জুবায়ের আহমদ
ঘুম, প্রাণী জগতের জন্য মহান আল্লাহ তা’লার অপার নিয়ামত। প্রতিটি প্রাণীর সুস্থ-সবল জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজন পরিমিত ঘুম। মানবজাতির ব্যস্ততম জীবনের সুস্থতা ও সফলতার জন্য পরিমিত ঘুমের বিকল্প নেই।
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- ‘ঘুমকে তোমাদের জন্য করেছি প্রশান্তি দানকারী বা বিশ্রামের জন্য। আর রাতকে করেছি তোমাদের জন্য আবরণস্বরূপ (বা বিশ্রামের সময়) এবং দিনকে করেছি তোমাদের জন্য জীবিকা নির্বাহের জন্য।’ (সূরা নাবা আয়াত : ৯-১১)।
‘এবং তিনিই তোমাদের জন্য রাতকে করেছেন আবরণস্বরূপ, বিশ্রামের জন্য তোমাদের দিয়েছেন ঘুম।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৪৭)
ভোর হতেই দিন শুরু করতে পারা আর সকাল ১০ কিংবা ১১টায় শুরু করার মধ্যে বেশ পার্থক্য। ৯টা-৫টা অফিস: কর্মঘন্টা ৮ ঘন্টা। ঘুম ১২টারও পর!
অন্যদিকে ভোর ৫টা-রাত ৯টা পরিশ্রম: কর্মঘন্টা ১৬। ঘুম রাত ৯টায়! কোনটি উত্তম?
নিম্নে নেট থেকে পাওয়া সাম্প্রতিক সময়ের বিশ্বের বিখ্যাত কিছু সফল মানুষদের জীবনাচার তুলে ধরা হলো।
অ্যাপলের চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার টিম কুক দিন শুরু করেন ৩.৪৫ এএম এর মধ্যে। আমরা অনেকেই যখন ঘুমাতেই যাই, আর ভীষণ ইগো নিয়ে বলি, “আমি এমনই”। দ্য ভিঞ্চি কোড বইয়ের লেখক ড্যান ব্রাউন উঠেন ভোর চারটায়। অপরাহ উইনফ্রে আর মিশেল ওবামাও এরকম সকালবেলার পাখি।
ভ্যানগার্ড গ্রুপের চেয়ারম্যান বিল ম্যাকনব উঠেন ভোর পাঁচটায়, সোয়া ছয়টার মধ্যে পৌঁছে যান তাঁর কাজের জায়গায়।তিনি বলেন, গত ত্রিশ বছরে আমার ঘুমের সময়ের হেরফের হয়েছে মাত্র ত্রিশ মিনিট।ছয়টা থেকে সাড়ে সাতটা, এই সময়টাকে তিনি নিস্তব্ধ সময় মনে করেন, তখন তাঁর কাজ সবচেয়ে ভাল হয়।
ওয়াশিংটন স্টেটের অ্যাটর্নি জেনারেল বব ফার্গুসন ভোর পাঁচটায় উঠেন, পরিবারের জন্য নাস্তা বানান, তারপর কাজে মন দেন। তার ভাষায়- ”দিনের শুরুটা কেমন হলো, এটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
এমআইটির প্রেসিডেন্ট রাফায়েল রেইফও উঠেন পাঁচটায়। সফল মানুষেরা এরকম ভোরের পাখিই।
ইসলাম মানুষের প্রাত্যহিক জীবনাচারের বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। রাসুল সা. আমাদের অনুকরণীয়। তিনিও তাঁর উম্মতকে ঘুমের প্রতি গুরুত্ব দিতে বলেছেন। তিনি নিজেও খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেতেন। সফল হতে চাইলে আমাদেরও ইশার নামাজ আদায়ের পর আর কোনো কাজ না করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে। এটিই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনা এবং সারা জীবনের আমল। তিনি সন্ধায় ঘুমানো এবং ইশার নামাজের পর না ঘুমিয়ে গল্প-আড্ডা দেওয়া পছন্দ করতেন না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোকেও অনেক রাত করে ঘুমানো সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়।
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইশার নামাজের আগে ঘুমাননি এবং তারপর নৈশ আলাপ করেননি। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৭০২)। অন্যত্র বলা হয়েছে, আবু বারজাহ আল-আসলামি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইশার নামাজের আগে ঘুমানো এবং ইশার পর কথাবার্তা বলা পছন্দ করতেন না। (বুখারি, হাদিস : ৭৩৭, মুসলিম, হাদিস : ১৪৯৪)
ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদ, যা রাতের শেষাংশে আদায় করতে হয়। রাসুল (সা.) নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে উদ্বুদ্ধ করতেন। ভোরে উঠে পবিত্র হয়ে নামাজ আদায় করতে পারলে প্রফুল্লচিত্তে এবং পবিত্র মনে সকাল শুরু হয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন ঘুমায়, তখন শয়তান তার মাথার শেষভাগে তিনটি গিরা দেয়। প্রতিটি গিরার সময় সে এ কথা বলে কুমন্ত্রণা দেয় যে এখনো রাত অনেক রয়ে গেছে, শুয়ে থাকো। অতঃপর সে ব্যক্তি যদি জেগে ওঠে এবং আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন একটি গিরা খুলে যায়। অতঃপর যদি সে অজু করে, তবে দ্বিতীয় গিরা খুলে যায়। আর যদি সে নামাজ আদায় করে, তাহলে সব গিরাই খুলে যায়। ফলে প্রফুল্লতার সঙ্গে পবিত্র মনে তার সকাল হয়, অন্যথায় আলস্যের সঙ্গে অপবিত্র মনে তার সকাল হয়।’ (বুখারি, হাদিস : ৩০৯৬)
ফজরের নামাজের পর সকালের ঘুম জীবন-জীবিকার বরকত নষ্ট করে দেয়। দিনের শুরুটা ঘুমে কেটে যাওয়ার ফলে দিন সংকীর্ণ হয়ে যায়। কাজের সময় ও পরিধি কমে যায়। পক্ষান্তরে ফজরের নামাজ আদায়, কোরআন তিলাওয়াত এবং ইশরাক নামাজ আদায়ের মাধ্যমে দিনের কার্যক্রম শুরু করতে মহান আল্লাহ সারা দিনের জন্য বান্দার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফলে দিনটি হয়ে ওঠে বরকতময়। হাদিসে সকালের ঘুম বর্জনের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। সাখর আল-গামিদী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমার উম্মতকে ভোরের বরকত দান করুন।’ তিনি কোনো ক্ষুদ্র বা বিশাল বাহিনীকে কোথাও প্রেরণ করলে দিনের প্রথমভাগেই প্রেরণ করতেন। বর্ণনাকারী সাখর (রা.) একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি তাঁর পণ্যদ্রব্য দিনের প্রথমভাগে পাঠানোর ফলে অনেক সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৬০৮)
ঘুমানোর কয়েকটি সুন্নত ও আদব : ১. আল্লাহর নাম স্মরণ করে খাবারের বাসনপত্র ঢেকে রাখা, ঘরের দরজা বন্ধ করা এবং বাতি নিভিয়ে ঘুমের অনূকুল পরিবেশ তৈরি করে ঘুমানো। (বুখারি, হাদিস : ৩১০৬)
২. হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুমানো। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮৫৪)। অজু করে নেওয়া আরো উত্তম।
৩. বিছানা ঝেড়ে নেওয়া। (বুখারি, হাদিস : ৫৯৬১)
৪. ডান কাত হয়ে শোয়া। (বুখারি, হাদিস : ৫৯৫৬)
৫. ঘুমানোর দোয়া ‘আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া’ পড়ে ঘুমানো। (বুখারি, হাদিস : ৬৯৬৫)।
৬. ‘আয়াতুল কুরসি’ পাঠ করে ঘুমানো। (বুখারি, হাদিস : ৩১০)
৭. সুরক্ষার জন্য সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস পড়ে দুই হাতে ফুঁ দিয়ে মাথা থেকে দেহ পর্যন্ত যত দূর হাত যায় বুলিয়ে ঘুমানো। (বুখারি, হাদিস : ৪৭২৯)
৮. ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে ‘আলহামদু লিল্লাহি-ল্লাজি আহয়্যানা বাদা মা আমাতানা ওয়া ইলাইহিন নুশুর’ পাঠ করা। (বুখারি, হাদিস : ৬৯৬৫)
তথ্য ঋণ- ইন্টারনেট ও বিভিন্ন ইসলামি গ্রন্থ
লেখক- তরুণ আলেম ও কলামিস্ট