লম্বা পাঞ্জাবি পরে টহল দিচ্ছে তালেবান সদস্যরা। তারা আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের ‘নীতি পুলিশ’। যদিও তাদের পোশাকে পুলিশ নয় বরঞ্চ অনেকটা খাদ্য নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মতো দেখাচ্ছে। তাদের কাজ, তালেবানের কট্টোরপন্থী নীতি অনুযায়ী আফগানিস্তানের নতুন ‘ইসলামিক’ পরিচয় নিশ্চিত করা। তারা এ জন্য সব বিষয়েই নজরদারি করে। কোনো দোকানে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখেন তারা। আবার কোনো দোকানে নারীর ছবি সম্বলিত পোস্টার থাকলে তাও সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছেন তারা।
এরকম একটি নীতি পুলিশের দলকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছে বিবিসি। ওই দলের সবথেকে কনিষ্ঠ সদস্য মাদ্রাশা ছাত্র মাহমুদ ফাতিহ। ২৫ বছরের এই যুবক একটি জন সমাবেশকে লক্ষ্য করে ক্ষুদ্র বক্তব্য রাখছিলেন। তার বক্তব্যের মূল বিষয় হচ্ছে, নিয়মিত নামাজ পড়া এবং পুরুষদের দাড়ি বড় রাখার গুরুত্ব
দাড়ি রাখা ইসলামের মহানবীর আদর্শ এবং এর অনেক অন্য অনেক সুবিধাও আছে। তিনি তার সঙ্গে থাকা অন্য তালেবান সদস্যদের দেখিয়ে বলেন, তাদের সবার দুই বা তিনটি স্ত্রী আছে। তাই দাড়ি হচ্ছে শক্তিরও একটি উৎস।
শুধু বক্তব্য দেয়াই নয়, তারা রাস্তাঘাটে কিংবা মার্কেটের নানা সমস্যা সমাধানেরও চেষ্টা করেন। এক দোকানদার অভিযোগ করেন যে, তালেবানের এক সদস্য তার কাছে বিনামূল্যে মোবাইল ফোন দাবি করেছে। তখন ওই তালেবান সদস্যদের ফোন নাম্বার টুকে রাখেন ফাতিহ। প্রতিশ্রুতি দেন, এ নিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সব ধরণের বিষয়ে নজরদারি করলেও তাদের মূল কাজ হচ্ছে নারীদের পোশাক সম্পর্কে তালেবানের নতুন নীতির প্রয়োগ নিশ্চিত করা। এ মাসের প্রথম সপ্তাহে তালেবান নির্দেশ দেয় যে, দেশের সকল নারীকে অবশ্যই মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা পোশাক পরতে হবে। এছাড়া, পুরুষ অভিভাবক ছাড়া কোনো নারীকে বাইরে পেলে তাকে জেলে ভরা হবে বলেও ঘোষণা দেয়া হয়।
মার্কেটের সামনে দুটি ছবি ঝোলানো হয়েছে, এতে দেখানো হয়েছে নারীদের কীভাবে পোশাক পরতে হবে। এর নিচে লেখা আছে, মুসলিম নারীদের অবশ্যই ইসলামিক পোশাক পরতে হবে এবং এটিই শরিয়ার নির্দেশ। আফগানিস্তান আগে থেকেই একটি রক্ষণশীল দেশ এবং দেশটির বেশিরভাগ নারী বোরকা পরেই অভ্যস্ত। যদিও কাবুলের মতো শহরগুলোতে কিছু আধুনিক পোশাক পরিহিতা নারীদেরও দেখা মিলতো। তালেবান ক্ষমতা দখল করেই নারীর পোশাক নিয়ে নানা নীতি প্রণয়ন করতে থাকে। প্রথমে তারা হিজাব অনুমোদন করলেও এখন শুধুমাত্র বোরকাকেই অনুমোদন দেয়া হয়।
দিন দিন আরও কট্টোর হয়ে উঠছে তালেবান। টেলিভিশনেও নারী সংবাদ পাঠিকাদের জন্য মুখমণ্ডল ঢেকে রাখার নিয়ম করা হয়েছে নতুন করে। যদিও শহরে এখনো মুখ খোলা নারীর দেখা মিলছে। তালেবানের দল যখন মার্কেট পরিদর্শন করছে তখনও এরকম নারীরা সেখানে ছিলেন। তাদেরকে বেশ আতঙ্কিত দেখাচ্ছিল। তালেবানের সদস্যরা বললেন, আমরা দেখলেই বুঝতে পারি কোন নারী পর্দা করছে আর কে করছে না। যদি কোনো নারী পুরোপুরি তার সীমা অতিক্রম করে তাহলে আমরা তার পুরুষ অভিভাবককে খুঁজে বের করি। তাদের প্রশ্ন করা হয় যে, কোন অধিকারে তারা নারীদের এরকম পোশাক পরতে বাধ্য করছে? উত্তরে ফাতিহ বলেন, এটা কোনো সরকারের নির্দেশ নয়, এটা আল্লাহর নির্দেশ। যদি কোনো নারী তার মুখমণ্ডলই না ঢাকেন তাহলে পর্দা করার প্রয়োজনটা কী! বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোতে যদিও নারীদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা বাধ্যতামূলক নয়।
তালেবানের এই ইন্সপেক্টররা পিক-আপ ট্রাকের পেছনে বসে শহর ঘুরে বেড়ান। তারা বিভিন্ন বাস থামিয়ে ভেতরের অবস্থা দেখেন। কোনো পুরুষ যাত্রী কোনো নারী যাত্রীর কাছাকাছি বসেছে কিনা তা যাচাই করেন। কোনো নারী দাড়িয়ে আছেন কিনা তাও দেখেন তারা।
সর্বশেষ তালেবান যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তাদের সদস্যরা প্রায়ই সাধারণ নাগরিকদের মারধোর করতো। তবে ফাতিহ জানালেন, এখন তাদের এরকম নির্দেশ নেই। কেউ নিয়ম ভঙ্গ করলে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা আছে। তারপর তার থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করা হয় যে, তিনি আর এ ধরণের কাজ করবেন না। এরপর এক বা দুইদিন পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
বিবিসির দলের সামনে এই তালেবান সদস্যরা সবার সঙ্গে বেশ ভালো আচরণ করছিল। তবে তালেবান দিন দিন কট্টোরপন্থী হয়ে উঠছে তা স্পষ্ট। এক নারী অধিকারকর্মী লায়লা বাসিম জানালেন, কীভাবে নারীদের পোশাকের বিষয়ে সাবধান করে দিচ্ছে তালেবান। বোরকা পরার পরেও অনেককে হুমকি শুনতে হয়েছে। মুখমণ্ডল কাপর দিয়ে না ঢেকে মাস্ক পরে থাকায়ও তালেবানের ক্ষোভের মুখে পরতে হয়েছে। এক তালেবান সদস্য তাদেরকে বলছিলেন, আপনি একজন লজ্জাহীন নারী। এটা আর আগের আফগানিস্তান নেই, এটি এখন একটি ইসলামিক আমিরাত। আপনি চাইলেই যা খুশি তা করতে পারেন না।