কেন বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ? কারণ ও প্রতিকার

নূর নিউজ:
ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ একটি পবিত্র বন্ধন এবং গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বিশ্বাসের ওপর স্থায়ী হয়। কোনো রক্তের বন্ধন নেই, তবুও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তাদের পারস্পরিক আস্থা, ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা সারাজীবন একটি সুন্দর সংসার করতে অনুপ্রাণিত করে। ইসলাম মানুষকে বিবাহের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে। বিবাহকে করেছে সহজ। একটি বৈবাহিক সম্পর্ক সর্বদা টিকে থাকুক এটিই ইসলাম চায়। এজন্য উভয় পক্ষকে ইসলাম বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা, দীক্ষা ও পরামর্শ দিয়েছে। দায়িত্ব ও উপদেশ দিয়েছে। সুসংবাদ দিয়েছে। দাম্পত্য জীবনে সুখের নিশ্চয়তা দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- “আর আল্লাহর নিদর্শনসমূহ থেকে তিনি তোমাদের জন্য স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করতে পার এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করে দিয়েছেন।” [সূরা রূম : ২১]
বাংলাদেশ বিশ্বের এমন একটি মুসলিমপ্রধান দেশ যেখানে পারিবারিক বন্ধন ও সুখ-দুঃখ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দাম্পত্য জীবন টিকিয়ে রাখার সংস্কৃতি আমাদের দেশে বহুকাল ধরে চলে আসছে। আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য পারিবারিক বন্ধনকে শক্তিশালী করার দিকে মনোনিবেশ করে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমরা আমাদের দেশে বিবাহিত জীবনের সংস্কৃতি থেকে মানুষ ধীরে ধীরে দূরে চলে যাচ্ছি। বর্তমানে প্রায়ই বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে যা আমাদের সংস্কৃতির সাথে সত্যিই বেমানান।

বিবাহবিচ্ছেদ কখনোই কাম্য হতে পারে না কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটা এখন আমাদের শহর ও গ্রামাঞ্চলে ঘটছে। আমাদের দেশে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। ইসলামে বিবাহবিচ্ছেদকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তবে নির্দিষ্ট কারণে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি রয়েছে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে রাসূল সা.-এর এই বাণী বর্ণিত হয়েছে যে-“আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় হালাল হচ্ছে তালাক।” [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২০১৮] এ হাদীস থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে একটি পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সম্পর্ক নষ্ট হওয়া আল্লাহতায়ালার খুব অপছন্দের। বিশেষ প্রয়োজনে, মানুষ যখননিরুপায় হয় তখন কেবল তালাক প্রয়োগ করবে। এটি অনন্যোপায়কালীণ ব্যবস্থা। তাই কারণে অকারণে, সামন্যতেই এর প্রয়োগ আল্লাহ তায়ালার অপছন্দ।

বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদের পরিসংখ্যান
বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছর ধরে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং সামান্য ঝগড়ার কারণে দাম্পত্য জীবন নষ্ট হচ্ছে। শুধুমাত্র ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনের সংখ্যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। একটি পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ সালের প্রথম ১৯০ দিনে ৪৭০০টি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে। প্রতি ১ ঘণ্টায় সিটি করপোরেশনে একটি পরিবার ভাঙার আবেদন জমা পড়েছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেশি। আরও উদ্বেগজনক খবর হলো বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে নারীদের কাছ থেকে এবং ৩০ শতাংশ পুরুষদের কাছ থেকে। বিবাহবিচ্ছেদের হার শিক্ষিতদের মধ্যে অনেক বেশি এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে কম। আরও একটি জরিপ দেখায় যে, ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্তÍ রাজধানী ঢাকায় বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা প্রায় ৭৫০০০ এবং প্রতিদিন ৫৫ থেকে ৬৫টি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ে। ২২ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখের একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুসারে, জুলাই থেকে অক্টোবর ২০২২ পর্যন্তÍ মাত্র পাঁচ মাসে বিবাহবিচ্ছেদের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে প্রতিদিন ৪৪টি তালাক হয়েছে, অর্থাৎ প্রতি ৪৫ মিনিটে একটি তালাক। কর্মজীবী স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি। চলতি বছরের পাঁচ মাসে ঢাকায় ৫৯৭০টি তালাক হয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে ১২০৫টি তালাক হয়। গত বছর গড়ে প্রতি মাসে ৯২০টি বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছে ২৯.৭৮ শতাংশ। ২০২২ সালে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ২০২১ সালের তুলনায় ১৮ শতাংশ বেড়েছে। এ বছর চট্টগ্রামে ৪৮৭৫টি বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। চলতি বছরের ১০ মাসে সিলেটে তালাকের আবেদন জমা পড়েছে ২ হাজার ৩৩৬টি।

কেন আমাদের সমাজে সংসারগুলো টিকছে না? বিশ্বাসগুলো কেন স্থায়ী হচ্ছে না? পারিবারিক বন্ধনগুলো কেন সামান্যতেই ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে দিন দিন? কেন ভয়ানক হারে বেড়ে চলছে বিবাহ বিচ্ছেদের ট্রাজেডি? এ প্রবন্ধে এর কিছু কারণ ও এর প্রতিকার নিয়ে আলোচনার প্রয়াস করবো ইনশাআল্লাহ।

বিবাহবিচ্ছেদের কারণ
এক. ধর্মীয় অনুশাসন ও সুশিক্ষার অভাব
অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ এটি। যদিও ধর্মীয় অনুশাসনের অধ্যায়টি অনেক বিস্তৃত। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক, একে অপরের হক সম্পর্কে সচেতনতা, বিনয় ও ছাড়ের মানসিকতা- এই সবই ধর্মীয় অনুশাসনের আওতাভুক্ত। এমনিভাবে পর্দা রক্ষা, পরপুরুষ বা পরনারীর সাথে সম্পর্ক ও মেলামেশা থেকে বিরত থাকা ইত্যাদিও বিশেষ ধর্মীয় অনুশাসন। এসব পালন না করাও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অবনতি ও বিবাহ বিচ্ছেদের উল্লেখযোগ্য কারণ।

ইসলামী শিক্ষায় পারস্পরিক হক রক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একে অপরকে কোনোভাবে-ই কষ্ট না দেওয়া, প্রত্যেকে অন্যের হক রক্ষায় সচেষ্ট থাকা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। ইসলাম শুধু অধিকারের কথা বলে না, কর্তব্যের কথাও বলে। স্বামী ও স্ত্রী প্রত্যেকেরই রয়েছে কর্তব্য এবং অধিকার। নিজের কর্তব্য পালন আর অন্যের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হলেই সবার শান্তি আসতে পারে।

কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- “আর স্ত্রীদেরও ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে, যেমন তাদের প্রতি (স্বামীদের) অধিকার রয়েছে।” [সূরা বাকারা : ২২৮]

দুই. পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে ভুল করা
বর্তমান সমাজে পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে ব্যাপক হারে ভুল করা হয়। আর সে ভুলের মাশুল দিতে হয় বিবাহ বিচ্ছেদের মাধ্যমে। হাজারো চেষ্টা করেও পরবর্তিতে এ সম্পর্ক টেকসই হয় না। দীনদ্বারী বা ধর্ম পরায়ণতা হল খোদা ভীরুতার গুণ প্রতিটি মুমিনের মধ্যে থাকা অপরিহার্য। নারীদের যাবতীয় গুণের মঝে এটি একটি আবশ্যকীয় গুণ। এ বিষয়ে হাদীসে এসেছে-

হযরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, “সাধারণত চারটি কারণে নারীদেরকে বিবাহ করা হয়। অর্থের কারণে, বংশীয় মর্যাদার কারণে, রূপের কারণে এবং ধর্ম পরায়নতার কারণে। সুতরাং তুমি দ্বীনদ্বার নারী বিবাহ করে সফল হও। তুমি ধন্য হবে।” [সহীহ বুখারী :৪৮০২; সহীহ মুসলিম :১৪৬৬]

হযরত আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, “যখন তোমাদের কাছে এমন কেউ বিয়ের প্রস্তাব প্রেরণ করে যার দ্বীনদ্বারী ও চারিত্রিক বিষয়ে তোমরা খোশ, তাহলে তাকে বিয়ে করাও (তোমাদের সন্তানের সাথে)। যদি এমনটি না কর, তবে যমিনে সৃষ্টি হবে বিশৃঙ্খলা ও ব্যাপক বিপর্যয়।” [জামে তিরমিযী : ১০৬৬, ১০০৫]

এ হাদীসে দ্বীনদ্বারী প্রাধান্য দেওয়ার জন্য রাসূল সা. আমাদেরকে বিশেষভাবে ওসিয়ত করেছেন। কেবল আর্থিক অবস্থান বা বাহ্যিক রূপ-গুণ দেখেই পাত্র-পাত্রী নির্বাচন শুদ্ধ নয়। যার ফলে পরবর্তিতে এ সংসার টেকসই হয় না। সুখের হয় না। আমাদের সমাজে এবিষয়টি বিশেষভাবে উপেক্ষিত। দ্বীনদ্বারী প্রধান্য দেওয়ার মানসিকতা ও বাস্তবতা আমাদের সমাজে খুবই কম।

তিন. তালাকের অপব্যবহার
বিবাহের বন্ধন তো অনেক শক্ত অনেক মজবুত। তাই সাধারণ কারনে তালাক নয়। পূর্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করে ব্যর্থ হলে, কোন আলেমের সাথে পরামর্শ করে তালাক প্রয়োগ করতে হয়। শরীয়তের নির্দেশনা হচ্ছে, শেষ পর্যন্তÍ বৈবাহিক সম্পর্ক রক্ষায় প্রয়াসী হওয়ার। তালাক ও বিবাহ-বিচ্ছেদের পর্যায়টি হচ্ছে সর্বশেষ পর্যায়, যা একান্ত অনিবার্য প্রয়োজনের স্বার্থেই বৈধ করা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য হতে পারে, ঝগড়া-বিবাদ হতে পারে, তা নিজেরাই মিমাংশা করে নেয়া চাই। যদি তা বড় আকার ধারণ করার আশংঙ্কা হয় তখন দুই পরিবার আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করবে। শালিস-সমঝোতাসহ যাবতীয় পূর্ব-পদক্ষেপ বিফল হয়ে গেলে যদি তালাকের পথে যেতেই হয় তবে কোনো নির্ভরযোগ্য আলেমের পরামর্শ নিয়ে তালাক দিবে। এক পবিত্র পিরিয়ড পার হয়ে পরবর্তি পবিত্র পিরিয়ডে সর্বোচ্চ প্রত্যাহার যোগ্য এক তালাক দিবে।

মনে রাখতে হবে, তালাক হলো চূড়ান্ত পর্যায়। তার পূর্বে অনেক ধাপ আছে। সাধারণ কারণে তালকের সিদ্ধান্ত নেয়া বোকামী ও কুরাআন-সুন্নাহ পরিপন্থি। এমনিভাবে কথায় কথায় তালাকের আলোচনা করা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নষ্ট করে। স্ত্রী মাঝে মাঝে বললেও আপনি সাবধান হোন।

চার . তালাকের দায়িত্ব নারীদের হাতে প্রদান করা
তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ একটি স্পর্শকাতর বিষয়। কেবলমাত্র বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যবহার করার অস্ত্র। অনেক ক্ষেত্রেই একবার হাত থেকে বেরিয়ে গেলে ফিরিয়ে আনার সুযোগ থাকে না। এর সিদ্ধান্ত ঠান্ডা মস্তিষ্কে, খুব ভেবে চিন্তে গ্রহণ করতে হয়। যা সাধারণত নরীদের কাজ নয়। তাই মৌলিকভাবে এ দায়িত্ব ইসলাম পুরুষকে দিয়েছে। যাতে বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। যখনই দায়িত্বের এ বোঝা নারীর কাঁধে তুলে দেওয়া হল, শুরু হয়ে গেল এর অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহার।

একাধিক জরিপে বিবাহ বিচ্ছেদে ৭০/৭২% নারীদের পক্ষ থেকে। তাই তালাকের অধিকার পুরুষের হাতে ন্যস্ত করার যথার্থতাও স্পষ্ট হচ্ছে। ইসলামী বিধানে তালাকের অধিকার পুরুষের হাতে ন্যস্ত করার পাশাপাশি পুরুষকে যে সকল গুণের অধিকারী হওয়ার এবং স্ত্রী ও পরিবার পরিচালনায় যে নীতি ও বিধান অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা পালনের মাধ্যমে কাঙ্খিত সুফল পাওয়া সম্ভব। ইসলাম স্ত্রীদেরকে ‘খোলা‘আ’র অধিকার দিয়েছে এবং স্বামী থেকে পাওয়া অধিকার বলে তালাকেরও ক্ষমতা দিয়েছে, যা আমাদের দেশের কাবিননামার ১৮ নং ধারায় উল্লেখ থাকে। সে ধারার গলদ ব্যবহার করেই নারীগণ পুরুষের চেয়ে ৩ গুণ বেশি তালাকের পথে হাঁটছে। এর থেকেই অনুমান করা যায় যে, যদি তারা সরাসরি তালাকের ক্ষমতা পেত তবে পরিস্থিতি আরো কত ভয়াবহ হতো।

পাঁচ. অধিক পরিমাণে অপরাধ ও গুণাহ করা, গুনাহে লিপ্ত থাকা
যে সংসারে আল্লাহর অবাধ্যতা থাকবে। সেখানে আল্লাহ শান্তি থাকবে না। যে স্বামী অনলাইনে-অফলাইনে, পত্রিকা-ম্যাগাজিনে পর নারীদের দেখে স্বাদ নেয়। অন্য মেয়েদের দেখেন। পাপ করেন। তিনি আসল সুখ ও মজা থেকে বঞ্চিত হন। স্ত্রী স্বামীর জন্য দুনিয়াতে উপভোগের সর্বোৎকৃষ্ট বস্তু। যখনই তিনি হালাল রেখে হারামের পথে পা বাড়ান, আল্লাহ তাকে এ সুখ ও মজা থেকে বঞ্চিত করেন। কারণ তিনি তার সুখের জন্য হারাম ও গুনাহের পথ অবলম্বন করেছেন। অপর দিকে তার স্ত্রীও একই পথে। তিনি পরপরুষের জন্য সাজ-গোজ করেন। তাদের সামনে নিজের সৌন্দর্য প্রকাশ করাসহ অনেক হারাম ও নাজায়েয কাজ করেন। হারামে আরাম থাকে না। হারাম বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে সুখ উঠে যাচ্ছে। পারিবারিক শান্তি হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবার ভেঙ্গে যাচ্ছে। এছাড়াও ঘর-বাড়িতে রহমত প্রবেশের সকল দরজা বন্ধ। সহীহ বুখারীতে হাদীস বর্ণিত হয়েছে, “ছবি বা কুকুর যে ঘরে থাকে তাতে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না।” [সহীহ বুখারী :৩২২৬] শোভা বর্ধনের নামে মূর্তি, পুতুল ঘরে প্রবেশ করার কারণে রহমতের ফেরেশতা ঘরে প্রবেশ করছে না। তাই অশান্তি বাড়ছে। পারিবারিক শান্তির জন্য শুধু পরিবারকেন্দ্রিক ইসলামী অনুশাসনগুলোই নয়, সাধারণ অনুশাসনগুলো মেনে চলাও জরুরী।

ছয়. স্ত্রীর প্রতি কঠোরতা ও জুলুম করা
অনেক ক্ষেত্রে এটিই বিবাহ বিচ্ছেদের বড় কারণ হিসেবে দেখা যায়। স্বামী বা স্বামীর আত্মীয়রা অবিচার করে স্ত্রীর প্রতি। স্বামী মনে করে আমি নেতা। সে চাকরানি। কী নির্বোধ! আপনি যদি তাকে চাকরানি মনে করেন তাহলে তো আপনি চাকরানির স্বামী। আর যদি রাণী ভাবেন তাহলে তো আপনি রাজা! এটি ভুল চিন্তা। আপনার স্ত্রী একজন রক্ত-মাংসের মানুষ। তার ভুল ত্রুটি হতেই পারে। তাকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। ইসলাম এটিই বলে। ইসলামে নারীর মর্যাদা বেশি। বাবার চেয়ে মায়ের মর্যাদা বেশি। কন্যা সন্তানদেরকে রাসূল সা. বেশি ভালবাসতেন। রাসূলের সর্বশেষ অসিয়তেও নারীদের বিষয় ছিল। রাসূল সা. বলেন, “তোমরা নারীদের ক্ষেত্রে আমার পক্ষ থেকে কল্যাণের অসিয়ত গ্রহণ কর।” [সহীহ বুখারী : ৩৩৩১]

সব কিছু ছেড়ে একটি মেয়ে স্বামীর ঘরে আসে। স্বামীর জন্য তার সব কিছু সে বিসর্জন দেয়। কত অসহায় সে তখন। আন্তরিকতার প্রয়োজন। সুতরাং স্বামী ও স্বামীর পরিবারের সকলকেই কঠোরতা পরিহার করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই এসব কারণে সম্পর্কে এত ত্ক্তিতা তৈরী হয় যা বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্তÍ গড়ায়। এটি মারাত্মক জুলুম। অনেক ইবাদতকারী হয়ে ধরা খেয়ে যাবেন অনেকে এর কারণে। স্ত্রীকে শারীরিক মানসিক কোন নির্যাতনই করা যাবেনা।

ইরশাদ হচ্ছে, “নারীদের সাথে তোমরা উত্তম উপায়ে জীবন যাপন কর। যদি তাদের কোন কিছু তোমাদরে অপছন্দ হয় তবে (শুনে নাও) হতে পারে তোমরা কোন বিষয় অপছন্দ করলে আর আল্লাহ তাতে তোমাদের জন্য অনেক কল্যাণ রেখেছেন।” [সূরা নিসা : ১৯]
স্ত্রীর কোন কাজ, কথা বা আচরণ অপছন্দের হলে এ আয়াত স্মরণ করুন। এতে আল্লাহ তায়ালা কল্যাণ দিবেন।

সাত. যৌতুক প্রথা
বিবাহ বিচ্ছেদের কারণগুলোর মধ্যে আরো যে কারণটির কথা উল্লেখ করা যায় তা হলো যৌতুক। ছেলে পক্ষ থেকে মেয়ে পক্ষের কাছ থেকে কোন কিছু তলব করা হয় বা চেয়ে নেওয়া সম্পূর্ণ অবৈধ ও ঘুষ। একে দেশীয় ভাষায় যৌতুক বলা হয় । সামাজিক ও ধর্মীয় উভয় দৃষ্টিকোন থেকেই এটা অত্যান্ত নিন্দনীয় ও জঘন্য অপরাধ। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে , নবী কারীম সা.বলেন, ‘‘ কারো জন্য অন্যের সম্পদ তার পূর্ণ মনোতুষ্টি ব্যতিত বৈধ নয়। [মুসনাদে আহমদ : ৫/৪২৫] এই যৌতুকের কারণে কত সংসার যে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে তার কোন হিসাব নেই। যৌতুকের জন্য স্বামী, স্বামীর পরিবারের সদস্যদের অত্যাচার-নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার হয় নারী, কখনো মৃত্যুর মাধ্যমেও যৌতুকের বলি হতে হয় তাকে। যৌতুক দাবি কিংবা নির্যাতনের কোনো বয়স বা সময় নেই। ৩৫ বছরের সংসারও ছেড়ে আসতে দেখা যায় নারীকে বিয়ে বিচ্ছেদের মাধ্যমে।

আট . তথাকথিত নারীসংগঠনের অপতৎপরতা
তথাকথিত অনেক নারী সংগঠন রয়েছে। এদের কিছু কর্ম তৎপরতা ভালো হলেও এমন অনেক অপতৎপরতাও রয়েছে, যা পরিবারিক বন্ধন নষ্ট করা ও বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখছে। এরা নারীদেরকে ভুল বুঝায়। উস্কানি দেয়। স্বামীর গোলামী করবে কেন? নিজের পায়ে দাঁড়াও! প্রচারণায়, পত্রপত্রিকায়, সিনেমায়, নাটকে এবং অনলাইন অফলাইন সব জাগায় তারা নারীদেরকে বিপথগামী করে। বিভিন্ন উস্কানিমূলক শ্লোগান দেয়। আমাদের সমাজে সাধারণত স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে ভালবাসে। কখনো কিছু টুকটাক হয়ে গেলেও উভয়ে চায়, যেকোন ভাবে সমাধান হোক। কিন্তু এরা নারীদেরকে ফুসলিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্তÍ নিয়ে পৌঁছায়।

ইসলামে নারী-পুরুষ উভয়ের দায়িত্ব স্পষ্ট। পরিবারের ভরণ-পোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পুরুষের। কাজেই পুরুষ বাইরে উপার্জন করবে আর নারী ঘরে সংসার ও সন্তানদের আদব-তরবিয়ত ও লেখাপড়ায় সময় দেবে- মৌলিকভাবে এটাই স্বাভাবিক পদ্ধতি। এর বিপরীতে নারী-স্বাধীনতা বা নারীর স্বাবলম্বিতার নামে নারীকে উপার্জনে বের করার যে সংস্কৃতি এর কুফল ইতোমধ্যে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। খোদ সমাজ-চিন্তকেরাই এখন স্বীকার করছেন যে, বিবাহ-বিচ্ছেদের এক বড় কারণ, নারী বাইরে বের হওয়া এবং পর-পুরুষের সাথে অবৈধ মেলামেশা। অথচ অন্য ক্ষেত্রে নারীর স্বাবলম্বিতার তথা বাইরের জগতে বিচরণের বর্তমান ধারার পক্ষে নারী-নির্যাতনের বিষয়টিকে কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, এর দ্বারা নারী নির্যাতন তো কমছেই না, বরং বাড়ছে, একইসাথে সংসারও ভাঙছে। কাজেই গোড়া থেকেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। একান্ত আর্থিক সমস্যা ছাড়া নারীদেরকে রোজগারের জন্য ঘরের বাইরে বের করবে না, বরং স্বামীরাই স্ত্রী-সন্তানের খরচাদির ব্যবস্থা করবে।

নয়: পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়া
পরকীয়া অতি পরিচিত একটি শব্দ। ভীতিকরও বটে। এই শব্দটি সংসার ভাঙে, ভবিষ্যৎ নষ্ট করে, পারিবারিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে চরম প্রতিবন্ধক ‘পরকীয়া’ শব্দটি। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে পরকীয়ার দৌরাত্ম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। একই ছাদের নিচে বসবাস করা দুই নারী-পুরুষ একই বিছানায় বিপরীত মুখে শুয়ে পরকীয়া করছেন। একটা সময় এটি ছিল শহরের চিত্র। এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও নর-নারীর সম্পর্কে ‘পরকীয়া’ শব্দটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মোবাইল ফোনের সহজলভ্য ব্যবহার পরকীয়ার মূল শক্তি। আয়-রোজগারের উদ্দেশ্যে স্বামী অথবা স্ত্রী বিদেশে গেছে। দেশে অবস্থানরত স্ত্রী এবং স্বামী পরকীয়ায় লিপ্ত। এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে। আবার দেশেও কোনা কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতের মিল শুরু হলে, যৌন অতৃপ্তির কারণ দেখা দিলে, অথবা অর্থনৈতিক দৈন্যতায় পরকীয়ায় কাতর হচ্ছেন অনেকে। ফলে হঠাৎ করেই সুখের সংসার ভেঙে যাচ্ছে। পারিবারিক মূল্যবোধ নষ্ট হচ্ছে। তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় খুনের ঘটনাও ঘটছে।

দশ: সোশাল মিডিয়া, অশ্লীল সিনেমা ও টিভি সিরিয়াল
বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। এই দেশের কৃষ্টি ও সামাজিক ঐতিহ্য চরমভাবে হুমকির মুখে পড়েছে অশ্লীল নাটক, সিনোমা ও টিভি সিরিয়ালের কারণে। চরম মস্তিষ্ক বিকৃতিমূলক এসব টেলি প্রোগ্রামের কারণে দেশে খুন, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ-ব্যভিচারসহ বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে।

ভারতীয় চ্যানেলের সিরিয়াল বর্তমানে বাংলাদেশে একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। হিন্দি সিরিয়ালের শিক্ষনীয় কোন বিষয় না থাকলেও এর দর্শক দিন দিন বেড়েই চলেছে। বরাবারের মতো টেনে-হিঁচড়ে এসব সিরিয়াল এমনভাবে লম্বা করা হয় যে, এর শেষ পর্ব কবে প্রচারিত হবে তা কেউ যেমন জানে না তেমনি আন্দাজও করতে পারে না। হিন্দি সিরিয়ালের মধ্যে যে সব ম্যাসেজ বা বার্তা থাকে তা একটি পরিবার তথা সমাজ কে ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট।

এগার: ইন্টারনেট ও সোশাল মিডিয়ার অপব্যবহার
সামাজিক ভারসাম্য বিনষ্ট করার মাধ্যম হয়ে উঠেছে ফেসবুক, টুইটার, টিকটক, ইউটিউবসহ তথাকথিত সোশাল ও অনলাইন মিডিয়াসমূহ। এসব মাধ্যমে নানা কর্ম আর অপকর্ম নষ্ট করছে সমাজ, সংস্কৃতি আর ভাঙছে ঘর-সংসার। দুর্বল হচ্ছে সামাজিক বন্ধন, বাড়ছে মানুষে মানুষে সম্পর্কের দূরত্ব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব অনলাইন মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবহার করে মানুষ হয়ে উঠছে সামাজিক যোগাযোগ ও ডিজিটাল মাধ্যম নির্ভর। অবক্ষয় হচ্ছে সামাজিক অনুশাসন ও মূল্যবোধের। বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক ভারসাম্য ও সম্পর্ক। অনেকের সাজানো গোছানো সুখের সংসারও ভেঙে যাচ্ছে এসব যোগাযোগ মাধ্যম ও ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মগুলোর কারণে।

বারো: খুব রাগী হওয়া। ধৈর্য না থাকা
সংসার করতে গেলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে টুকটাক ঝগড়া ঝাটি হবেই। তবে এই ঝগড়াঝাটিকে সংসারের ভিতরেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। আর কোন বিষয়ে মতনৈক্য দেখা দিলে দু’জনে মিলে সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। তাহলে সংসার সত্যিই সোনার সংসার হিসেবে রূপ নিবে। এক্ষেত্রে রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। যদি তা না করা যায়, তাহলে দাম্পত্য জীবনে বিচ্ছেদেও পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। বর্তমানে হচ্ছেও। অনেকে বলে থাকেন, তালাক দেওয়ার সময় মাথা ঠিক ছিল না। রাগে তালাক দিয়ে দিয়েছি। যদি রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে এই ব্যাধি থেকে সংসারকে মুক্ত রাখা সম্ভব।

তের: স্ত্রীকে যথাযথ ভরণ-পোষণ না দেওয়া
বিয়ের পর থেকেই স্বামীর ওপর স্ত্রীর জন্য বেশি অধিকার সাব্যস্ত হয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো স্ত্রীর ব্যয়ভার গ্রহণ করা। ইসলামি শরিয়তের বিধান মতে স্বামীকে স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে হবে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- সন্তানের পিতার ওপর সন্তানের মায়ের জন্য অন্ন-বস্ত্রের উত্তম পন্থায় ব্যবস্থা করা একান্ত দায়িত্ব।-সুরা বাকারা, আয়াত : ২৩৩।

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী নিজেদের ঘরে বাসস্থানের ব্যবস্থা করো।’ (সুরা তালাক, আয়াত : ৬) তবে শরিয়ত স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ব্যাপারে নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারিত করে দেয়নি। বরং স্ত্রীকে প্রয়োজন পরিমাণ ভরণ-পোষণ দেওয়া স্বামীর কর্তব্য। এটাই শরিয়তপ্রদত্ত নিয়ম ও নির্দেশনা। আর পরিমাণটি পরিবেশ-পরিস্থিতি, অবস্থা ও স্বামীর সামর্থ্যনির্ভর। (ফাতহুল কাদির : ৩/১৯৪; আল-মুহিতুল বুরহানি : ৩/৫২৯-৫৩০)
বর্তমানে দেখা যায়, অনেক স্বামী স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্বে অবহলা করে বা রাগ করে ভরণ পোষণ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। স্ত্রী আর এই স্বামীর সাথে সংসার করতে চায় না। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে।

চৌদ্দ: মাদকাসক্তি, পুরুষত্বহীনতা এবং বন্ধ্যাত্ব
স্বামী মাদকাসক্ত, পুরুষত্বহীন এবং স্ত্রীর বন্ধ্যাত্বের কারণেও বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে। ইসলামি বিধানমতে মাদক গ্রহণ হারাম হওয়ার পাশাপাশি তা অপবিত্রও। কোনো মুসলমানের মাদক ব্যবহার করা যেমন হারাম, অনুরূপভাবে তা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণ করা এবং ক্রয়-বিক্রয় করা সম্পূণরূপে নিষিদ্ধ ও গুনাহের কাজ। দাম্পত্যজীবনে সুখী হতে
ও সুস্থ জীবন-যাপন ও স্থিতিশীলতার জন্য মাদক পরিহার করতে হবে। শারীরিক অক্ষমতা, যৌন ব্যাধি, যৌনবিকারগ্রস্ত স্বামী বিবাহবিচ্ছেদের একটি অন্যতম কারণ, এটি লজ্জা কিংবা গোপন করার বিষয় নয়। স্বামীর পুরুষত্বহীনতা এবং স্ত্রীর বন্ধ্যাত্বের জন্য সঠিক চিকিৎসা করতে হবে।

মানব জীবনে তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদের প্রভাব
বিবাহবিচ্ছেদের কারণ যাই হোক না কেন, তালাকের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। বিবাহবিচ্ছেদের এই সংস্কৃতি একদিকে যেমন পারিবারিক শৃঙ্খলা নষ্ট করে অন্যদিকে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে। সন্তানরা বেড়ে ওঠে ‘ব্রোকেন ফ্যামিলির’ সন্তান হিসেবে। যা তাদের স্বাভাবিক মানসিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। তারা এক ধরনের ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে’ ভোগে। মনোচিকিৎসকরা মনে করেন, ‘‘সন্তানরা যদি বাবামায়ের স্বাভাবিক সঙ্গ এবং ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে তাদের জীবন হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক। তারা সমাজকে, পরিবারকে নেতিবাচক হিসেবেই দেখে। তাদের মধ্যে জীবনবিমুখতা তৈরি হয় যা ভয়াবহ।”

বিবাহবিচ্ছেদ নারীদেরও অনেক কষ্ট দেয় এবং তারা সমাজের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়। নারীরা তাদের দ্বিতীয় বিয়ের সময়ও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হন এবং এর ফলে অনেক নারী তাদের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
তালাকপ্রাপ্ত স্বামী-স্ত্রীকে সমাজে অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। তাই বিবাহবিচ্ছেদ এড়াতে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই চেষ্টা করা দরকার। দাম্পত্য জীবনে ছোটখাটো ভুল ধারণা থাকতে পারে, কিন্তু তার ভিত্তিতে সংসার ভেঙে যাওয়া কখনোই কাম্য হতে পারে না। বিবাহ একটি পবিত্র বন্ধন এবং এটিকে মূল্য দিতে শিখতে হবে।

তালাকের মতো খারাপ কাজ এড়াাতে যা করতে পারেন: ১. ধর্মীয় নির্দেশ মেনে চলা। ২. স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েরই পরিবারের কাজ ভাগ করে নেওয়া উচিত এবং একে অপরের কাজের প্রশংসা করা উচিত। ৩. স্বামী এবং স্ত্রীর একে অপরের সমালোচনা করা উচিত নয় এবং কিছু ভুল হলে তাদের ক্ষমা করার মানসিকতা থাকা উচিত। ৪. তাদের তুচ্ছ বিষয় নিয়েও তর্ক করা উচিত নয় এবং সামান্য ভুল বোঝাবুঝি হলেও নিজেকে সংযত করার জন্য ধৈর্য ধরতে হবে।

সদ্য বিচ্ছেদ হওয়া এক নারীর অভিমত
ঢাকায় সদ্য বিচ্ছেদ হওয়া এক নারীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন আমাদের নূর নিউজ টুয়েন্টিফোর-এর একজন প্রতিনিধি।
সেই নারী জানান, বিচ্ছেদটা আসলে তিনি নিজেও চাননি। ভালবেসে এক মেধাবী তরুণকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। তাঁর মতে, বিয়ের আগের সেই পুরুষটি বিয়ের পরে অন্যরকম হয়ে যান। সারাক্ষণ সন্দেহ, আগের বন্ধুদের সহ্য না করা এসব নিয়ে সমস্যাতো আছেই এমনকি গায়ে হাত তুলতেও নাকি পিছপা হন না। তাই বিয়েটি এক বছরের বেশি টেকানো যায়নি। তিনি বলেন, ‘‘সন্তান আসার আগেই বিচ্ছেদ হওয়ায় ভালো হয়েছে। সন্তান থাকলে তাদের উপর বিচ্ছেদের নেতিবাচক প্রভাব পড়তো। এখন যা হবার তা আমার নিজের হলো।”

তবে একই রকম বিচ্ছেদের কাহিনী পুরুষের দিক থেকেও আছে। আর এসবে পরস্পরকে দোষারোপ অবধারিত। তবে কথা বললেই বোঝা যায় কোন পক্ষই এখন আর মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করতে চায় না। তাই পরিবারে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ।

বিবাহ বিচ্ছেদের আরও একটি গাণিতিক পরিসংখ্যান
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দু’টি এলাকায় ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্তÍ তালাক কার্যকর হয় ২৩০৯টি, যার মধ্যে ১৬৯২টি স্ত্রী কর্তৃক আর স্বামী কর্তৃক ৯২৫টি। ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্তÍ তালাকের সংখ্যা ৩৫৮৯টি। এর মধ্যে ২৩৮১টি স্ত্রী কর্তৃক আর স্বামী কর্তৃক হয়েছে ১২০৮টি। এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, তালাক দেয়া পুরুষ ৩০ শতাংশ, আর নারী ৭০ শতাংশ।

একাধিক পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে মাত্র তিন বছরে ঢাকা শহরে তালাকের পরিমান বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের নারীদের আইনী সহায়তা কেন্দ্রের একজন কর্মকর্তার অভিমত, যত অভিযোগ নারীরা তাদের কাছে নিয়ে আসেন তার মধ্যে ৬০ ভাগেরও বেশি সন্তানকে নিজের কাছে রাখার দাবি জানিয়েছেন।

এছাড়া নানা কারণে কিছু নারী-পুরষ উভয়ই বিয়ের পর বিবাহ বহির্ভূত রোমান্সেও জড়াচ্ছেন বলে মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। আর তাও বিচ্ছেদ ডেকে আনছে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হল বিশ্বাসহীনতা। নানা কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাসহীনতা বাড়ছে। এখন দু’জনই কাজ করছেন, বাইরে যাচ্ছেন। তাদের সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতি জনের সঙ্গে মিশছেন কথা বলছেন। আর এটা যে বাইরেই তা নয়। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এই যোগাযোগ সার্বক্ষণিক যোগযোগে পরিণত হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পরিচিতি এবং সম্পর্কের বহুমুখী ধারা তৈরি করেছে। আর এখানে স্বচ্ছতা না থাকলেই বিপর্যয়।

বিচ্ছেদ ঠেকাতে করণীয়
বিবাহবিচ্ছেদ পিছনে মৌলিক যে কারণগুলো থাকে সেগুলো হল, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের হক যথাযথ আদায় না করা। একজন অন্যজনকে গুরুত্ব না দেওয়া। কথায়-কাজে অযথা দ্বিমত পোষণ করা। একে অন্যের প্রতি আস্থা না রাখা, বিশ্বাস না করা। এ সকল কারণে একসময় তাদের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ চরমে পৌঁছে এবং দাম্পত্য জীবন ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়। সুতরাং উভয়ের কর্তব্য হল, পরস্পরের হকগুলো যথাযথভাবে জানা এবং তা আদায় করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। কোনো ক্ষেত্রে দোষ-ত্রুটি হয়ে গেলে তা অকপটে স্বীকার করে নেওয়া এবং দ্রুত সেটাকে শুধরে নেওয়া। এভাবে সবকিছুকে সহজভাবে মেনে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। তাহলে সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে। এরকম শুধরে নেওয়া ও মেনে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে না তুললে সামান্য মনোমালিন্যেও অন্তরে প্রচন্ড কষ্ট অনুভব করবে। নিন্মে স্বামী-স্ত্রীর কিছু শরয়ী হক তুলে ধরা হল:-

স্বামীর ওপর স্ত্রীর হকসমূহ
১. স্ত্রীর সাথে সর্বদা ভালো আচরণ করা। ২. স্ত্রীর কোনো কথায় বা কাজে কষ্ট পেলে ধৈর্য্য ধারণ করা।৩. উচ্ছৃঙ্খল, বেপর্দা চলাফেরা করতে থাকলে নম্র ভাষায় তাকে বোঝানো। ৪. সামান্য বিষয়ে নিয়ে স্ত্রীর সাথে ঝগড়া-বিবাদ না করা। কথায় কথায় ধমক না দেওয়া। রাগ না করা। ৫. স্ত্রীর আত্মমর্যাদায় আঘাত করে এমন বিষয়ে সংযত থাকা। শুধু শুধু স্ত্রীর প্রতি কুধারণা না করা। স্ত্রীর সম্পর্কে উদাসীন না থাকা। ৬. সামর্থ্যানুযায়ী স্ত্রীর খোরপোষ দেওয়া। অপচয় না করা। ৭. নামায পড়া এবং দ্বীনের আহকাম মেনে চলার জন্য উৎসাহ দিতে থাকা। হায়েয-নেফাসের মাসআলাগুলো ভালোভাবে শিক্ষা দেওয়া। শরীয়ত পরিপন্থী কাজ থেকে বিরত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা। ৮. একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের মাঝে সমতা রক্ষা করা। ৯. চাহিদানুযায়ী তাদের সাথে মেলামেশা করা। ১০. অনুমতি ব্যতীত আযল অর্থাৎ মেলামেশার সময় শেষ মুহূর্তে স্বাভাবিক স্থান ত্যাগ না করা। ১১. একাšন্ত নিরুপায় না হলে তালাক না দেওয়া এবং প্রয়োজনের ক্ষেত্রে শরীয়ত-গৃহীত পন্থায় তালাক দেওয়া। ১২. প্রয়োজন মাফিক থাকা-খাওখার ব্যবস্থা করা। ১৩. মাঝে মাঝে স্ত্রীর নিকটাত্মীয়দের সাথে দেখা-সাক্ষাত করার সুযোগ করে দেওয়া। ১৪. স্ত্রীর সাথে মেলামেশার চিত্র অন্যের কাছে বর্ণনা না করা। ১৫. প্রয়োজনে স্ত্রীকে শাসন করা। সতর্ক করা। এক্ষেত্রে শরীয়ত যতটুকু অনুমতি দিয়েছে তার চেয়ে অতিরিঞ্জত না করা।

স্ত্রীর ওপর স্বামীর হকসমূহ
১. সর্বদা স্বামীর মন জয় করার চেষ্টা করা। ২. স্বামীর সাথে অসংযত আচরণ না করা। স্বামীকে কষ্ট না দেওয়া। ৩. শরীয়তসম্মত প্রত্যেক কাজে স্বামীর আনুগত্য করা। গুনাহ এবং শরীয়ত বিরোধী কাজে অপারগতা তুলে ধরা এবং স্বামীকে নরম ভাষায় বোঝানো। ৪. প্রয়োজনাতিরিক্ত ভরণ-পোষণ দাবি না করা। ৫. পরপুরুষের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক না রাখা। ৬. স্বামীর অনুমতি ছাড়া কাউকে ঘরে প্রবেমের অনুমিত না দেওয়া। ৭. অনুমতি ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়া। ৮. স্বামীর সম্পদ হেফাযত করা। অনুমতি ছাড়া সেখান থেকে কাউকে কোনো কিছু না দেওয়া। ৯. স্বামীকে অসন্তুষ্ট করে অতিরিক্ত নফল নামাযে মশগুল না থাকা। অতিরিক্ত নফল রোযা না রাখা। ১০. স্বামী মেলামেশার জন্য আহবান করলে শরীয়তসম্মত কোনো ওযর না থাকলে আপত্তি না করা। ১১. স্বামীর আমানত হিসেবে নিজের ইজ্জত-আব্রু হেফাযত করা। কোনো ধরনের খেয়ানত না করা। ১২. স্বামী দরিদ্র কিংবা অসুন্দর হওয়ার কারণে তাকে তুচ্ছ না করা। ১৩. স্বামীকে কোনো গুনাহের কাজ করতে দেখলে আদবের সাথে তাকে বিরত রাখা। ১৪. স্বামীর নাম ধরে না ডাকা। ১৫. কারো কাছে স্বামীর বদনাম, দোষ-ত্রুটি বর্ণনা না করা।১৬. শ্বশুর-শাশুড়িকে সম্মানের পাত্র মনে করা। তাদেরকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করা। ঝগড়া-বিবাদ কিংবা অন্য কোনো উপায়ে তাদের মনে কষ্ট না দেওয়া। ১৭. গন্তানদের লালন-পালনে অবহেলা না করা।

উপসংহার:
স্বামী-স্ত্রীর উচিৎ পরস্পরের শরয়ী হক যথাযথ আদায় করা এবং বিবাহ বিচ্ছেদের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে সমঝোতার মাধ্যমে তার সমাধানের পথ খুঁজে বের করা। কথায় আছে, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’। তবে একথাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ সংসার শুধু রমণীর গুণে সুখের হতে পারে না। যদি পুরুষের গুণ না থাকে। তাই আমরা মনে করি, সংসার সুখের হয় নারী-পুরুষ উভয়ের গুণে। তবে নারীদেরকে একটু বেশী গুণী হওয়া উচিত। তবেই সংসার সুখের হবে। মনে রাখবেন, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক অনুশাসন এবং সমাজের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের ইতিবাচক হস্তক্ষেপই বিবাহবিচ্ছেদ রোধ করতে পারে। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের আত্মত্যাগের ওপর দাম্পত্য জীবন টিকে থাকে। যে দম্পতি ত্যাগ করতে শিখবে তারা সুন্দর জীবন উপভোগ করতে পারবে।

লেখক: মুফতী মুহাম্মদ ইসমাঈল। প্রিন্সিপাল, আন-নূর কালচারাল সেন্টার, নিউইয়র্ক

এ জাতীয় আরো সংবাদ

কোরবানির পশুর চামড়ার টাকা মসজিদে দান করা যাবে?

নূর নিউজ

শিশুর খৎনা করানো হয় কেন?

নূর নিউজ

সরাইলে নেতাকর্মীদের সাথে আবুল হাসানাত আমিনীর মতবিনিময়

নূর নিউজ