ঈদুল ফিতর : করণীয় ও বর্জনীয়

মুফতী মুহাম্মদ ইসমাঈল

ইসলামে ঈদের প্রবর্তন হয় দ্বিতীয় হিজরিতে। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) যখন মদিনায় আসেন তখন দেখেন সেখানকার লোকেরা বছরে দুই দিন (নওরোজ ও মেহেরজান) আনন্দ উৎসব পালন করে, খেলাধুলা করে। তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের এ দুই দিনের পরিবর্তে আরো অধিক উত্তম ও কল্যাণকর দুটি দিন দিয়েছেন। ১. ঈদুল আজহা। ২. ঈদুল ফিতর। (আবু দাউদ)

‘ঈদ’ শব্দটি আরবি, যার অর্থ আনন্দ। ‘ফিতর’ শব্দটিও আরবি, যার অর্থ রোযা ভাঙা। ঈদুল ফিতরের অর্থ রোযা শেষ হওয়ার আনন্দ, আল্লাহর নিয়ামত লাভ করার আনন্দ। হিজরি সনের দশম মাস তথা শাওয়াল মাসের ১ তারিখ ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়।

ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য

রাসূল (সা.) বলেছেনে, রোযাদার ব্যক্তির জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে। ১। যখন সে ইফতার (দৈনিক ইফতার ও ঈদের ইফতার) করে তখন সে বিনোদিত হয়। ২। যখন সে তার প্রভুর সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন সে তার রোযার কারণে আনন্দিত হবে। (সহিহ বুখারি)

ঈদের দিনের সুন্নাত ও মুস্তাহাব

১. অন্য দিনের তুলনায় আগে আগে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া সুন্নাত ২. মিসওয়াক করা সুন্নাত। ৩. গোসল করা সুন্নাত। ৪. সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নাত। ৫. কিছু খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নাত। বিজোড় সংখ্যায় যেকোনো মিষ্টিদ্রব্য খাওয়া উত্তম; খেজুর অতি উত্তম। ৬। সকাল সকাল ঈদগাহে যাওয়া। ৬. ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া উত্তম। এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া অন্য রাস্তা দিয়ে আসা মুস্তাহাব। ৭. ঈদগাহে যাওয়ার পথে নিচু স্বরে তাকবির (আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ) পড়া সুন্নাত। ৮. সাধ্যমতো উত্তম পোশাক পরিধান করা মুস্তাহাব। ৯. নামাযের জন্য ঈদগাহে যাওয়ার আগে সাদকাতুল ফিতর আদায় করা সুন্নাত। (দাতা ও গ্রহীতার সুবিধার্থে রমাদানের অন্য সময়েও প্রদান করা যায়)। ১০. ঈদের দিন চেহারায় খুশির ভাব প্রকাশ করা এবং কারো সঙ্গে দেখা হলে হাসিমুখে কথা বলা মুস্তাহাব। ১১. আনন্দ-অভিবাদন বিনিময় করা মুস্তাহাব।

ঈদের নামায দুই রাকাত আর তা ওয়াজিব। এতে আজান-ইকামত নেই। যাদের উপর জুমার নামায ওয়াজিব তাদের উপর ঈদের নামাযও ওয়াজিব। ঈদের নামায ময়দানে পড়া উত্তম। তবে মক্কাবাসীর জন্য মসজিদে হারামে উত্তম। শহরের মসজিদগুলোতেও ঈদের নামায পড়া জায়েয। (বুখারি)

ঈদের নামাযের সময়

সূর্য উদিত হয়ে এক বর্শা (অর্ধহাত) পরিমাণ উঁচু হওয়ার পর থেকে শুরু হয়ে দ্বিপ্রহর পর্যন্তÍ বাকি থাকে। তবে ঈদুল ফিতরের নামায একটু দেরিতে পড়া সুন্নাত; যেন নামাযের আগেই বেশি থেকে বেশি সদকাতুল ফিতর আদায় হয়ে যায়। (ফাতহুল কাদির)

নামাযের নিয়ত

নিয়ত অর্থ মনের ইচ্ছা। কাজেই মুখে উচ্চারণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। মনে মনে নির্দিষ্ট করতে হবে যে আমি এ ঈদের নামায কিবলামুখী হয়ে এ ইমাম সাহেবের পেছনে অতিরিক্ত ছয় তাকবিরের সঙ্গে আদায় করছি।

ঈদের নামাযে অতিরিক্ত ছয় তাকবির

ঈদের নামাযে অতিরিক্ত ছয়টি তাকবির ওয়াজিব। প্রথম রাকাতে তাকবিরে তাহরিমা ও ‘ছানা’র পর তিন তাকবির। দ্বিতীয় রাকাতে কেরাতের পর রুকুতে যাওয়ার আগে তিন তাকবির। এ তাকবিরগুলো বলার সময় ইমাম-মুকতাদি সবাইকে হাত উঠাতে হবে। তৃতীয় তাকবির ছাড়া প্রত্যেক তাকবিরের পর হাত ছেড়ে দিতে হবে। কেউ যদি এ তাকবিরগুলো না পায়, তাহলে সে রুকুতে থাকা অবস্থায় আদায় করে নেবে। কারো পূর্ণ এক রাকাত ছুটে গেলে সে দ্বিতীয় রাকাতে কেরাতের পর তাকবিরগুলো আদায় করে নেবে। কেরাতের আগে আদায় করারও সুযোগ রয়েছে। নামায শেষে খুতবা প্রদান ইমামের জন্য সুন্নাত; তা শ্রবণ করা নামাজির জন্য ওয়াজিব। (ফাতাওয়া শামি)

কারো ঈদের নামায ছুটে গেলে শহরের অন্য কোনো জামাতে শরিক হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। পরিশেষে যদি নামায ছুটেই যায়, তাহলে এর কোনো কাজা নেই। তবে চার রাকাত ইশরাকের নফল নামায আদায় করে নেবে এবং তাতে ঈদের নামাযের মতো অতিরিক্ত তাকবির বলবে না। (ফাতাওয়া শামি )

নারীদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকলে ঈদের জামাতে শরিক হওয়ার অনুমতি রয়েছে। তবে পর্দা লঙ্ঘন করে মহিলাদের জন্য ঈদের জামাতে যাওয়ার শরিয়তে অনুমতি ও অবকাশ নেই।

ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো

ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরীয়ত অনুমোদিত। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমনÑ ১. হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) বলেছেন, সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেনÑ ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ অর্থ- আল্লাহ তায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন; ২. ঈদ মোবারক ইনশাল্লাহ; ৩. ‘ঈদুকুম সাঈদ’ বলেও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। পরিচিত কারো সঙ্গে কিছুদিন বা অনেক দিন পর দেখা হলে উভয়ে ডান গলা মিলিয়ে মহব্বতের সঙ্গে একবার কোলাকুলি করা সুন্নাত। তবে ঈদের দিন জরুরি মনে করে কোলাকুলি করা বিদআত। অন্যথায় জায়েয । (তিরমিজি)

ঈদের দিনে যা বর্জনীয়

১। বিজাতীয় আচার আচরণ ও সভ্যতা সংস্কৃতির প্রদর্শন। ২। নারী পুরুষের পারস্পারিক বেশ ভূষা ধারণ করা। ৩। নারীদের যত্রতত্র খোলা মেলা উন্মুক্ত বিচরণ। ৪। গান বাজনা শ্রবণ ও অশ্লীল সিনেমা নাটক প্রদর্শন। ৫। অনলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অনর্থক সময় নষ্ট করা। ৬। জামাতের সাথে ফরয নামায আদায়ে অলসতা করা। ৭। অমিত ব্যয়ী হওয়া। ৮। শুধু ঈদের দিনকে কবর যিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করা। ৯। জুয়া খেলা ও আতশবাজি ফুটানো। ১০। মানুষকে কষ্ট দেয়া। ১১। ঈদের নামায আদায় না করে আনন্দ ফুর্তিতে মত্ত হওয়া। ১২। বিনোদন স্পটগুলোতে নারী পুরুষের বেপর্দায় অবাধ যাতায়াত।

ঈদ আল্লাহর নিয়ামত। নিয়ামতের চাহিদা হলো, এর শুকরিয়া আদায় করা। নিয়ামত পেয়ে নিয়ামতদাতার অবাধ্য হওয়া তাঁর সঙ্গে বেইমানি করার শামিল। এক মাস আল্লাহর বিধান মেনে চলে পুরস্কার প্রদান দিবসে তাঁর অবাধ্যতা করার চেয়ে নিকৃষ্ট কাজ আর কী হতে পারে? কাজেই এ নিয়ামতের দিন তাঁর কোনো অবাধ্যতা যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা সব মুসলমানের কর্তব্য।

লেখক : বিশিষ্ট দাঈ ও প্রিন্সিপাল, আন-নূর কালচারাল সেন্টার, নিউইয়র্ক

এ জাতীয় আরো সংবাদ

রমাদানে যে কারণে দান-সাদাকা করবেন

আনসারুল হক

‘ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠায় যুবকদের অগ্রণী ভুমিকা পালন করতে হবে’

নূর নিউজ

ইসলাম সহাবস্থানের কথা বলে, সেই সহাবস্থানের ক্ষেত্রে ভারত একটি মডেল: ড. মহম্মদ বিন আবদুল করিম আল ঈসা

নূর নিউজ