আলহামদুলিল্লাহ। কুরআনুল কারীমের হিফজ ও তিলাওয়াতে দেশের ছেলেরা ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। হিফজ মাদ্রাসাসমূহের চেষ্টা সাধনা ও টিভি চ্যানেল ভিত্তিক বার্ষিক প্রতিযোগিতাগুলো বাংলাদেশে দক্ষ হাফেজ তৈরির পিছনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন দ্বীনী দাওয়াত ও সংস্কৃতি বিভাগের অবদান সব চেয়ে বেশি বলে মনে করি। কারণ, সঠিক বিচার ও বাছাইয়ের মাধ্যমে উপযুক্ত হাফেজ কারী নির্বাচিত করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যথা সময়ে প্রেরণ এবং তাদেরকে যাবতীয় দাপ্তরিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে এ বিভাগ দেশের মাদ্রাসা ও আলেম সমাজের নিকট বিপুল আস্থা অর্জন করেছে। যে কারণে গ্রাম গ্রামান্তরের শিশুরাও বিশ্বাস করে যে, ভালো হাফেজ হলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বিদেশ পাঠাবে। ছোট ছোট শিশু কিশোর ও তাদের দরিদ্র উসতাযগণ মক্কা মোকাররমায় পবিত্র উমরা ও হজ করার স্বপ্ন লালন করে শৈশব থেকেই। দুনিয়ার সম্মান ও আখেরাতে মহান আল্লাহ্ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনই মূল লক্ষ্য হয় অধিকাংশ হাফেজ আলেমের।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জাতীয় প্রতিযোগিতার খবর, আন্তর্জাতিক হিফযুল কুরআনে হিমালয় সম সাফল্য, এনটিভির পিএইচপি কুরআনের আলো, আরটিভির আলোকিত কুরআন, বাংলাভিশনে পবিত্র কুরআনের আলো, নিউজ ২৪ এর কুরআনের নূর, কোনটিতে সেরাদের সেরা, ক্ষুদে হাফেজ ইত্যাদি প্রোগ্রাম দেখে এখন সাধারণ শিক্ষিত মানুষও সন্তানদের হাফেজে কুরআন বানানোর দিকে ঝুঁকছেন। আলহামদুলিল্লাহ, জেনারেল শিক্ষিত পরিবারে এখন অনেক হাফেজ কারী আলেম তৈরি হচ্ছে। ফলে অনারব দেশ হওয়া সত্যেও এখন হাফেজের সংখ্যা বিচারে বাংলাদেশ পৃথিবীর দশ এগার ক্রমিকে অবস্থান করছে। এক থেকে পাঁচের মধ্যে লিবিয়া, মরক্কো, আলজিরিয়া, মিসর, সৌদি আরব বা ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া রয়েছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনুপাতে হাফেজের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবু পনের বিশ লাখ হাফেজ এদেশে আছেন। আলেম আছেন ত্রিশ চল্লিশ লাখের মত। প্রতিযোগিতার ব্যাপারে দেশের বড় আলেমগণ নিরুৎসাহিত করেন। ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বড় মাদ্রাসাসমূহ হাফেজ হওয়ার পরই ভালো আলেম হওয়ার জন্য ছেলেদের চাপের মধ্যে রাখার পক্ষপাতী। তাদের দাবিও যুক্তিসঙ্গত এবং বাস্তব বলে মনে করি। কারণ বেশিরভাগ সেরা হাফেজ ও কারী ভালো আলেম ও আমানতদার হয়ে দীনী খেদমতে নিয়োজিত হতে পারেন না। অর্থ ও খ্যাতি কি অনর্থের মূল? না। সবাই সমান নন। ইল্লা মার রাহিমাল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ। অনেক আল্লাহ্ ওয়ালা পরহেযগার আলেম হাফেজ কারী এই দেশের শহরে নগরে দীন ঈমানের আলো ও নববী আখলাক বিতরণ করে চলেছেন নিরবে নিভৃতে।
আয়তনে ছোট মাদ্রাসাসমূহের মেহনতে এবং মরহুম হাফেজ ফয়জুর রহমান, হাফেজ হাবীবুর রহমান, হাফেজ আব্দুর রহমান, হাফেজ কারী মো আব্দুল হক, হাফেজ বজলুল হক, হাফেজ তাজুল ইসলাম, হাফেজ কারী মো লিয়াকত আলী, হাফেজ মোঃ সাখাওয়াত, হাফেজ নূরুর রশীদ, হাফেজ নাসির উদ্দিন, হাফেজ মোঃ ইদরীস, হাফেজ আব্দুর রাজ্জাক, অধুনা হাফেজ কারী নাজমুল হাসান, হাফেজ আবু তাহের, হাফেজ নেসার আহমদ, হাফেজ আহমাদুর রহমান, মাহমুদুল হাসান, হাফেজ মুরতাজা হাসান, হাফেজ মোঃ সালমান, হাফেজ মো সাইফুল ইসলাম, হাফেজ নাজির মাহমুদ, হাফেজ মোঃ আবূ ইউসুফ, হাফেজ মুখতার আহমদ, হাফেজ মোঃ লুতফুর রহমান, হাফেজ আব্দুল আলীম, হাফেজ মাহফুজুর রহমান, হাফেজ দীন ইসলাম, হাফেজ জসিম উদ্দিন, হাফেজ হেদায়াতুল্লাহ, হাফেজ রহমাতুল্লাহসহ এই মুহূর্তে নাম স্মরণে আসছে না এমন অসংখ্য শ্রেষ্ঠ শিক্ষক প্রশিক্ষকের মেহনতে হিফজের ক্ষেত্রে আজকে বাংলাদেশ এই পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংগণে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি অবস্থানও দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। বিশেষ করে অতি দরিদ্র ও গ্রামীণ সমাজ থেকে উঠে আসা এসব শিশু কিশোরকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এমন মেধা ও প্রতিভা দান করেছেন যে শুধু দেশের মানুষের কাছে নয়, সারা বিশ্বের সামনে এটি একটি বিস্ময়কর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা সহ দেশের বেশ কিছু হিফজ মাদ্রাসা এসব শক্তিমান হাফেজ গড়ে তোলে নিবিড় পরিচর্যায়। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রেরণের জন্য সরকারের পক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশন অত্যন্ত নিপুণ বাছাই করে। ২০০৬ সন থেকে আমি এই বাছাইপর্বের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
আশির দশক থেকে হাফেজ মাওলানা মোফাজ্জল হোসাইন খান, হাফেজ মুঈনুল ইসলাম, মাওলানা মোখলেসুর রহমান, মাওলানা রফীক আহমদ মহল্লী, হাফেজ মোঃ জাফর, মুফতী মুহাম্মদ নূরুদ্দীন, হাফেজ মোঃ আবদুল হক, মাওলানা ইউসুফ আব্দুল মাজীদ, হাফেজ ড আব্দুল জলীল, মুফতী মুহিব্বুল্লাহ বাকী নদভী, মুফতী মো আব্দুললাহ, হাফেজ বিলাল হোসাইন, হাফেজ কারী গোলাম মোস্তাফা, কারী হাবীবুল্লাহ বেলালী, হাফেজ কারী আনওয়ার হোসাইন, হাফেজ কারী জহিরুল ইসলাম, হাফেজ কারী আবু রায়হান, হাফেজ কারী ইমদাদ, হাফেজ কারী রফীক আহমদ, হাফেজ কারী আরীফুদ্দীন মারূফ প্রমুখ বিচারকার্যে থাকতেন বা থাকেন।
বর্তমানে ইমাম হাফেজ কারী মীজানুর রহমান, হাফেজ কারী আহমদ বিন ইউসুফ, হাফেজ আশরাফুল হক, হাফেজ ইহসানুল হক, হাফেজ মহিউদ্দিন কাসেম, হাফেজ কারী আব্দুল্লাহসহ আরো কিছু নবীন হাফেজ কারী বিচারকার্য করেন। আমাদের ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ সব সময় অত্যন্ত গর্বের সাথে বলে থাকেন যে, হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতার বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা সুবিচার ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য কোন দিন কোন তদবির গ্রহণ করি না এবং কারো জন্য সুপারিশ করি না। এ বিষয়ে আমাদের মুফতী, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও ইমামগণ এবং বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ বিচারকদের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া আছে। তাদের মতামতকেই আমরা চূড়ান্ত বলে বিদেশে ফরোয়ার্ড করি।
ফলে কুরআনের হিফজ, তিলাওয়াত ও তাফসীরে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্ব দরবারে উজ্জ্বল থেকে আরো উজ্জ্বল হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নজরেও বিষয়টি আছে।
হাফেজ ড. ওয়ালীয়ুর রহমান খান
গবেষক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন