তাবলীগ-তাযকিয়া’র প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই মনীষির রয়েছে অসামান্য অবদান। যাঁর তাজদীদি ফিকির ইলমি মহলে স্বীকৃত হয়েছে বহু আগেই। পেয়েছেন ইমামের খেতাব ‘ইমামুন্ নাহবি ওয়াস্ সারফি’।

অর্জন করেছেন বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড (বেফাক) এর প্রধানতম প্রশিক্ষক হওয়ার গৌরব। সর্বশেষ লাভ করেছেন পীর যুলফিকার আহমদ নকশবন্দী হাফি. এর খেলাফতও।

জন্ম ও জন্মস্থান
পঞ্চাশের দশক, অর্থাৎ ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ সাল। দক্ষিণ মহতাপুর রিয়াজুদ্দীন পাটওয়ারী বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পরদাদা রিয়াজুদ্দীন পাটওয়ারীর দ্বিতীয় ছেলে নোয়াব আলী পাটওয়ারী। তারই সর্বকনিষ্ঠ ছেলে মাও. আব্দুল লতিফ রহ. এর ঔরশে জন্মগ্রহণ করেন ক্ষণজন্মা এই মহান মনীষী। বাবা তার প্রিয় উস্তায আল্লামা শাব্বির আহমদ ওসমানী রহ. এর নামেই নাম রাখেন প্রীয় সন্তানের। কালের পরিক্রমায় সে সন্তান এখন ‘শিব্বির আহমদ’ নামেই অধিক পরিচিত। মাও. আব্দুল লতিফ রহ. ছিলেন উপমহাদেশের শীর্ষ বিদ্যপিঠ দারুল উলূম দেওবন্দের সূর্যসন্তান। তারও আগে তিনি অধ্যয়নরত ছিলেন চৌমুহনী ইসলামিয়া আরাবিয়া মাদরাসায়। সেখানে অধ্যয়নকালেই তিনি দাম্পত্যজীবনে পা রাখেন। মাওলানা ইদ্রিস রহ. যিনি শাইখুল হিন্দ রহ. এর ছাত্র ছিলেন এর একমাত্র মেয়ে মুহতারামা নূরুন্নেছা বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এর কিছুদিন পরেই নতুন স্ত্রী রেখে তিনি দেওবন্দে পা বাড়ান। সেখান থেকে ফিরে তিনি সংসারজীবনে মনোযোগী হন এবং তিন ছেলে ও দুই মেয়ের জনক হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তম্মধ্যে আল্লামা শিব্বির আহমদ হাফি. হলেন ভাইদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ।

শৈশব ও শিক্ষাজীবনের সূচনা
মা-বাবার নিবিড় পরিচর্যা ও সহোদরদের আহ্লাদে বেড়ে উঠছিলেন শিশু শিব্বির। বয়স বাড়ে। বড় হতে থাকেন তিনি। একদিন ছয় কি সাত বছর বয়সে পাড়ি জমালেন নদীর ওপাড়ে। কলাকোপা মাদরাসার উদ্দেশে। বাড়ির দখিনে তখন প্রমত্ত ভুলুয়া। মৌলভীটোলা ঘাট থেকে নৌকায় যেতে হবে চরবসুসংলগ্ন চিত্রাখালি ঘাট। সেখান থেকে চার মাইল পায়ে হেঁটে কলাকোপা মাদরাসা। যেটির প্রতিষ্ঠাতা-মুহতামিম তাঁর বড় মামা আল্লামা সাঈদুল হক রহ.। সেখানে কর্মরত আছেন তাঁর বাবাও। জামাতে চাহারুমে অধ্যয়নরত ছিলেন তার বড় ভাই মাও. নজির আহমদ। যিনি পরবর্তীতে কলাকোপা মাদরাসার শাইখুল হাদিস হওয়ার মর্যাদা লাভ করেন। ছোট্ট শিব্বির ভর্তি হন মক্তবে। কুরআন পড়েন তাঁর মেঝো মামা মাওলানা সাখাওয়াতুল্লাহ সাহেবের কাছে। সাথী হিসেবে আছেন মেঝো ভাই সুলতান আহমদও। মক্তবের পাঠ দু’ভাই একই সাথে শেষ করলেও কিতাববিভাগে আর একত্রে থাকা হলো না। মেঝো ভাই এক জামাত উপরে উঠলেও ছোটভাই শিব্বির ওঠেন দু’জামাত উপরে। ফলে বড় ভাই থেকে তিনি এগিয়ে রইলেন একটি বছর।

সংগ্রামমুখর জীবনের ইতিবৃত্ত
এগিয়ে যাচ্ছে বছর; এগিয়ে যাচ্ছেন তিনিও। শিক্ষাসফরের একেকটি সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে যাচ্ছেন অন্যটিতে। যেখানে কোনো ক্লান্তি নেই; বিশ্রাম নেই। আছে শুধু প্রথম স্থান অধিকারের গর্ব। এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সমৃদ্ধ হচ্ছেন উলূমে নববিয়্যার নিমগ্নপাঠে। ত্রিশ টাকা বেতনের চাকুরি করেন তাঁর বাবা। সংসারখরচের পাশাপাশি তিন ভাইয়ের পড়াশোনার ব্যয়ভার নিতান্তই কষ্টসাধ্য ছিলো। জায়গিরের ব্যবস্থা হলো চর জাঙ্গালিয়া ‘হালিমার বাপের বাড়ি’তে। দীর্ঘ ছয়টি বছর সেখানে থেকে চালিয়ে গিয়েছেন আপন পড়াশোনা। এরপরে আরও দু’জায়গায় তিনি জায়গির থাকেন। জারিরদোনা চরসেকান্তরে দু’বছর এবং সর্বশেষ গাঁদাটোলা তিন বছর। এভাবেই তিনি উন্নীত হন ফযিলত শিক্ষাবর্ষে। দীর্ঘ এ শিক্ষাজীবনে তিনি ভালো কোনো পোশাক পরতে পারেননি। বড় ভাইয়ের পুরাতন জামাই পরতেন। ব্যবহারের একমাত্র ছাতাটাও বাবা তৈরি করে দিয়েছেন পুরাতন জামা কেটেকুটে। এতে তাঁর কোনো অভিযোগ ছিলো না; ছিলো না কোনো আক্ষেপও। ইলমের পিপাসায় তৃষ্ণার্তজনের কাছে দুনিয়ার মোহ এভাবেই তুচ্ছ হয়। একদিন সেই দুনিয়া এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাদেরই পদযুগলে।

তাকমীল ও শিক্ষাবর্ষের পরিসমাপ্তি
শিক্ষাজীবনের শেষবর্ষে তিনি জায়গির থেকে বোর্ডিয়ে ফিরলেন। মনোযোগী হলেন সিহাহ সিত্তার দরসে। বুখারী শরিফের পাঠ নিলেন আপন বড় মামা আল্লামা সাঈদুল হক রহ. এর কাছে। মাওলানা শেখ আহমদ সাহেবের কাছে পড়লেন মুসলিম শরিফ। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য আসাতেযা হলেন মুফতি আব্দুল কাদের রহ., মাও. আব্দুল লতিফ রহ., মাও. আব্দুর রশিদ রহ. ও মাওলানা নজির আহমদ রহ. প্রমুখ। শেষ হলো জীবনের একটি অধ্যায়। ফেরার সময় আসাতেযায়ে কেরাম সনদে লিখে দিলেনÑ যার বাংলা অনুবাদ হলো ‘তিনি হাদিস ও তাফসিরশাস্ত্র তাহকীক ও ইয়াকীনের সাথে পড়াতে সক্ষম।’

বৈবাহিক জীবন ও সন্তানাদি
ইচ্ছে ছিলো, তাকমিল সমাপ্ত করে ভারত বা পাকিস্তান পাড়ি জমাবেন। দু’এক বছর উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করে দেশে ফিরবেন। কিন্তু বাধ সাধলেন তাঁর বাবা। সন্তানের বয়স হয়েছে। বিয়ে দিতে হবে। না-রাজির মধ্যেই কেটে গেলো আট মাস। অবশেষে ¯প্রীয় উস্তায মাওলানা খাজা আহমদ রহ. এর মেয়েই তাঁর জীবনসঙ্গীনি হয়ে এলেন। দীর্ঘ সংসারজীবনে তিনি অর্জন করলেন তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক হওয়ার গৌরব। যাদের প্রত্যেকেই আপন অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে মাও. ফারুক আহমদ রাজধানী ঢাকায় একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। মেঝো ছেলে মাও. সিদ্দিক আহমদ নোমান হাফি.। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘জামিয়া মাদানিয়া নোয়াখালি’র সুনাম ইতোমধ্যে সুবিদিত। ছোট ছেলে মাও. মোহাম্মদ হাফি.। তিনি নায়েবে মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাবার প্রতিষ্ঠিত ‘মারকাযুল উলূম মাদরাসা’য়। একমাত্র মেয়ের জামাতা মাও. আবুল কালাম হাফি.। যিনি ছাত্রদের কাছে ‘আদিব সাহেব হুজুর’ নামেই প্রসিদ্ধ। বর্তমানে তিনি দারুল উলূমের ‘নাযেমে তালিমাতে’র দায়িত্বও দক্ষতার সাথে পালন করে চলেছেন।

কর্মজীবনের সূচনা
বিভিন্ন উলূমে বুৎপত্তি অর্জন করে প্রতিষ্ঠান থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নিয়েছেন। দীর্ঘ এ শিক্ষাজীবনে বাবার পাশাপাশি মুরুব্বী হিসেবে মান্য করেছেন বড় মামা আল্লামা সাঈদুল হক রহ.কে। সে সুবাদে বড় মামা তাঁর কর্মস্থল হিসেবে ঠিক করেছেন রাওলদিয়া মাদরাসাকে। যেটি প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁরই আপন নানা মাও. ইদ্রিস রহ.। নানার প্রতিষ্ঠানে দু’বছর অধ্যাবসায়ের সাথে অধ্যাপনার কাজ আঞ্জাম দেন। জীবনের প্রথম ছাত্র হিসেবে পেয়েছেন মাও. নূরুল আমিন রহ. (বোর্ডিং হুজুর) কে। এরপর ভূঁইয়ারহাট তিতারকান্দি মাদরাসার সভাপতির অনুরোধে সেখানে যোগদান করেন। মাদরাসাটি আলিয়া সিলেবাসে পরিচালিত হলেও, কথা ছিলো, তারা এটিকে কওমিতে রূপান্তর করবেন। দু’বছর অতিবাহিত হলেও তার বাস্তবায়ন না-দেখে তিনি সেখান থেকে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর প্রিয় উস্তায মুফতি আব্দুল কাদের রহ. এর নির্দেশে চলে যান ফেনির ভাদাদিয়া মাদরাসায়। সেখানে পনেরো মাস অধ্যাপনা শেষে আবারও ফিরে এলেন রাওলদিয়া মাদরাসায়। এখানে দু’বছর কাটিয়ে এবার চলে গেলেন ইসমাইল মিয়ার বেড়ি। যেটি বর্তমানে ‘মিয়ারবেড়ি’ হিসেবে প্রসিদ্ধ। মামা-শশুর ইসমাইল মিয়ার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় অধ্যাপনা করেন পাঁচ বছর। এখানে তাঁর কাছে ‘মিযানুস সরফ’ পড়েন চাটখিলের হুজুরÑ মাও. রুহুল আমিন হাফি.। স্বাধীনতার দু’বছর পূর্বে তিনি আবারও ফিরে আসেন তিতারকান্দি মাদরাসায়। সেখানে কর্মরত ছিলেন প্রায় তিন বছর।

চরমটুয়া মাদরাসায় যোগদান
অবশেষে তিনি যোগদান করলেন দারুল উলূম চরমটুয়ায়। তখন ঘরদোর বলতে পূর্ব পাশের একটি দোচালা ঘর। তাছাড়া উত্তরপাশে একটি টেনশেড ঘরের প্রস্তুতি চলছে। আর এখানেই তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের আটচল্লিশটি বছর। প্রায় অর্ধশতকের কর্মজীবনে তিনি দারুল উলূমকে আগলে রেখেছেন পরম মমতায়। আপন সন্তানের মতোই। তিলতিল করে গড়ে তুলেছেন প্রিয় প্রতিষ্ঠানকে। যেটি আজ মহীরুহের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে। যেটির সুনাম ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। প্রিয় দারুল উলূমের জন্য তিনি মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন; জনে জনে বলেছেন। দারুল উলূমের তাহসিলের কাজে তিনি সফর করেছেন পাকিস্তান ভারত সৌদি কুয়েত ও আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে। আপন খ্যাতিকে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগিয়েছেন দারুল উলূমের জন্য। জীবনসায়াহ্ণের এই সময়ে এসেও তিনি দারুল উলূম নিয়ে ভাবেন। অসুস্থ শরির নিয়ে আজও সাড়া দিচ্ছেন দারুল উলূমের প্রতিটি কর্মযজ্ঞে। দারুল উলূমে তিনি দীর্ঘ সময় ‘নাযেমে তা’লিমাত’ তথা শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। সে হিসেবে তিনি ‘নাযেম সাহেব হুজুর’ নামেই অধিক পরিচিতি লাভ করেছেন। পরবর্তিতে তিনি অলঙ্কৃত করেন দারুল উলূমের ‘সদরুল মুদাররিসীন’ ও ‘শাইখুল হাদিসে’র পদ। অবশ্য কারো কাছে তিনি ‘চরমটুয়ার হযরত’ হিসেবেও পরিচিত।

তাসাউফের মেহনত
ওলামা বাজারের হযরত মাও. আব্দুল হালিম রহ. একবার কলাকোপা মাদরাসায় আগমন করেন। বয়ান করেন। সে বয়ান শুনে মুগ্ধ হন তখনকার ছাত্র শিব্বির। মনেপ্রাণে তাঁকেই আপন মুর্শিদ হিসেবে ঠিক করে নেন। কর্মজীবনের পঞ্চম বছরে এসে হাত রাখেন আপন মুর্শিদের হাতে। সুদীর্ঘ পনের বছর সাধনার পরে অর্জন করেন খেলাফত। পরবর্তীতে তিনি হাফেজ্জী হুজুর রহ. ও [গত মালেশিয়া সফরে] পীর যুলফিকার আহমদ নকশবন্দীর খেলাফতও অর্জন করেন। ত্রিরতœ কর্তৃক খেলাফত পাওয়ার পরেও তিনি তাসাউফের ময়দানে সক্রিয়া ভূমিকা রাখতে সম্মত হননি। আহবাবদের বারবার অনুরোধে অবশেষে তিনি রাজি হলেন। বর্তমানে তিনি দু’টো মজলিস পরিচালনা করছেন। একটি অনুষ্ঠিত হয় প্রতি ইংরেজী মাসের প্রথম শুক্রবার। দারুল উলূম চরমটুয়া মসজিদে। দ্বিতীয়টি অনুষ্ঠিত হয় প্রতি ইংরেজী মাসের দ্বিতীয় শুক্রবারে। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত মারকাযুল উলূম মাদরাসায়।

রাজনৈতিক দর্শন
অখণ্ড ভারত থাকাকালিন তিনি ‘নেজামে ইসলামে’র সদস্য ছিলেন। সাতচল্লিশে পাকিস্তান আজাদি লাভ করলেও কায়েম হয়নি ইসলামি হুকুমত। সে আক্ষেপে তিনি পদ্যকবিতা লিখে বিভিন্ন মঞ্চে আবৃত্তি করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি ‘জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম’ হাজারী গ্রপে যোগদান করেন। এক পর্যায়ে নোয়াখালি জেলা শাখার সভাপতির পদ প্রাপ্ত হন। নব্বইয়ের দশকের সূচনালগ্নে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. গঠন করেন ‘খেলাফত আন্দোলন’। তিনি এবার হাফেজ্জীর খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করেন। দলের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে এক পর্যায়ে তিনি এলাকার মানুষের বিরাগভাজনে পরিণত হন। দলপ্রধান আল্লামা হাফেজ্জীকে আমন্ত্রণ জানালেন দারুল উলূম চরমটুয়ায়। হাফেজ্জীর সফরসঙ্গী হয়ে এলেন মাও. শামছুদ্দিন কাসেমী রহ., মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ., আল্লামা আহমদুল্লাহ আশরাফ রহ. ও প্রফেসর হামিদুর রহমান হাফি.সহ অনেকেই। দুআ দিলেন প্রিয় ভক্তকে। দুআ দিলেন প্রিয় দারুল উলূমকে।

তাদরীবের মেহনত
চৌমুহনী হালিম কোম্পানির মাদরাসায়। হাফেজ্জী ও ওলামাবাজারের হযরতদ্বয়ের নির্দেশে একটি তাদরিবের আয়োজন করেন মাও. মোমিনুল্লাহ রহ.। আল্লামা শিব্বির আহমদ হাফি. ছাত্র হিসেবে সেখানে ভর্তি হয়ে যান। প্রশিক্ষণ দেবেন লালবাগের মুহাদ্দিস মাও. সালাহউদ্দীন রহ. ও আল্লামা নুরুল ইসলাম আদীব হাফি.। শেষ দিন উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং হাফেজ্জী হুজুর রহ. ও আব্দুল হালিম রহ.। তদরীব শেষে কিছু অনুভূতি ব্যক্ত করার নির্দেশ এলো। ছাত্র শিব্বিরের ‘পাঠপর্যালোচনা’ শুনে ওলামা বাজারের হযরত বললেনÑ ‘প্রতি বছর শাওয়ালে আমার মাদরাসায় পনের দিন তাদরীব করবে।’ সে থেকেই পথচলা শুরু। ধীরে ধীরে তানযিম ও ইত্তিহাদ বোর্ডদ্বয়ের আমন্ত্রণ আসে। আসে দেশের সর্ববৃহৎ বোর্ড বেফাকের তলবও। তিনি সবার ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে চলেছেন দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে। তাঁর তাজদীদি ফিকির সাদরে গৃহিত হয় ইলমিমহলে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিনি অর্জন করেন লক্ষাধিক আলেমের উস্তায হওয়ার গৌরব।

তাবলীগের সাথে সম্পৃক্ততা
স্বাধীনের ছয় মাস আগে দেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বন্ধ হয়ে যায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মাত্র চল্লিশ টাকা রাহ্খরচ নিয়েই তিনি বেরিয়ে পড়েন তাবলীগে। ছিলেন ব্রাহ্মনবাড়িয়া ও কুড়িগ্রাম এলাকায়। যাপন করেছেন মানবেতর এক মুজাহাদার যিন্দেগী। ছয় মাস পরে দেশ স্বাধীন হলে তিনি এলাকায় ফিরে আসেন। তাবলীগের মেহনতকে নিজের জীবনের ব্রত হিসেবে নির্ধারণ করেন। বয়ানের মাধ্যমে তিনি জনসাধারণকে এর গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করেন। ছাত্র-শিক্ষক-আম জনতা, যারাই তাঁর কাছে আসেন, সবাইকে তিনি তাবলীগে সময় লাগানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

রচনাবলি
শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি রচনা করেছেন অনেক বুনিয়াদি গ্রন্থ। তম্মধ্যে ‘বয়ানুল মাতালেব’ লেখার প্রেক্ষাপট খুবই ঈর্ষণীয়। নব্বই সনের দিকে তিনি দারুল উলূমের তাহসীলের কাজে সৌদি যান। কাজ শেষে প্রথমে ওমরা করেন। অপেক্ষা করতে হবে হজ্ব পর্যন্ত। হারামে বসেই শুরু করলেন এটির রচনা এবং শেষেও করলেন সেখানে বসেই। তাঁর রচনাবলির মধ্যে ‘আত্-তাইসীর শরহে নাহবেমীর’, ‘তা’লিমুত্ তারকীব ওয়াত্ তারজামা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সর্বশেষ রচনা করেন ‘আল-আরবাঈন ফি তাদরীবিল মুদাররিসীন’। যেটি প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছরের গবেষণার ফসল। ‘বয়ানুল মাতালেব’ ও ‘আত্-তাইসীর’ গ্রন্থদ্বয় ইতোমধ্যে বিভিন্ন মাদরাসার পাঠ্যতালিকায় স্থান করে নিয়েছে।

যিন্দা আকাবিরের পড়ন্তবেলা
পার করে এসেছেন জীবনের একাশিটি বছর। শুভ্র হয়েছে চুল-দাড়ি। কুঞ্চিত হয়েছে শরিরের তক। অসুস্থতা ঝেঁকে বসেছে সর্বত্র। তবুও তিনি থেমে যাওয়ার নন। শত অসুস্থতা ও হাজারো ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি আজও ছুটে চলেছেন দেশের প্রতিটি অঞ্চলে। বয়ান করছেন। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। মাদরাসার জন্য তাহসীল করছেন। আবার নিয়মিত দারসও দিচ্ছেন ছাত্রদেরকে। রাতকে তো তিনি উৎসর্গ করেছেন তাহাজ্জুদে রবের সাথে নিবিড় সম্পর্ক প্রতিস্থাপনে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর ছায়া আমাদের উপর দীর্ঘ করুন।

মৃত্যু

বহু বিশেষণে ভূষিত এই মহামানবের মৃত্যু হয় ২০২৩ সালের মার্চ মাসের ২৯ তারিখে। জাগতিক সকল মায়া ত্যাগ করে পরম বন্ধু মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পরলোক গমন করেন তিনি। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে পুরো আলেম সমাজে। ‌

অনুলিখন
ইসমাইল রফিক

এ জাতীয় আরো সংবাদ

রমজানে ইচ্ছাকৃতভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ালে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে

নূর নিউজ

মাওলানা আব্দুল হক জালালাবাদী রহ. ইন্তেকালে আল্লামা রাব্বানীর শোক

নূর নিউজ

টিএসসিতে মেয়েদের নামাজের জায়গা উদ্বোধন করলেন ভিসি

আনসারুল হক