রাকিবুল হাসান নাঈম
আঠারো শতকের শেষভাগ এবং ঊনবিংশ শতকের প্রথমভাগে ভারতবর্ষ রাজনৈতিক, ধর্মীয়, নৈতিক তথা চারিত্রিক দিক দিয়ে অবনতি ও অধঃপতনের শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলো। তাওহীদ, রেসালাত ও আখেরাত-ভিত্তিক ইসলামী জীবনধারা থেকে বিচ্যুতির ফলে যেমন পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে মুসলমানরা দুর্বল ও বিদেশী দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ হয়েছিল, তেমনি ভারত উপমহাদেশেও তারা মোগলপতন যুগে প্রথমে শিখ-মারাঠা কর্তৃক পির্যস্ত ও পরে ইংরেজদের দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সম্রাট আলমগীর আওরঙ্গজেবের পর থেকেই উপমহাদেশের মুসলমানদের শাসন ক্ষমতায় পতনের সূচনা ঘটে। আওরঙ্গজেবের তিরোধানের পর তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে যারা দিল্লীর মসনদে আসীন হয়েছিলেন, তাদের বেশীর ভাগই ছিলেন অযোগ্য ও দুর্বল শাসক। ধর্মীয়, চিন্তাগত, নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে পতন দেখা দিয়েছিলো, তা রোধ করার মতো ক্ষমতা তাদের মোটেই ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শাসকগণ নিজেদেরকে নামেমাত্র দিল্লীর অধীন বলে প্রকাশ করলেও কার্যত তারা স্বাধীন শাসনকর্তা হিসাবেই সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহ শাসন করতেন।
উপমহাদেশের মুসলিম শাসন ক্ষমতার এ দুর্বলতা লক্ষ্য করেই বণিক হিসাবে আগত ইংরেজরা এদেশের শাসক হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। পরিণামে, পলাশীযুদ্ধে ইংরেজদের হাতে মুসলমানদের বিপর্যয় ঘটে। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শাসক নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রে ইংরেজরা পরাজিত ও হত্যা করে। এভাবে ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের যুদ্ধে বাংলা দখল করার মধ্য দিয়েই ইংরেজদের সেই স্বপ্নসাধ পূর্ণ হতে থাকে।
হিন্দুদের দৃষ্টিতে বহিরাগত মুসলমানদের পরিবর্তে জবরদখলকারী খৃস্টানদের শাসনে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। স্থানীয় হিন্দুরা উপমহাদেশের খৃস্টান শাসনকে সহজভাবে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু বৃটিশরা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিল যে, মুসলমানরা এত সহজে বৃটিশ শাসন মেনে নেবে না। মুসলমানদের অসহযোগী মনোভাব আর হিন্দুদের অনুগত সমর্থন এ দুই নিয়েই শুরু হয় বৃটিশ শাসন। মুসলমানরা এ পরিবেশকে ‘দারুল হরব বা শত্রু কবলিত এলাকা বলে ঘোষণা করে। শুরু হয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন।
১৭৫৭ সালের পর থেকে পুরো একশতকেরও অধিককাল মুসলমানেরা আন্দোলন চালিয়ে যায়। ১৭৬৫ সালের ফকির বিদ্রোহ দিয়ে এ সংগ্রাম অধ্যায়ের সূচনা। মাঝখানে ১৮৫৮ সালের সিপাহি বিদ্রোহ, তিতুমীরের বিদ্রোহ, হাজী শরীয়তুল্লাহ ও দুদুমিয়ার আন্দোলন, সৈয়দ আহমদ বেরলভির অভ্যুদয় ও বালাকোটের যুদ্ধ, পাটনায় শাহ এনায়েত আলীর সংগঠন ও তার তৎপরতা, সিত্ত্বানা, মূল্কা ও পাঞ্জাবের যুদ্ধসমূহ প্রভৃতির মাধ্যমে এর বিস্তৃতি এবং ১৮৬৪ সালের সীমান্ত অভিযান ও সর্বশেষ পাটনা, অমলার ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে সে সংগ্রাম অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।
১৮ শতকের শেষদিকে রাজনৈতিক অবস্থা
তৎকালীন উপমহাদেশের মুসলমানগণ সত্যের পথ থেকে বহু দূরে সরে যায়। আরাম-আয়েশ এবং হীন মনোবৃত্তি চরিতার্থ করার উপকরণ সংগ্রহ করা ব্যতীত আমীর ওমরাদের আর কোন কাজ ছিল না। এর পরিণাম সম্পর্কে তারা ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন। মোগল শক্তি তখন প্রায় বিভক্ত। আড়াইশত বছরের আপ্রাণ চেষ্টা সাধনার পর করে একটু একটু যে বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করেছিল, কাবুল থেকে আসাম, আরাকান এবং কারাকোরাম থেকে কুমারিকা অন্তরীপ, ভোগ বিলাস, গৃহবিবাদ, এবং অরাজকতার মাধ্যমে এক একটি রাজ্য কেন্দ্র থেকে বিচিছন্ন হয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে যে কয়জন সচেতন ভাষাপ্রাণ এই নিরাশার অন্ধকারকে দূর করে আশার আলো জ্বালাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন হায়দার আলী এবং টিপু সুলতান ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। মহীপুরের হায়দার আলী যে নতুন শক্তির পত্তন করলেন টিপু সুলতান তার শিরায় শিরায় ইসলামের তাজা রক্ত প্রবাহিত করেন। কিন্তু বিরোধ এবং স্বার্থপরতার কারণে তারা তেমন কিছু করতে পারেননি।
এই সময় মোগল সাম্রাজ্যের এক বিরাট অংশে মারাঠাগণ হাঁটু গেড়ে বসে। একবার মোগল সিংহাসনই প্রায় তাদের দখলে চলে গিয়েছিল। পানি পথের যুদ্ধে আহমদ শাহ্ আব্দালী মারাঠাদের উপর চরম আঘাত হানেন। এরপর যদিও মারাঠাগণ ৪০/৫০ বছর টিকে ছিল, কিন্তু পূর্বাবস্থা আর ফিরে পায়নি এবং ক্রমে ক্রমে তারা ধ্বংস হয়ে যায়। পাঞ্জাবে রনজিৎ সিং শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে তথাকথিত একটি রাষ্ট্রের নামে ত্রাস সৃষ্টিকারী এক বাহিনী গঠন করে। রনজিৎ সিং-এর মৃত্যুর চার পাঁচ বছরের মধ্যে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সিন্ধুর শাসন ক্ষমতা চার জন আমীরের অধীনে ছিল। অযোধ্যায় শুজাউদ্দৌলা, দাক্ষিণাত্যে নিযাম, এবং বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় নবাব আলীবর্দী খান। এদের ধারণা ছিল, সম্পূর্ণ উপমহাদেশ মুসলমানদের অধীনে না থাকলেও অন্ততঃপক্ষে নিজেদের এলাকাগুলো থাকলেই যথেষ্ট। পরবর্তী সময়ে সায়াদাত আলী খান লোভের বশবর্তী হয়ে অযোধ্যার অধিকাংশই ছেড়ে দিলেন। বাকী অংশও পরে তার বংশধরদের হস্তচ্যুত হয়ে যায়।
অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং অরাজকতার দরুন ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে দাক্ষিণাত্যের সীমানাও প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। নবাব আলীবর্দী খাঁন ইন্তেকালের এক বছরের মধ্যেই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা ইংরেজদের হাতে চলে যায়। উপমহাদেশে ইংরেজ রাজত্বের ভিত্তিপ্রস্তর এখানেই স্থাপিত হয়। পরে ইংরেজগণ মারাঠা এবং নিযামের সাথে মিলিতভাবে মহিশুরের পতন ঘটায়। একাজ শেষ করে অল্প দিনের মধ্যেই মারাঠা, নিযাম এবং অযোধ্যাকে সাহায্যকারী হিসেবে শৃংখলাবদ্ধ করে বাকী সকলকে পুতুলে পরিণত করে। এর পরপরই উপমহাদেশের কেন্দ্রস্থল দিল্লী হস্তগত করে ইংরেজগণ জেঁকে বসে।
এসময় মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিলো অবনমিত, তাদের কোন নেতা ছিলো না, ছিলো না কোন শৃংখলা। তাদের দুর্বল ও অসহায় পেয়ে নানা ফেতনা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
১৮ শতকের শেষদিকে ধর্মীয় অবস্থা
তখন ভারতবর্ষের বুকে মুসলমানদের নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয় এমন পর্যায়ে নেমে গিয়েছিলো যে, তারা তাদের অন্যায়, অহংকারী কথাবার্তা এবং আচার-আচরণ নিয়ে প্রকাশ্যে গর্ব ও অহংকার করতো। মদ্যপান অবাধে চলতো। আমোদ-প্রমোদ ও ভোগ-বিলাসের ছিলো চারিদিকে ছড়াছড়ি। আমীর-উমাবা এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে শুরু করে গরীব ও নিঃস্ব শ্রেণী পর্যন্ত সবাই ছিলো এ সমাজ ব্যবস্থারই শিকার। শিরক ও বেদআত মুসলমানদের মধ্যে অধিক পরিমাণেই শেকড় গেড়ে বসেছিলো। কবর ও কবরবাসীদের সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র শরীয়তই অস্তিত্ব লাভ করেছিলো। বুযর্গানে দীন সম্পর্কে এমন সব আকীদা ও ধারণা অন্তর-মানসে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, যেগুলোর জন্য খৃস্টান, য়াহুদী এবং আরবের মুশরিক ও পৌত্তলিকেরা নিন্দিত তথা বদনামের ভাগিদার।
সবচে ভয়ংকর হলো, হিন্দু ও শী’আ সম্প্রদায়ের অধিকাংশ আচার-আচরণ ও প্রথা-পদ্ধতি আহলে সুন্নত ওয়াল জামা’আতের সমাজ জীবনের অংগীভূত হয়ে গিয়েছিলো। রাসুল সা. -এর বাস্তব জীবনাদর্শ (সুন্নত) শরীয়তকে তারা ভুলতে বসেছিলো। ইসলামী রীতিনীতি উঠেই যাচ্ছিলো। বহু ভালো ভালো দীনদার ও জ্ঞানী-গুণী পরিবারেও কুরআনুল করীম ও হাদীছ পাকের বিধি-বিধানের প্রতি কোনরূপ তোয়াক্কা করা হতো না। বিধবাদের পুনর্বিবাহ, মীরাছ (উত্তরাধিকার)-এর ক্ষেত্রে মেয়েদের অংশ দেয়া, সালাম দেয়া ইত্যাদিকে অনেক স্থানে দূষণীয় মনে করা হতো। ঠিক তেমনি হজের ন্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী রুকনকে রাস্তার কষ্ট-ক্লেশ ও নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি অজুহাত খাড়া করে এর ফরজিয়তকে রহিত করা হয়েছিলো।
তবে জ্ঞানগত, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিকতার দিক দিয়ে এ যুগটি একেবারেই তমসাচ্ছন্ন ছিল না। তখনও উপমহাদেশে মক্তব ও মাদরাসা জালের ন্যায় ছড়িয়ে ছিলো । অলিতে-গলিতে খানকাও ছিলো। উলামায়ে কেরাম উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে ও শহরগুলোতে ইলম ও দীনের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারে ছিলেন নিরন্তর ব্যাপৃত এবং গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশনায়ও ছিলেন তারা মশগুল। খ্যাতনামা মুদাররিস ও তরীকতপন্থি সূফীদের প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র আবাদকৃত মাদরাসা ও খানকা ছিলো। কিন্তু আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাবার কারণে কমতে কমতে দ্রুত অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো মাদরাসাগুলো।
ত্রাণকর্তা হয়ে এলেন ‘তিনি’
উপমহাদেশের মুসলমানদের করুণ এই সময়ে ত্রাণকর্তা হয়ে এলেন হজরত সৈয়দ আহমদ শহীদ রহ.। তিনি তৎকালীন নৈতিক-রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, যে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে উপমহাদেশ অগ্রসর হচ্ছে, সর্বশক্তি দিয়ে এর প্রতিরোধ না করলে এ অঞ্চলে না থাকবে ইসলাম আর না থাকবে মুসলমান। তৎকালীন উপমহাদেশে কাদেরিয়া, চিশতিয়া এবং নকশবন্ধিয়া এই তিনটি বাইয়াত গ্রহণের তরীকা প্রচলিত ছিল। সৈয়দ সাহেব এসব তরীকা বাদ দিয়ে মুহাম্মদী তরীকায় বাইয়াত গ্রহণ করা শুরু করলেন। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, মুহাম্মদ সা. হলেন সবচেয়ে বড় পীর। তাঁর উপর কোন পীর নেই। তাঁর তরীকা বাদ দিয়ে অন্য কারুর তরীকা শ্রেষ্ঠ হতে পারে না। জীবনের প্রত্যেকটি কাজ আল্লাহর সমষ্টি হাসিলের উদ্দেশ্যে মুহাম্মদ সা.-এর তরীকা বা পদ্ধতি অনুযায়ী সমাধা করা, যেমন শ্রম দেয়ার উদ্দেশ্য হচেছ নিজের ও পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য হালাল উপার্জন, রাতে ঘুমানোর উদ্দেশ্য শেষ রাতে জেগে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা এবং ওয়াক্তের প্রথম দিকে ফজরের নামাজ আদায় করা, পানাহার করার উদ্দেশ্য হচেছ শরীর সুস্থ রেখে আল্লাহর আহকাম পালন করা, রোজা, নামাজ, হজ্ব আদায় করা এবং প্রয়োজন বোধে জিহাদ করার শক্তি সঞ্চয় করা। মোটকথা জীবনের প্রতিটি কাজকর্ম, কথা-বার্তা, চলা-ফেরা, আদান-প্রদান, মুহাম্মদ সা. প্রদর্শিত পদ্ধতি বা তরীকা অনুযায়ী শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে হতে হবে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলিম সমাজকে হযরত মুহাম্মদ সা.-এর মূল শিক্ষার দিকে ফিরে আসার আহ্বান জানাতেন বিধায় সৈয়দ সাহেবের নীতিসমূহ তরীকায়ে মুহাম্মদী বা রসুল সা.-এর মৌলবাদ হিসেবে ইতিহাসে খ্যাতি অর্জন করে। সৈয়দ আহমদ কর্তৃক গৃহীত নীতিসমূহের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন প্রসিদ্ধি পায় ‘তরীকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলন’ নামে।
সাইয়েদ আহমদ শহীদ আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চয়ের জন্যে তার শত শত কর্মীকে নিয়ে ১৮১৯ খৃষ্টাব্দে পবিত্র হজ পালনের লক্ষ্যে মক্কা শরীফ গমন করেন। হজের যাত্রাপথে তিনি বিভিন্ন স্থানে নোঙ্গর করে হাজার হাজার মানুষের বায়াত গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে ওয়ায-নসিহত করেন। আর অসংখ্য মানুষের দাওয়াত গ্রহণ করেন এবং তাদের নযরানা গ্রহণ করেন। এখানে একটি কথা বলে রাখতে হয়, অর্থ-সামর্থের দিক থেকে সৈয়দ সাহেবের উপর হজ ফরজ ছিল না। তারপরও প্রধানত দুটি উদ্দেশ্যে তিনি হজ করার নিয়ত করেন। প্রথমত, ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করার পূর্বে ইসলামের কেন্দ্রভূমি এবং খোদার ঘর জিয়ারত করাকে জরুরী মনে করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, উপমহাদেশে সে সময়ে হজে যাওয়ার ব্যাপারে একটা ভুল ধারণা প্রচলিত ছিল যে- হজে যাওয়া বিপদজনক এবং জীবনের নিরাপত্তা নেই; অতএব উপমহাদেশের কোন লোকের হজে যাওয়া ফরজ নয়। এই ভুল ধারণা দূর করে উপমহাদেশে হজের উপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে উৎসাহ প্রদান করার জন্যই সৈয়দ আহমদ বহু প্রচার প্রচারণা করে হজে গমন করেন। তার উভয় উদ্দেশ্যই সার্থক হয়েছিল। ইসলামের কেন্দ্রভূমি পবিত্র মক্কা এবং হযরত মুহাম্মদ সা.-এর রওজা মোবারক জেয়ারত করা হলো। হজের উদ্দেশ্যে সৈয়দ সাহেবের রওয়ানা হওয়ার কথা শুনে হজের উপযুক্ত বহু লোক উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তার সফরসঙ্গী হয়েছিল।
১৮১৯ খৃষ্টাব্দে তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। স্বদেশে ফিরে তিনি ইসলামী আন্দোলনকে লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্যে জেহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তার দলের প্রতিটি মোজাহিদকে তিনি ইসলামের সোনালী যুগের আন্দোলনের কর্মী সাহাবীদের আদর্শে গঠন করতে চেষ্টা করেন। প্রস্তুতি পর্বে সাইয়েদ সাহেব দেশের প্রভাবশালী মুসলমানদের সাথেও যোগাযোগ করেন। নবাব সোলায়মান জা’কে লিখিত তার একটি পত্র পাওয়া যায়। ঐ পত্র থেকে তার আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। পত্রটি হলো: ‘আমাদের দুর্ভাগ্য, হিন্দুস্থান কিছুকাল হয় খৃষ্টানদের শাসনে এসেছে এবং তারা মুসলমানদের উপর ব্যাপকভাবে জুলুম নিপীড়ন শুরু করেছে। বেদআতে দেশ ছেয়ে গেছে এবং ইসলামী আচার-আচরণ ও চালচলন প্রায় উঠে যাচ্ছে। এসব দেখে আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। আমি জেহাদ অথবা হিজরত করতে মনস্থির করেছি।’
শরীয়াতুল্লাহ ও তিতুমীরের আন্দোলন
সৈয়দ আহমদের আন্দোলন চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের ফরিদপুর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ‘ফারায়েজী আন্দোলন’ নামে অপর একটি ইসলামী সংস্কার আন্দোলন চলছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন হাজী শরীয়াতুল্লাহ। এ আন্দোলনটি তরীকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলনের মতোই ছিল। বাংলার মাটিতে যখন হাজী শরীয়াতুল্লাহ ইংরেজবিরোধী বিদ্রোহের বীজ বপন করছিলেন, সৈয়দ আহমদ বেরলভির বিপ্লবাত্মক আন্দোলন তখন উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের আকাশ মাটি তোলপাড় করছিল। তখন উপমহাদেশের পূর্ব প্রান্তে আর একজন মর্দে মুজাহিদ বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে ছিলেন, নাম তার সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর। ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দে চব্বিশ পরগণা জেলার চাঁদপুর গ্রামে তিতুমীর জন্মগ্রহণ করেন। সৈয়দ আহমদ বেরলভি যখন মক্কায় হজ্জ্ব করতে যান, ঘটনাচক্রে তিতুমীরও সেবার মক্কা শরীফ গিয়েছিলেন। তিতুমীর সেখানে সৈয়দ সাহেবের সান্নিধ্য পান এবং তার দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দে দেশে ফিরে ইসলামী সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। তিতুমীরের এ সংস্কার আন্দোলন চব্বিশ পরগণা, ফরিদপুর ও নদীয়া জেলায় জোরদার হয়েছিল। ওদিকে আন্দোলনের চূড়ান্ত সফলতার পূর্বেই ১৮৪০ সালে হাজী শরীয়তুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। আর তিতুমির ইন্তেকাল করেন ১৮৩১ সালে, বালাকোট যুদ্ধের ১১ দিন পর এক ইংরেজবিরোধী যুদ্ধে।
হজের সফরে যে সমস্ত বিখ্যাত ব্যক্তি সৈয়দ সাহেবের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন, তাদের তালিকায় মাওলানা ঈমাম উদ্দীন বাঙ্গালীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার অধিবাসী ছিলেন তিনি। সৈয়দ সাহেবের খুবই অনুরক্ত ছিলেন। বাইয়াত গ্রহণের পর থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত সৈয়দ সাহেবের সাথী ছিলেন। সৈয়দ সাহেবের হজ গমন উপলক্ষে মাওলানা ঈমাম উদ্দীন বাঙ্গালী নোয়াখালী সফর করেন এবং প্রায় ত্রিশ চল্লিশ জন নোয়াখালীবাসীকে সাথে করে নিয়ে আসেন। পরবর্তী সময়ে তারা সকলেই সৈয়দ সাহেবের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং তরীকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া বাংলার এক সম্রান্ত ব্যক্তি মুন্সী আমিন উদ্দীন আহ্মদ সৈয়দ সাহেবের হজে যাওয়ার সময় বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর সাথী ছিলেন। মৌলবী ওয়ারেস আলী বাঙ্গালী নামের আর একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব প্রথমদিকে আন্দোলনের প্রাথমিক সদস্য হিসেবে নাম লিখালেন। কিছুদিন কাজ করার পর সঠিক অর্থে আন্দোলন বুঝতে পেরে নিজের ভাগ্যকে আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেললেন এবং সৈয়দ সাহেবের হিজরতের সময় তিনিও নিজের জন্মভূমি এই সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ ত্যাগ করে সীমান্তের পাহাড়িয়া এলাকার পাঞ্জাতারে বসতি স্থাপন করেন। এই আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে আরেকজন বাংলাভাষী মুসলমানের নাম পাওয়া যায়। তিনি হচেছন শেখ বুরহানুদ্দীন বাঙ্গালী। ইনিও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সৈয়দ সাহেবের সাথী ছিলেন।
বালাকোট ও তার প্রভাব
তরিকায়ে মুহাম্মাদিয়া আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ কালপর্বে, ১৮৩১ সালে ঘটে যায় বালাকোট যুদ্ধ। এ যুদ্ধে বালাকোট নামক স্থানে শিখদের সঙ্গে তার প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে খুবি খাঁ নামক এক পাঠানের বিশ্বাসঘাতকতায় সাইয়েদ আহমদ বেরলভী ও মওলানা শাহ ইসমাইল দেহলভী শাহাদাত করেন।
সাইয়েদ সাহেব তার শাহাদাতের পূর্বে নিজেই বালাকোটের রণাঙ্গণ থেকে তার বিশিষ্ট খলীফা মওলানা বেলায়েত আলী আজীমাবাদীকে ভারতের অভ্যন্তরে আন্দোলনের উপকরণ সংগ্রমের কাজে নিয়োজিত থাকতে পাঠিয়েছিলেন। বালাকোটের মর্মান্তিক খবর প্রাপ্তির সময় মওলানা বেলায়েত আলী ছিলেন হায়দ্রাবাদে। এ ছাড়া ঐ সময় সাইয়েদ সাহেবের অপর যে একজন বিশিষ্ট খলীফা ছিলেন, তিনি হলেন মওলানা মুহাম্মদ আলী। তিনি বালাকোট ঘটনার সময় মোজাহেদ রিক্রুটিংয়ের কাজে নিয়োজিত ছিলেন মাদ্রাজে। আজাদী সংগ্রামের মহা নায়কের শাহাদাতের খবরে সাময়িখ ভাবে তারা ব্যথায় ভারাক্রান্ত হলেও হতোদ্দম হননি। আন্দোলন ছেড়ে দেননি। এ ঘটনার পর মওলানা বেলায়েত আলী তাবলীগ ও জেহাদের নতুন কর্মসূচী গ্রহণ করলেন। তার ছোট ভাই মওলানা এনায়েত আলীকে বাংলা দেশে পাঠান। মওলানা জয়নুল আবেদীন ও মওলানা মুহাম্মদ আলী হায়দ্রাবাদে কাজ করে যান। এ ভাবে অন্যান্য সহচর ও বন্ধু-বান্ধবদেরকে তিনি ভারতের বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করেন।
বালাকোট আন্দোলন সাময়িকভাবে ব্যর্থ হলেও তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলা যায় না। বালাকোটের পরও মুসলমানেরা চুপ থাকেননি। পরে জেলজুলুম, ফাঁসি, দ্বীপান্তর, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, জঘন্য নিত্য নির্যাতন ইত্যাদি তাদের ঈমানকে টলাতে পারেনি। একদিকে তারা সীমান্তে ইয়াগিস্তানে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন, অপর দিকে শাহ ওয়ালিউল্লাহর সুযোগ্য বংশধর ও সাইয়েদ সাহেবের মন্ত্রশিষ্য মওলানা শাহ ইসহাক সাহেবের নেতৃত্বে পূর্ব থেকে ভারতের অভ্যন্তরে ইংরেজদের চক্ষু এড়িয়ে শিক্ষা-সংস্কৃতির চর্চা ও জেহাদের অনুকূলে কাজ চলতে থাকে। তারা সতর্কতার সহিত সে কাজ চালিয়ে যেতেন। মুক্তিযোদ্ধারা স্থানে স্থানে মাদ্রাসা কায়েম ও ধর্মীয় সভাসমিতির মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখার কাজ করতেন। এ সঙ্গে খুব সন্তর্পণে জিহাদী প্রচারণা ও ইসলামী জাগরণকে উপমহাদেশে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালান।
সে প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই আমরা বিশ্ব বিখ্যাত উচ্চ দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ বিশ্ব-বিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানসমূহ দেখতে পাই। এগুলোকে কেন্দ্র করে পরবর্তী পর্যায়ে আরও অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং উপমহাদেশে ভবিষ্যতের জন্যে ইসলামী পুনর্জাগরণের পথ উন্মুক্ত হয়। উত্তরকালে ‘অসহযোগ আন্দোলন’ ও ‘খেলাফত আন্দোলন’কে উপলক্ষ্য করে মুসলমানদের মধ্যে আযাদী আন্দোলনের যে সাড়া জাগে এবং ১৯৪৭ সালে ইসলামের নামে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রটি অর্জিত হয়, এই প্রত্যেকটি কাজেই ঐসব প্রতিষ্ঠানের অপরিসীম অবদান রয়েছে।
পলাশি থেকে বালাকোট এবং তার পরবর্তী পুরো কালপর্বটিকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা যায়। এক. শাহ ওয়ালিউল্লাহর তিরোধানের পর তার সুযোগ্য পুত্র শাহ আবদুল আজিজ দেহলভী থেকে নিয়ে বালাকোট প্রান্তরে সাইয়েদ আহমদ শহীদ ও মওলানা ইসমাইল শহীদের শাহাদাৎ পর্যন্ত (সন ১৮৩১ খৃ.)। দুই. বালাকোট থেকে নিয়ে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত। তিন. ১৮৫৭ সাল থেকে ১৮৬৬/৬৭-তে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দ কেন্দ্রীক আন্দোলন পর্যন্ত। চার. দেওবন্দ থেকে নিয়ে ইংরেজ বিতাড়তের মধ্য দিয়ে আজাদী হাসিল পর্যন্ত। পাঁচ. আজাদী হাসিল থেকে বর্তমানের বাংলা-পাক-ভারতে পরিচালিত ইসলামী আন্দোলন পর্যন্ত।