আবরার নাঈম : মানুষের মাঝে সবচেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন প্রিয় নবি (সা.)। সর্বদা মুক্ত হস্তে দরাজ দিলে উজাড় করে দান করতেন সবাইকে। এক্ষেত্রে তিনি কারও চেহারা দেখতেন না বরং শত্রু-মিত্র যে কেউ তার দারস্থ হয়ে কিছু চাইলে তিনি তার চাহিদা পূরণ করতেন। যদি তৎক্ষণাৎ কিছু দিতে না পারতেন অন্য সময় আসতে বলতেন অথবা অন্য কোনো উপায়ে তাকে সাহায্য করতেন। সর্বোপরি-তিনি কাউকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। আর রমজান মাস এলে এ দানশীলতা বহুগুণে বেড়ে যেত। নিম্নে রাসূল (সা.)-এর দানশীলতার কিছু বিবরণ তুলে ধরা হলো-
রমাদানে রাসূল (সা.)-এর দানশীলতা
মাহে রমাদান হলো প্রতিটি মুমিনের তরে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষ উপহার। এ মাসে একটি নফল আদায়ের সওয়াব একটি ফরজের সমপরিমাণ। আর একটি ফরজ আদায়ের সওয়াব সত্তরটি ফরজের সমপরিমাণ। তাই প্রিয় নবি (সা.) বাকি এগারো মাসের তুলনায় এ মাসে অনেক বেশি আমল করতেন। দান-সদকাও করতেন বেশি হাতে।
এক হাদিসে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে-তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ধন-সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে সবার চেয়ে অধিক দানশীল ছিলেন। রমজানে জিবরাইল (আ.) যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি আরও অধিক দান করতেন। রমজান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরাইল (আ.) তাঁর সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করতেন। আর নবি (সা.) তাকে কুরআন পড়ে শোনাতেন। জিবরাইল যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি রহমতসহ প্রেরিত বায়ুর চেয়ে অধিক দানশীল হয়ে যেতেন। (সহিহ বুখারি-১৯০২)
প্রেরিত বায়ুর চেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন, এ কথার কী অর্থ? মুহাদ্দিসিনে কেরাম এর বিভিন্ন অর্থ করেছেন। এর একটি অর্থ হলো এই-কখনো কখনো প্রেরিত বায়ু বা বাতাস সবার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। কারও জন্য হয় উপকারী আবার কারও জন্য হয় ক্ষতিকর। কিন্তু রাসূল (সা.) সমগ্র পৃথিবীর জন্য উপকারী প্রেরিত বায়ুর মতো। অর্থাৎ তিনি যেমনিভাবে আর্থিক দান-সদকা করতেন তেমনিভাবে আত্মিক দান-সদকাও করতেন সমানভাবে। ধন-সম্পদ খরচ করার পাশাপাশি মানুষকে দ্বীনি ইলম শিক্ষা দান এবং হেদায়াতের বিষয়ে অধিক বেশি তৎপর থাকতেন।
দান-সদকা কাদের করা যায়? দান সদকার উপযুক্ত পাত্র কে বা কারা? এমনই এক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন প্রিয় নবি (সা.)। সূরা বাকারার দুইশ পনেরো নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা স্বয়ং সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অতি সুস্পষ্টভাবে।
ইরশাদ হয়েছে-‘লোকেরা আপনাকে জিজ্ঞেস করছে তারা কী ব্যয় করবে? বলে দিন যে বস্তুই তোমরা ধন-সম্পদ থেকে ব্যয় করবে তা পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন, এতিম, মিসকিন ও মুসাফিরদের জন্য ব্যয় কর; এবং তোমরা যে সৎ কাজ কর আল্লাহ তা সম্যক অবগত’। (সূরা বাকারাহ-২১৫)।
মুকাতিল (রহ.) বলেন, এ আয়াতটি হচ্ছে নফল দান সম্বন্ধে। (ইবন্ আবি হাতেম ২/৬১৯)। আয়াতের ভাবার্থ এই যে, হে নবি! মানুষ আপনাকে খরচ করার পাত্র সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করছে। আপনি তাদের বলে দিন, তারা যেন আয়াতে উল্লিখিত শ্রেণির মানুষের মাঝে খরচ করে অর্থাৎ নফল দান সদকা করে।
উত্তম জিনিস আল্লাহর পথে খরচ করা
দান-সদকার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়-তা হলো, নিজের পছন্দনীয় এবং উৎকৃষ্ট বস্তু দান করা। অপ্রয়োজনীয় এবং মূল্যহীন বস্তু নয়। এ সম্বন্ধে আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা যা ভালোবাস বা পছন্দ কর তা থেকে ব্যয় না করা পর্যন্ত কখনোই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না। আর তোমরা যা কিছু খরচ কর আল্লাহ সে সম্বন্ধে অবগত। (সূরা আল ইমরান-৯২)।
ইমাম ওয়াকি তার তাফসিরে উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় আমর ইবনে মায়মুন থেকে বর্ণনা করেন, বিররুন শব্দের ভাবার্থ হলো জান্নাত। (তাবারি ৬/৫৮৭) আয়াতে বলা হয়েছে, যে পর্যন্ত তোমরা তোমাদের পছন্দনীয় এবং উৎকৃষ্ট বস্তু দান না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে যেতে পারবে না। এ আয়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি হৃদয়স্পর্শী ঘটনা হাদিসে বর্ণিত আছে।
হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, সব আনসারদের মাঝে আবু তালহা (রা.) ছিলেন সবচেয়ে বেশি সম্পদশালী। তিনি তার সব ধন-সম্পদের মাঝে বাইরুহা নামক বাগানটিকে সর্বাপেক্ষা বেশি পছন্দ করতেন। বাগানটা মসজিদে নববির সামনে অবস্থিত ছিল। রাসূল (সা.) প্রায়ই ওই বাগানে যেতেন এবং ওর নির্মল পানি পান করতেন। যখন উপরোক্ত আয়াতটি নাজিল হয় তখন হজরত আবু তালহা (রা.)
রাসূল (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আল্লাহতায়ালা এরূপ কথা বলেছেন এবং বাইরুহা নামক বাগানটাই হচ্ছে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ। এজন্য আমি ওটি আল্লাহর পথে সদকাহ করছি এ আশায় যে, তার নিকট যে প্রতিদান রয়েছে তাই আমার জন্য জমা থাকবে। সুতরাং আপনাকে অধিকার দিলাম যেভাবে ভালো মনে করেন ওটা বণ্টন করে দিন। রাসূল (সা.) খুশি হয়ে বলেন, বাহ্ বাহ্ এটা খুবই উপকারী সম্পদ! বাহ্ বাহ্ এটা খুবই উপকারী সম্পদ! এটা খুবই উপকারী সম্পদ! তুমি যা বললে আমি তা শুনালাম। আমার মতে তুমি এ সম্পদ তোমার আত্মীয়স্বজনের মাঝে বণ্টন করে দাও। আবু তালহা (রা.) বলেন, খুব ভালো। অতঃপর তিনি ওটা তার আত্মীয়স্বজন ও চাচাতো ভাইদের মাঝে বণ্টন করে দেন। (সহিহ বুখারি-১৪৬১, সুনানে আবু দাউদ-১৬৮৯, সুনানে তিরমিজি-২৯৯৭)।
আল্লাহতায়ালা আমাদের এ পবিত্র মাসের গুরুত্ব উপলব্ধি করে সেই অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার এবং বেশি বেশি দান সদকা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।