কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত বাংলাদেশ।
আজ শনিবার (৬ নভেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা আকরম খাঁ হলে এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলন সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত বাংলাদেশ-এর সভাপতি আল্লামা নুরুল ইসলাম।
লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনটির মহাসচিব মাওলানা মহিউদ্দীন রাব্বানী।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, খতমে নবুওয়তের আকিদা ও বিশ্বাস মুসলমানদের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সমগ্র মানব জাতীর জন্য সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তাঁর নবুওয়তের সার্বভৌমত্ত্ব কোন কালেই খর্ব হবে না। আল্লাহর তরফ থেকে কিয়ামত পর্যন্ত নতুন কোন নবীর আবির্ভাব হবে না। এ বিশ্বাস যে কোন ব্যক্তির পক্ষে নিজেকে মুসলমান রূপে পরিচিত করার জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত। কেউ এ শর্ত অমান্য করলে, এমনকি যে কোন ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে প্রিয় নবিজি (সা.) এর নবুওয়তের মধ্যে সামান্যতম ভাগ বসানোর অপপ্রয়াস চালালে সে কাফের হয়ে যাবে। প্রিয় নবীজি (সা.) এর প্রতি এই সুস্পষ্ট আনুগত্যইমুসলিম জাতির অস্তিত্ব রক্ষার চাবিকাঠি।
তিনি আরো বলেন, উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইংরেজ বেনিয়ারা তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশ্যে তাদেরই সার্বিক সহযোগীতায় মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নামক এক ভন্ড প্রতারককে নবী দাবি করার পরামর্শ দেয়। তখন সে নিজেকে নবী বলে দাবি করে ইসলামের বহু মৌলিক আক্বিদা পরিপন্থী কিছু মনগড়া ভ্রান্ত আক্বিদার সমন্বয়ে এক নতুন ধর্মমতের গোড়াপত্ত্বন করে। এ ধর্মমতকে কাদিয়ানী ধর্মমত বলা হয়।
লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, আপনাদের অবগতির জন্য মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর রচনাসমগ্র “রূহানী খাযায়েন” নামক পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি সহকারে ৭২টি ভ্রান্ত দাবীসমূহ হতে নিম্নে কয়েকটি দাবী তুলে ধরছি;
১. আমি রাসূল – খন্ড ১৮, পৃষ্ঠা ২৩১
২. আমি খাতিমুল আম্বিয়া – খন্ড ১৮, পৃষ্ঠা ২১২
৩. আমি শরীয়তধারী নবী – খন্ড ১৭, পৃষ্ঠা ৪৩৫
৪. আমি সকল নবী হতে শ্রেষ্ঠ – খন্ড ২২, পৃষ্ঠা ৫৭৪
৫. আমি আঁ হযরত (সা.) হতে শ্রেষ্ঠ – খন্ড ১৯, পৃষ্ঠা ১৮৩
৬. আমি খোদার অনুরূপ – খন্ড ১৭, পৃষ্ঠা ১৫৮
৭. আমি খোদার প্রতিচ্ছবি – খন্ড ২২, পৃষ্ঠা ১৫৮
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, কুরআনের শতাধিক আয়াত এবং আড়াই শতাধিক হাদিসের মাধ্যমে মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী এবং তাঁর পরে আর কোনো নবী নেই তা সু-প্রমানিত। অজস্র আয়াত ও সহীহ হাদিস দ্বারা দ্যার্থহীনভাবে প্রমাণিত হয় যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) আখেরী ও সর্বশেষ নবী। তাঁর পরে আর কোন নবী আগমণ করবেন না। পূর্ববর্তী সালফে সালেহীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদিন সহ, বিশ্বের সকল হকপন্থী আলেম-উলামা, মুফতিয়ানে কেরাম ও পীর মাশায়েখদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত, কাদিয়ানি মতবাদ একটি কুফুরি মতবাদ। এই মতের অনুসারীগন নিকৃষ্টতম কাফের এবং মুরতাদ। শুধু তাই নয়, যদি কোনো মুসলিম ব্যক্তি কাদিয়ানীদের কাফের হওয়ার বিষয়ে বিন্দু মাত্র সন্দেহ পোষণ করে, তিনিও কাফের হয়ে যাবেন।
লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, যুগেযুগে মুসাইলামা কাজ্জাব, তুলাইহা, আসওয়াদ আনাসীর মত অনেক ভন্ড ও মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব হয়েছে কিন্তু সবাইকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অভিশপ্তে লাঞ্ছিত অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে এবং তারই ধারাবহিকতায় মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীও নিকৃষ্ট অবস্থায় ও করুন ভাবে মৃত্যুবরণ করে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ১৯৫৭ ইং সনে সিরিয়া সরকার, ১৯৫৮ ইং মিশর সরকার, ১৯৭৪ ইং সনে পাকিস্তান সরকার, ১৯৭৩ ইং আযাদ কাশ্মীরের এসেম্বিলী কাদিয়ানীদের অমুসলিম ও কাফের ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়াও পৃথিবীর বহু মুসলিম দেশ কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাাবে কাফের ঘোষণা করেছে। ১৯৭৪ ইং রাবেতায়ে আলমে ইসলামি এর অন্তর্ভুক্ত ১০৪ টি দেশের প্রতিনিধি সম্মেলনের সিদ্ধান্তে কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে অমুসলিম ও সংখ্যালঘু হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
বিগত ১৯৯৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী দৈনিক ইনকিলাব ও দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেছে যে, “আইনের দৃষ্টিতে কাদিয়ানী সম্প্রদায় অমুসলিম ও কাফের”। বিচারপতি আব্দুল জলিল ও বিচারপতি ফজলুল করিম এর যৌথ ব্র্যাঞ্চ হতে এই রায় ঘোষণা করা হয়। তাছাড়া বাগদাদে অনুষ্ঠিত ও.আই.সির সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের ধর্মমন্ত্রী নাজিম উদ্দিন আল আজাদের উপস্থিতিতে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে কাদিয়ানিদের কাফের ঘোষণা করা হয়।
সংবাদ সম্মেলন থেকে ৮দফা দাবি পেশ করা হয়। দাবিগুলো হচ্ছে-
১. কাদিয়ানী সম্প্রদায় (আহমদিয়া জামাত) কে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের ন্যায় বাংলাদেশে মুসলিম সংখ্যালঘু ঘোষণা করার জন্য আপনাদের মাধ্যমে সরকারের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি।
২. ঢাকায় বখশিবাজার, মিরপুর, নাখালপাড়া, নন্দিপাড়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তারা সেন্টার করে অসহায় সাধারণ মুসলমানদেরকে আর্থিক সহযোগিতা ও বিভিন্ন প্রলোভনে ফেলে কাদিয়ানিরা ঈমানহারা করছে। সম্প্রতি সারা দেশে সরকারি বেসরকারি অফিসআদালতসহ অসংখ্য মসজিদ মাদরাসায় কাদিয়ানী ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেওয়ার মতো দু:সাহস দেখিয়েছে। অনতিবিলম্বে তাদের এই অপ:তৎপরতা বন্ধ করতে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের নিকট জোর দাবী জানাচ্ছি।
৩. কাদিয়ানী সম্প্রদায় কুরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতে অমুসলিম হয়েও মুসলমানদের পথভ্রষ্ট করেছে বিধায় তাদের জন্য ইসলামি পরিভাষা যথা- নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, সদকা, মসজিদ, মাদরাসা, আজান, ইমাম, মুয়াজ্জিন ইত্যাদি পরিভাষা নিষিদ্ধ করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
৪. কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের যাবতীয় বইপুস্ততক, লিটারেচার, লিফলেট, পাক্ষিক মাসিক পত্র-পত্রিকা মুদ্রন, প্রচার, সংরক্ষণ ও বিতরণ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
৫.কাদিয়ানীদের পৃষ্ঠপোষক ও অর্থায়নকারী হিসাবে চিহ্নিত সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান যথা প্রাণ-আরএফএল সহ যত প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের উৎপাদিত যাবতীয় পণ্য ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় তথা সকল স্তরেই বয়কট করতে সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।
৬. কুমিল্লার নানুয়া দীঘির পাড়ের পূজা মণ্ডপে পবিত্র কুরআন অবমাননা এবং এর পরবর্তী চাদপুর হাজীগঞ্জ, নোয়াখালী, ফেনী ও রংপুরসহ দেশের যেসকল স্থানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র হয়েছে, এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করতে একটি মহল সু-গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর পায়তারা করছে। যারা কুরআন অবমাননা করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে আক্রমণ চালায়, তারা একই ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত বলে আমরা মনে করি।
৭। মহান সংবিধানের অপরিবর্তনশীল মৌলিক কাঠামো তথা রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে অবমাননা ও অস্বীকার করে জনৈক প্রতিমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন এবং দিয়ে যাচ্ছেন আমরা তার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
সংবিধান রক্ষা করার শপথ নেওয়া প্রতিমন্ত্রী রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে ন্যাক্কারজনকভাবে সরাসরি সপথ ভঙ্গ করে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী থাকার যোগ্যতা হারিয়েছে।
এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে উস্কানি দিচ্ছেন।
আমরা অনতিবিলম্বে সংবিধান লংঘনকারী ও উস্কানিদাতা এই প্রতিমন্ত্রীকে অব্যহতী দেওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
৮। সম্প্রতি ভারতের ত্রিপুরায় মসজিদ, মাদরাসা ও মুসলমানদের বাড়ী-ঘর ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ নির্যাতন এবং লুট-পাট ইত্যাদি বিষয়ে আমরা মুসলমান হিসেবে অত্যান্ত ক্ষুব্দ ও মর্মাহত এব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবী জানাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন, সংগঠনের উপদেষ্টা মাওলানা আবুল কালাম, সহসভাপতি মাওলানা সাজেদুর রহমান, মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী, মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম সুবহানী, মাওলানা মুসা বিন ইজহার, মাওলানা জসিমুদ্দীন উদ্দীন, মাওলানা শিব্বির আহমাদ কাসেমী, মাওলানা জহুরুল ইসলাম, মুফতী বশির উল্লাহ, মাওলানা আবুতাহের খান, মাওলানা ফয়সাল, মাওলানা রাশেদ বিন নূর, মাওলানা মুমিনুল ইসলাম, মাওলানা সুলতান মাহমুদ, মাওলানা গোলাম মাওলা, মাওলান জোবায়ের, মাওলানা কামাল উদ্দীন প্রমুখ।