জঙ্গিবাদে অর্থায়নের দায়ে বাংলাদেশি এক নির্মাণ শ্রমিককে ২ বছর ৮ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন সিঙ্গাপুরের একটি আদালত। সিরিয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠীর কাছে দফায় দফায় অর্থ পাঠানোর প্রমাণ পাওয়ায় সোমবার তাকে এই সাজা দেওয়া হয়েছে।
সিঙ্গাপুরের ইংরেজি দৈনিক দ্য স্ট্রেইট টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশে জঙ্গিবাদে অর্থায়নের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত ওই বাংলাদেশির নাম আহমেদ ফয়সাল (২৭)। সিরিয়ার স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের কাছে তিনি ১৫ দফায় ৯০০ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি প্রায় ৭৭ হাজার ৬৮০ টাকা) পাঠিয়েছেন।
অনলাইনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এই অর্থ তিনি হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নিয়ন্ত্রণাধীন মেডিক্যাল এইড সিরিয়া (এমএএস) ও রমজান ইমার্জেন্সি হোমস নামের একটি ফান্ডে পাঠিয়ে দেন। সিঙ্গাপুরের সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইনের পাঁচটি অভিযোগে দোষ স্বীকার করায় বাংলাদেশি এই প্রবাসীকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সিঙ্গাপুরে ২০১৭ সালে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন আহমেদ। একই বছর তিনি মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ইরাক এবং সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অনুসারী হয়ে ওঠেন তিনি। আইএসের ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অংশ নিতে সিরিয়া যাওয়ারও পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু অর্থের অভাবে সিরিয়ায় পাড়ি জমাতে ব্যর্থ হন তিনি।
ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করায় মুসলিম চিন্তাবিদদের ইসলামিক স্টেটের সমালোচনার ভিডিও দেখে তাতে অনুপ্রাণিত হন আহমেদ। পরে ২০১৯ সালে এই গোষ্ঠীর প্রতি তার মোহ ভেঙে যায় বলে সিঙ্গাপুরের আদালতের ডেপুটি পাবলিক প্রসিকিউটর চেং ইউশি এবং এসথার ওং আদালতের নথিতে জানিয়েছেন।
তারা বলেছেন, আইএসের চেয়ে কম নৃশংস মনে হওয়ায় সিরিয়ার জঙ্গিগোষ্ঠী এইচটিএসের অনুগত হয়ে ওঠেন আহমেদ ফয়সাল। একই সময়ে সিরিয়ার ইদলিবে এইচটিএসের পরিচালিত একটি হাসপাতালে কর্মরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত চিকিৎসক শাজুল ইসলামের ফেসবুক পেইজ অনুসরণ করা শুরু করেন তিনি।
সহিংস উপায়ে সিরিয়ার ক্ষমতাসীন সরকার উৎখাতের লক্ষ্যে তাহরির আল-শাম যে আন্দোলন করছে, তাতে সমর্থন জানান এই বাংলাদেশি এবং এর সমর্থনে ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের পোস্টও দেন।
জঙ্গিগোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম পরিচালিত হাসপাতালের তহবিল সংগ্রহের জন্য চিকিৎসক শাজুল ফেসবুক পেইজে লাইভ করতেন। ফেসবুক লাইভে এই জঙ্গিগোষ্ঠীর আহত সৈন্যদের সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হয় বলে জানান তিনি। শাজুলের ফেসবুক পেইজের কনটেন্ট দেখে প্রভাবিত হয়ে তাহরির আল-শামের কাছে অর্থ পাঠিয়ে দেন আহমেদ।
আদালতের বিচারকরা বলেছেন, কয়েক বার টাকা পাঠানো সত্ত্বেও ফয়সাল জানতেন না এই অর্থ কীভাবে ব্যবহৃত হবে। তবে এই অর্থ ইদলিবে হায়াত তাহরির আল-শামের সদস্যদের কল্যাণে ব্যয় হবে, সেটি তিনি মনে করতেন।
পরের বছর সিরিয়ায় জিহাদিদের জন্য শুরু করা ‘রমজান-২০২০ ইমার্জেন্সি হোমস’ নামে একটি অনলাইন তহবিল সংগ্রহ কর্মসূচির কথা জানতে পারেন তিনি। সিরিয়ায় যাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে তাদের জরুরি ভিত্তিতে বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই তহবিল সংগ্রহ শুরু হয়। ব্রিটেনে নিবন্ধনকৃত দাতব্য সংস্থা ওয়ান নেশন এই তহবিল সংগ্রহ ক্যাম্পেইন শুরু করেছিল।
অর্থ কীভাবে ব্যয় করা হবে সে বিষয়ে না জানা সত্ত্বেও ওয়ান নেশনের কাছে অর্থ পাঠান আহমেদ ফয়সাল। তবে তিনি বিশ্বাস করতেন এই অর্থও ইদলিবে এইচটিএসের সদস্যদের কল্যাণে ব্যয় হবে। বাংলাদেশি এই প্রবাসীর এসব অপরাধ কীভাবে উন্মোচিত হলো, সে বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ আদালতের নথিতে পাওয়া যায়নি। তবে গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে সাতটি ছুরি উদ্ধার করা হয়।
আদালতের বিচারকরা বলেছেন, জিহাদের জন্য প্রস্তুতি নিতে এসব অস্ত্র কিনেছিলেন বলে জানিয়েছেন আহমেদ। তবে এই অস্ত্র সিঙ্গাপুরে ব্যবহারের কোনও ইচ্ছা তার ছিল না। কারণ সেখানে তিনি কোনও ধরনের ঝামেলায় না পড়ে দেশে পরিবারের সদস্যদের কাছে অর্থ পাঠানোর জন্য কাজ অব্যাহত রাখতে চেয়েছিলেন।
‘বাংলাদেশে হিন্দুরা যদি মুসলিমদের ওপর হামলা চালায় এবং সরকার কোনও ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে হিন্দুদের বিরুদ্ধে তিনি এই অস্ত্র ব্যবহার করবেন বলে জানান।’
সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বলেছে, সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আইনে আহমেদকে গ্রেফতার এবং আটকে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে আদালত দোষী সাব্যস্ত করে রায় ঘোষণা করায় আগের নির্দেশ বাতিল করা হয়েছে। অন্যান্য বন্দিদের মাঝে যাতে মৌলবাদী চিন্তা-ভাবনা ছড়াতে না পারেন, সে জন্য তাকে কারাগারে আলাদাভাবে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।