লিখেছেন দুবাই প্রবাসী নওশের আলম সুমন
নিজের সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে পরিবার এবং দেশের তরে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করা সত্যিকারের রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের অঘোষিত উপাধি ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’। জন্মভূমি এবং পরিবার-পরিজনের মায়া ত্যাগ করে প্রবাসে পাড়ি জমানো এ সকল মানুষের ইতিহাস করুণ হৃদয়বিদারক, বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক। ‘সোনার সন্তান’ খ্যাত ভাগ্যহত প্রবাসীদের গল্প বেশিরভাগ সময় পর্দার অন্তরালেই থেকে যায়।
ভাগ্য বদলের আশায় শেষ আশ্রয়স্থল ভিটা-মাটি বিক্রি করে আবার কেউ ঋণে জর্জরিত হয়ে প্রবাসে এসে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে যেমন পরিবারের মুখে হাসি ফোটাচ্ছেন, তেমনি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সাহায্য করছেন। দেশকে উন্নত দেশে উত্তরণের অভিযাত্রায় দিন-রাত পরিশ্রম করছেন রেমিট্যান্স প্রেরক প্রবাসী বাংলাদেশিরা। অথচ প্রবাসীদের সঠিক মূল্যায়ন এবং তাদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনার অভাবে একদিকে যেমন প্রবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে রেমিট্যান্সের এই ধারা ব্যহত হয়ে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত আনতে পারে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।
সারা বিশ্বে বাংলাদেশের প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী আছে। দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে বেশকিছু দাবি জানিয়ে আসছিলেন তারা। দেশে প্রতি বছর যাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে বড় বড় বাজেট প্রনয়ণ করা হয়, সেই বাজেটেই প্রবাসীদের বঞ্চিত করা হয়, তাদের জন্য তেমন কোন বরাদ্দ রাখা হয় না। নামেমাত্র বরাদ্দ দিলেও উপকারভোগীর সংখ্যা খুবই কম, তেমন একটা সুফল বেশিরভাগ প্রবাসীর ভাগ্যে জোটে না।
মহামারী করোনার প্রভাবে সারা বিশ্ব যখন অর্থনৈতিকভাবে হেলে পড়েছিলো ঠিক তখন বাংলাদেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স একটা শক্ত ভীত তৈরি করে দিয়েছিলো। করোনার এই মহামারিতেও প্রতি মাসেই রেকর্ড ভেঙেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১ সালে দেশে যে পরিমাণ প্রবাসী আয় গিয়েছে, তা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। সবমিলিয়ে ২০২১ সালে প্রবাসী আয় গিয়েছে ২ হাজার ২০৭ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে ২ হাজার ১৭৪ কোটি ডলার এবং ২০১৯ সালে ১ হাজার ৮৩৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ২০২২ এর শুরুতে গত জানুয়ারি মাসে প্রবাসীরা ১৭০ কোটি ৪৪ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। এই ধারা অব্যাহত রাখতে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের উপর সরকার ঘোষিত আড়াই শতাংশ প্রণোদনা বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার জোর দাবি জানিয়েছেন প্রবাসীরা। এতে প্রবাসীরা তার অর্জিত সকল অর্থ বৈধ চ্যানেলে দেশে পাঠাতে আগ্রহী হবেন, অন্যদিকে প্রতিনিয়ত ভাঙবে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের রেকর্ড।
প্রবাসীদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে বেশকিছু দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বিদেশফেরত প্রবাসীদের সরকারিভাবে এককালীন অর্থপ্রদানসহ পেনশন চালু। একজন প্রবাসী দীর্ঘ ১৫/২০ বছর, আবার অনেকেই ২০ থেকে ২৫ বছরেরও অধিক সময় প্রবাসে থেকে দেশে রেমিট্যান্স পাঠান। পরিবারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে নিজের কথা ভুলে যাওয়া এসব মানুষ প্রবাসজীবন শেষে দেশে ফেরেন একেবারেই শূন্য হাতে।
পেনশন সুবিধার আওতায় এলে এসকল প্রবাসীরা শেষ জীবনে অন্তত বেঁচে থাকার ভরসা পাবেন। এই দাবিটা যেমন যৌক্তিক, তেমনি প্রবাসীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
সম্প্রতি সর্বজনীন পেনশন চালুর বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে প্রবাসীদের মাঝে। তারা বলছেন, প্রবাসীদের জন্য মাসে ১ হাজার টাকা করে রাখা নয়, তাদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের লভ্যাংশ থেকে অর্জিত অর্থ এবং সরকারিভাবে প্রণোদনার মাধ্যমে প্রবাসীদের পেনশন দেয়ার দাবি জানান তারা। এতে করে প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোয় আরও উৎসাহিত হবেন বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।
প্রবাসীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্য বীমার দাবি জানিয়ে আসছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তারা বলছেন, প্রবাসে চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি, এখানে বেশিরভাগ প্রবাসী স্বল্প বেতনে কাজ করেন। অন্যদিকে দেশেও এখন চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার অভাবে অকালে মৃত্যুবরণ করছেন প্রবাসীরা। তাই বাজেটে প্রবাসীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটি স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রেখে প্রবাসে দূতাবাসগুলোতে বিশেষ মেডিকেল টিম গঠনের দাবি জানান তারা।
প্রবাসীরা বেঁচে থাকা অবস্থায় যেমন অবহেলিত, তেমনি মারা গেলেও তাদের লাশের অবহেলা আর অপদস্থের শেষ নেই। জীবনের শেষ যাত্রায় অনেকের কপালে দেশের মাটিটুকুও জোটে না শুধুমাত্র কাগজপত্রের জটিলতা আর লাশ পরিবহনের অভাবে।
আগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস বিনা খরচে প্রবাসীদের লাশ বহন করলেও এখন তা ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করে দেয় বিমান কতৃপক্ষ। এজন্য অনেক প্রবাসী বাংলাদেশিকে বিদেশের মাটিতে দাফন করতে হয়। বাজেটে বিশেষ বরাদ্দের আওতায় বিদেশে মৃত বাংলাদেশির লাশ দূতাবাসের মাধ্যমে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে নিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তরের দাবি জানান প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
এছাড়া বিপদগ্রস্ত, দুর্ঘটনাকবলিত, বঞ্চিত প্রবাসীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত, অসুস্থ বিদেশফেরত প্রবাসীদের ফ্রিতে বিমানবন্দরে সুযোগ সুবিধাসহ সরকারিভাবে চিকিৎসা প্রদান করা, দেশে প্রবাসীর (সন্তান-সন্ততি) শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট কোটা ব্যবস্থা চালু এবং ভিত্তি প্রদান, প্রবাসফেরত কর্মক্ষম মানুষের জন্য সরকারি ভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, কোনরকম হয়রানি ছাড়া সহজ শর্তে সুদমুক্ত ঋণ প্রদান, দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসে চাকুরিচ্যুত কর্মী ও আহত কর্মীদের আইনি সহায়তাসহ প্রবাসীদের সকল সমস্যায় আগামী জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখার জোর দাবি জানান বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা।