ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন ও কিছু কথা

নূর নিউজ ডেস্ক:
রাসূল সা:-এর জন্ম দিবস প্রকাশ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হয় প্রতি বছরের ১২ রবিউল আউয়াল। আমরা এখন এই আয়োজনকে ঈদে মিলাদুন্নবী হিসেবেই অভিহিত করছি। জানা যায়, প্রথমবারের মতো এই আয়োজন যখন পালিত হয়, তারপর থেকে বিদ্যুৎবেগে এই সংস্কৃতিটি গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। ১২ রবিউল আউয়াল দিনটি রাসূল সা:-এর জন্ম দিবস হিসেবে এবং একই সাথে ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের জন্য অনেকটাই যেন নির্ধারিতই হয়ে যায়।
ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, ঈদে মিলাদুন্নবী সর্বপ্রথম পালন হয় ৫১৭ হিজরিতে। অর্থাৎ আরব ভূখণ্ডে ইসলামের উত্থানের প্রায় ছয় শতাব্দী পর এই চর্চার সূত্রপাত। তার মানে, ওফাতের পর প্রায় ৫০০ বছর পর্যন্ত রাসূল সা:-এর জন্মদিন পালনের সাথে মুসলমানরা পরিচিত ছিল না। এর কারণ হলো- জন্মদিন পালন করা ইসলামী সংস্কৃতির কোনো অংশ নয়। আমি এই সংস্কৃতিকে হারাম বলছি না। তবে, যা বলতে চাইছি তা হলো- আরবরা দীর্ঘ সময় অবধি জন্মদিন পালনের সংস্কৃতির অনুশীলন করেনি। আরবরা কখনোই জন্মদিন মনে রাখা কিংবা সংরক্ষণ করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিত না।

আমরা যারা এখন মুসলমান হিসেবে দাবি করছি, আমাদেরও দাদা, নানা বা দু-এক প্রজন্ম আগের তথ্য যদি সংগ্রহ করেন, তাহলে দেখবেন, তারা কেউই নিজেদের জন্মদিন, এমনকি জন্মের মাসটিও নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। ভাসা-ভাসা একটি ধারণা রাখেন মাত্র। কারণ, জন্মদিনকে এত আলাদাভাবে মনে রাখার মতো গুরুত্ব তারা কখনোই দেননি। জন্মদিন পালনের সংস্কৃতি মূলত এসেছে পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে। যদিও আধুনিক সময়ে এসে আমরা জন্মদিনের রেকর্ড রাখছি বা সংরক্ষণ করছি; কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে এই সংস্কৃতির চর্চা বা অনুশীলন একেবারেই ছিল না।
ঠিক একই কারণে, রাসূল সা:-এর জন্মদিন পালনের চর্চাটাও শুরু হয়েছে অনেক বছর পরে এসে। মিসরের ফাতেমি বংশের প্রতিনিধিরা প্রথম এই ঈদে মিলাদুন্নবীর আয়োজন করে। আজকের দিনে এসে যাদেরকে আমরা আগা খান বা ঈসমাইলিয়া বলে চিনি, ফাতেমীয়রা ছিলেন তাদের পূর্বপুরুষ। ফাতেমীয়রা বেশ লম্বা একটি সময়ে মিসর শাসন করেছিল। তৎকালীন সময়ে, মিসর শাসন করতে গিয়ে ফাতেমীয়রা বছরে প্রায় ৩০ থেকে ৪০টি উৎসবের আয়োজন করত। মূলত, উৎসব আয়োজনের প্রথম উদ্দেশ্য হলো- জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক। উৎসবের আয়োজন হলে অসংখ্য মানুষ এক জায়গায় সমবেত হয়, তারা পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করে; ফলে দেশের অর্থনীতি বেগবান হয়। তৃতীয়ত, উৎসব ঘনঘন হলে শাসক মহলের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতাও বেড়ে যায়। এ কারণেই শাসক মহল স্বপ্রণোদিত হয়েই ঘটা করে উৎসব আয়োজন করতে আগ্রহী হয়। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বোঝা যায়, বছরে ৩০-৪০টি উৎসব আয়োজনের নেপথ্যে ফাতেমীয় শাসকদেরও ভিন্ন কিছু কারণ ছিল। এভাবেই ফাতেমীয়দের হাত ধরে ঘাদির খুম, ১০ মুহররম, শিয়াদের অন্যান্য উৎসব, কিংবা আজ এই ইমামের জন্ম দিবস, দু’দিন পর অন্য আরেক ইমামের ওফাত দিবস পালন শুরু হয়ে যায়। ঠিক, এরকম চর্চার ধারাবাহিকতায় এক সময় রাসূল সা:-এর জন্মদিবস পালনের সংস্কৃতিও শুরু হয়। যেমনটি আগেও বলেছি, হিজরতের ৫১৭ বছর পর প্রথমবারের মতো রাসূল সা: -এর জন্মদিবস পালন শুরু হয়।

ফাতেমীয়রা রাসূল সা:-এর জন্মদিবস পালন শুরু করার ১৫০ বছর পর কিছু কিছু সুন্নি গভর্নর এই সংস্কৃতির পক্ষে অবস্থান নেন। তাদের কাছে এই উৎসবের চিন্তাটাকে নিজেদের স্বার্থের খুবই উপযোগী ও ফলপ্রসূ বলে মনে হয়। ফলে, তারা ফাতিমীয়দের আবিষ্কৃৃত এই উৎসব নিজেদের অঞ্চলেও আমদানি করেন। ফাতেমীয়রা মিসরে ১২ রবিউল আউয়ালকে ঘটা করে ঈদে মিলাদুন্নবী হিসেবে পালন করত। আর সুন্নিরা প্রথমবারের মতো এই আয়োজন করে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের নিকটবর্তী মসুল নামক এলাকায়। সেখানকার সুন্নি গভর্নর ৬৭০ হিজরিতে প্রথম ঈদে মিলাদুন্নবীর আয়োজন করেন। অর্থাৎ হিজরতের পর দীর্ঘ ৬৭০ বছর পর্যন্ত সুন্নি মুসলমানদের কাছে এই দিবসটি মোটামুটি অজানাই ছিল। যদিও সুন্নিরা ফাতেমীয়দের অনেক পরে ঈদে মিলাদুন্নবী আয়োজন শুরু করে; কিন্তু তাদের আয়োজনটি ছিল ভীষণরকম জাঁকজমকপূর্ণ, বিলাসী ও ব্যয়বহুল। বিপুলসংখ্যক মানুষ এই উৎসবে অংশ নিতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে এই ঈদে মিলাদুন্নবী জাতীয় উৎসবের রূপ লাভ করে।

প্রথম দিকে, অনেক ফিকহবিদ এই উৎসব পালনের বিরোধিতা করেছিলেন। কেউ কেউ আবার শর্তসাপেক্ষে উৎসবের অনুমোদনও দিয়েছিলেন; কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই উৎসবটি এত বড় আকার ধারণ করে যে, শর্তগুলো পালন করা আর সম্ভব হয় না। বন্যার পানির মতো লাখ লাখ মানুষ এসে এই উৎসবের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়।
যেভাবে বর্তমানে রাসূল সা:-এর জন্মদিবস পালিত হচ্ছে, সে বিষয়ে অনেকেই তা জানেন। আমি মনে করি, যদি আপনি সত্যিকারেই রাসূল সা:-এর জন্মদিন পালন করতে চান, তাহলে আপনি সোমবার রোজা রাখতে শুরু করুন। কারণ, রাসূল সা:-কে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন আপনি সোমবার রোজা রাখেন? নবীজী সা: উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি সোমবার রোজা রাখি, কারণ সোমবারেই আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম।’ বছরে এক দিন জন্মদিবস পালন করে রাসূল সা:-এর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা অনেক সহজ। কিন্তু প্রকৃত ভালোবাসা কখনো একটিমাত্র দিনে সীমিত থাকতে পারে না; বরং সারা বছরই সেই ভালোবাসা ধরে রাখতে হয়।
অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ আগাগোড়াই এই উৎসব আয়োজনের বিরোধিতা করেছিলেন। অনেকে তো ফতোয়াও দিয়েছিলেন। কেউ কেউ সরাসরি এই উৎসবকে বিদয়াত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আবার ইবনে হাজার রহ: বলেছেন, এই উৎসবটি বিদয়াত হলেও এর কিছু ভালো দিকও আছে। অনেক মুসলমান এই উৎসব উপলক্ষে একত্রিত হয়। রাসূল সা:-এর নামে দরুদ পেশ করে। রাসূল সা:-কে নিয়ে আলোচনা করে। আবার ইবনে হাজারের মতের বিরুদ্ধে গিয়েও কেউ কেউ বলেছেন, এটি যদি বিদয়াত হয়, তাহলে এর মধ্যে কল্যাণ থাকতে পারে না। বর্তমান সময়ে এসেও ঈদে মিলাদুন্নবী নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়। যারা পক্ষে বলেন, তারা যেমন উগ্র মন্তব্য করেন, আবার যারা এর বিপক্ষে বলেন, তারাও বেশ কড়া মন্তব্যই করেন।

এই উৎসবটি বিদয়াত না জায়েজ, আমি সেই প্রসঙ্গেই যেতে চাই না। শুধু একটি প্রশ্নই করতে চাই। আর তা হলো- আমাদের মধ্যে কেউ কি সাহাবিদের তুলনায় রাসূল সা:-কে বেশি ভালোবাসতে পারবে? যদি তা না হয়, তাহলে সাহাবিদের অনুশীলন ও চর্চাগুলোকে ধারণ করে থাকাই কি বেশি নিরাপদ নয়? যে বিষয়টি নিয়ে এত বিতর্ক, তার ব্যাপারে খোলাফায়ে রাশেদা ও প্রাথমিক যুগের সর্বজনবিদিত স্কলারদের সিদ্ধান্ত এবং প্র্যাকটিসকে মেনে নেয়াই কি বেশি যৌক্তিক নয়?
এই সাহাবিরা কিংবা প্রাথমিক যুগের ইসলামী চিন্তাবিদরা একনিষ্ঠভাবে রাসূল সা:-এর সুন্নাহকে অনুসরণ করে গেছেন। তাদের কাছে সিরাতকে মেনে চলাই ছিল রাসূল সা:-এর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করার উৎকৃষ্টতম পথ।

যারা উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে রাসূল সা:-এর জন্মদিবস পালন করে, তারা মূলত এর মাধ্যমে নবীজী সা:-এর প্রতি তাদের ভালোবাসা দেখাতে চায়। আমি এর সাথে একমত নই। কেন আপনি রাসূল সা:-কে বছরে মাত্র এক দিন ভালোবাসবেন? বরং আপনার উচিত বছরের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্তে রাসূল সা:-কে ভালোবাসা।
আর সেই ভালোবাসার একটি মাত্র উপায় আছে; আর তা হলো রাসূল সা:-এর শিক্ষাকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা। রাসূল সা: আমাদের যা করতে বলে গেছেন, আমরা যদি তা করতে পারি, তাহলেই আমরা রাসূল সা:-এর জন্মদিবসকে সবচেয়ে সার্থকভাবে পালন করতে পারব, তার প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা প্রমাণ করতে পারব।
আমরা কাউকে ভালোবাসার দাবি করব, তার জন্য একদিন উৎসব আয়োজন করব, আর বছরের সবদিন তার শিক্ষা ও দর্শনকে অগ্রাহ্য করব, তাহলে তা কেমন ভালোবাসা হলো? সত্যিকারের ভালোবাসার দাবি আমরা তখনই করতে পারব, যখন আমরা আমাদের গোটা জীবনকে রাসূল সা:-এর সুন্নাহর আলোকে ঢেলে সাজাতে পারব।

প্রবন্ধকার: আলী ওসমান শেফায়েত
শিক্ষক, মাস্টার তালেব উল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বড়ঘোপ, কুতুবদিয়া

এ জাতীয় আরো সংবাদ

বিএনপিতে যোগ দিলেন সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক ২৫ কর্মকর্তা

নূর নিউজ

ঢাকা থেকে বিদায় নিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার

নূর নিউজ

মহামারি তুলে নেয়ার আকুতিতে পবিত্র হজ পালিত

আনসারুল হক