জরুরিয়াতে দ্বীনের ইলম ও ইসলামের সাধারণ বোধ-সমঝ লাভ এবং দ্বীন ও দুনিয়ার বিষয়ে আবশ্যকীয় সচেতনতা অর্জন করা তো প্রত্যেক মুমিনের উপরই ফরজ। তালিবানে ইলমে ওহির মাকাম আরও ঊর্ধ্বে। তালিবানে ইলমে ওহির মনযিল তো এগুলোর পর থেকে শুরু হয়।
মাবাদিয়াতের ইলম হাসিল করার পর তালিবে ইলমের মনযিলের সূচনা হল, দ্বীনি ইলমের মূল উৎস কুরআনে কারিম ও সুন্নতে নববীর হেদায়েত ও নসিহত সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ থেকেই বোঝার যোগ্যতা অর্জনের মেহনতে লেগে যাওয়া।
এ লক্ষ্যেই হাকিমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ. ও আরো কতক আকাবিরের মশোয়ারা মোতাবেক মাদরাসাগুলোতে তাফসিরের কিতাব পড়ানোর আগে মাতৃভাষায় পুরো কুরআন কারিমের তরজমা দরসে পড়ানোর রীতি চালু হয়।
কিন্তু এর জন্য নেসাবে নির্ধারিত কোনো কিতাব ছিল না; বরং কেবল মুসহাফ সামনে রেখে তরজমা পড়ানো হত। সন্দেহ নেই, এ তরিকাতেও ফায়েদা রয়েছে এবং এ পদ্ধতিতে ছাত্রদের জন্য তামরিনের সুযোগও বেশি থাকে। কিন্তু এ সূরতে প্রথমত, কুরআন তরজমা পড়ানোর বিষয়টি কাফিয়া শরহে জামী জামাত পর্যন্ত দেরী করতে হয়।
দ্বিতীয়ত, কুরআন তরজমার মত একটি নাযুক বিষয়ের পঠন কোনো কিতাবের সহযোগিতা ছাড়া শুরু করা একদিকে যেমন অনেক বড় চাপের বিষয় তেমনি তা ঝুঁকি ও আশঙ্কামুক্তও নয়। তাই দরসে কুরআন তরজমা পড়ানোর জন্য নেসাবি একটি কিতাবের খুব প্রয়োজন ছিল।
কোনো সন্দেহ নেই, এক্ষেত্রে শূন্যতা ছিল। মনে হয় এ শূন্যতা পূরণের সৌভাগ্য আল্লাহ তায়ালা আদীব হুযুর হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ দামাত বারাকাতুহুম-এর ভাগ্যে লিখে রেখেছিলেন। তিনি এক বিশেষ আঙ্গিকে এই মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন। তিনি প্রথমে চার খণ্ডে আততরীক ইলাল কুরআনিল কারীম রচনা করেন। এরপর তিন খণ্ডে আত তরীক ইলা তাফসীরিল কুরআনিল কারীম রচনা করেন।
এই উভয় কিতাব মূলত কুরআন কারিমের অর্থ ও মর্ম শেখার উদ্দেশ্যেই রচিত। প্রথম কিতাবটির চার খ-ই ভালোভাবে পড়া হলে কুরআন তরজমার সাথে তালিবে ইলমদের বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় এবং কুরআন কারিমের নির্বাচিত এক তৃতীয়াংশেরও অধিক আয়াতের তরজমা মাশাআল্লাহ আয়ত্ব হয়ে যায়। এরপর মুসহাফ সামনে রেখে পুরো কুরআনে কারিমের দরস হলে তা হজম করা তালিবে ইলমদের জন্য যেমন সহজ তেমনি এতে কাক্সিক্ষত ফায়দাও অর্জিত হয় পূর্ণরূপে।
সামনে গিয়ে তালিবে ইলম যখন আততরীক ইলা তাফসীরিল কুরআনিল কারিম পড়বে এবং কুরআন কারিমের অর্থ ও মর্মের বিশ্লেষণ সহজ সাবলিল আরবিতে পাবে তখন কুরআন কারিমেরসাথে তার সম্পর্ক আরো বাড়তে থাকবে। কুরআনের আয়াতের বার্তা জানতে পেরে সে ভিন্ন এক স্বাদ লাভ করবে; হৃদয়-মনে প্রশান্তি অনুভব করবে। কুরআনের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা আরো গভীর ও দৃঢ় হবে। আয়াতের অধীনে উল্লেখিত সংশ্লিষ্ট ফাওয়ায়েদ অবগত হয়ে তার জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হতে থাকবে। এভাবে ক্রমে তালিবে ইলমের হিম্মত উত্তরোত্তর বৃদ্ধি লাভ করতে থাকবে।
فجزى الله تعالى المصنف الجليل عن طلاب العلم وأهله خير الجزاء وأوفاه في الدنيا والآخرة على هاتين التحفتين الكريمتين الغاليتين، وعلى جميع تحائفه العلمية والدعوية والأدبية، باللغة العربية، والأردية، والبنغالية.
সাআদাত লাভের আশায় কিতাবদুটির পরিচিতি সম্পর্কে কিছু কথা আরজ করা মুনাসিব হবে।
আততরীক ইলাল কুরআনিল কারীম
প্রথম কিতাব আততরীক ইলাল কুরআনিল কারীম-এর প্রেক্ষাপট বয়ান করতে গিয়ে কিতাবের প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় মুসান্নিফ দামাত বারাকাতুহুম লিখেছেন-
‘আল্লাহর শোকর, আমার যাঁরা আসাতিযায়ে কেরাম, তাঁদেরই ছোহবত থেকে এ দায়িত্ব ও কর্তব্যের চেতনা আমার অন্তরে জাগ্রত হয়েছিল এবং শিক্ষক-জীবনের শুরু থেকেই এ চিন্তা আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো যে, তারজামাতুল কুরআনের তালিমকে কীভাবে সর্বস্তরের তালিবানে ইলমের জন্য সহজ ও ফলপ্রসূ করা যায়? তাত্ত্বিক চিন্তার পাশাপাশি প্রায়োগিক ক্ষেত্রেও আমি আমার ছাত্রদের উপর কিছু মেহনত অব্যাহত রেখেছিলাম। কয়েক বছরের চিন্তা ও মেহনতের নতিজা হিসাবে আমার মনে হয়েছে, যদি-
ক. আমাদের নেছাবে তালিমের শুরু থেকে আরবি ভাষা শিক্ষার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং তালিবে ইলমের মাঝে আরবি ভাষার নূন্যতম একটি যোগ্যতা তৈরি করা সম্ভব হয়।
খ. তারপর কুরআনুল কারিমের সহজ আয়াতগুলো নির্বাচন করে পর্যায়ক্রমে তরজমা শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করা হয় এবং
গ. চূড়ান্ত স্তরে পূর্ণ ইলমি আন্দাযে সমগ্র কুরআনের তরজমার তালিমের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে ইনশাআল্লাহ-
ক. শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই কুরআন ও তারজামাতুল কুরআনের সঙ্গে তালিবে ইলমের মুনাসাবাত ও পরিচয় গড়ে ওঠবে।
খ. ধারাবাহিক তরজমার পরিবর্তে ‘সহজ পর্যায়ক্রম পদ্ধতি’ অনুসরণের ফলে তালিবে ইলমের কাছে তারজামাতুল কোুআন কোন কঠিন বিষয় মনে হবে না, বরং হৃদয় ও আত্মার জন্য প্রশান্তি এবং রূহ ও কলবের জন্য সুকূন ও সাকিনার বিষয় মনে হবে।
গ. তরজমার প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের পর চূড়ান্ত পর্যায়ে স্বতন্ত্র বিষয় ও ‘ফন’ হিসাবে পূর্ণ তারজামাতুল কুরআন আত্মস্থ করা সহজে সম্ভব হবে। এভাবে তার সামনে খুলে যাবে তাফসিরুল কুরআনের বিশাল জগতে উপনীত হওয়ার ‘প্রবেশপথ’।’
(আততরীক ইলাল কোরআন, ১ম খণ্ড, ভূমিকা, পৃষ্ঠা নং- ح)
তিনি আরো লেখেন- ‘আজমের যে কোন ভাষার মুসলমানের জন্য আল্লাহর কালাম কুরআনুল কারিমের প্রাথমিক তরজমাটুকু বোঝাও খুব সহজ বিষয় নয়। এজন্য প্রথমে অর্জন করতে হয় আরবি ভাষার ব্যাকরণসম্মত বিশুদ্ধ জ্ঞান ও সাহিত্যবোধ।
তাই মাদরাসাতুল মাদিনায় ‘মাদানি নেছাব’ নামে নেছাবে তালিমের সংস্কারের যে মেহনত চলছে তাতে প্রথম বর্ষ থেকেই আরবি ভাষা শিক্ষার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। ফলে আল্লাহর রহমতে আরবি ভাষার উপর এক বছরের মেহনতে -সত্যি সত্যি যদি মেহনত করা হয়- একজন তালিবে ইলমের এই পরিমাণ যোগ্যতা অর্জিত হয় যে, সমগ্র কুরআন থেকে বেশ কিছু আয়াতের তরজমা সে মোটামুটি বুঝতে পারে।
সেই নির্বাচিত আয়াতগুলোই তারজামাতুল কুরআনের প্রথম পাঠরূপে মাদানি নেছাবের (দ্বিতীয় বর্ষের দুই পর্বে) এতদিন পড়ানো হচ্ছে এবং সেইসঙ্গে নেছাববি কিতাব তৈরির মেহনতও অব্যাহত রয়েছে। আলহামদু লিল্লাহ! ছুম্মা আলহামদু লিল্লাহ! রাব্বে কারিমের অশেষ মেহেরবানিতে আমাদের টুটা-ফাটা মেহনতের প্রথম ফসলরূপে الطريق إلى القرآن প্রথম খণ্ড এখন আত্মপ্রকাশ করছে। এতে প্রথম পনেরো পারার নির্বাচিত আয়াতগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। দ্বিতীয় পনের পারার নির্বাচিত আয়াতগুলো নিয়ে দ্বিতীয় খ- অচিরেই আত্মপ্রকাশ করবে ইনশাআল্লাহ।
আলোচ্য কিতাবে তালিবে ইলমের বুঝ ও মেধার স্তর অনুযায়ী প্রত্যেক আয়াতের নিচে প্রয়োজনীয় শব্দ-বিশ্লেষণ ও বাক্যবিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সহজে বোঝার জন্য তারকিব-ভিত্তিক শাব্দিক তরজমা তুলে ধরা হয়েছে। সর্বশেষে প্রতিটি আয়াতের সরল বাংলা তরজমা পেশ করা হয়েছে।
মেহেরবান আল্লাহ যদি ‘যিন্দেগির চেরাগে রৌশনি’ বহাল রাখেন তাহলে অপেক্ষাকৃত কঠিন আয়াতগুলোর নির্বাচিত অংশ (তৃতীয় বর্ষের জন্য) তৃতীয় ও চতুর্থ খ-রূপে প্রকাশ করার এবং পরবর্তী বর্ষের জন্য পূর্ণাঙ্গ ‘ইলমী তারজামাতুল কুরআন’ প্রকাশ করার নিয়ত রয়েছে।
(লেখাটি মাসিক আল-কাউসার থেকে নেওয়া হয়েছে)