ডলারের ওপর চাপ কমাতে সরকার সৌদি আরব থেকে বাকিতে জ্বালানি তেল আমদানি করতে চায়। এর অংশ হিসাবে ঢাকা সফররত সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বাকিতে তেল কেনার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। বাকিতে জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারলে এ মুহূর্তে ডলারের ওপর চাপ কমবে প্রায় ৪শ থেকে ৫শ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ।
গত সপ্তাহে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সঙ্গে বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ইসা বিন ইউসুফ আল-দাহিলান সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় জ্বালানি সংকটের সম্ভাব্য সমাধান এবং এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন তারা। বৈঠকে সৌদি রাষ্ট্রদূত প্রতিমন্ত্রীকে বলেন, ‘বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে সৌদি কোম্পানিগুলোর আগ্রহ বাড়ছে। দেশটির বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অন্যতম বড় কোম্পানি একোয়া পাওয়ার ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘ভ্রাতৃপ্রতিম সৌদি আরবের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চাচ্ছে সরকার। বৈশ্বিক এই সংকটে বাংলাদেশ সৌদি আরব থেকে তুলনামূলক কম মূল্যে জ্বালানি তেল পেতে চায়। ডেফার্ড পেমেন্টেও (বিলম্বে পরিশোধ) আমরা জ্বালানি তেল ক্রয় করতে আগ্রহী।
জ্বালানি তেলের বড় অংশই আসে সৌদি আরব থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাকিতে জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারলে একদিকে ডলারের ওপর বর্তমান চাপ কমে যাবে অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপরও চাপ কমবে। এতে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও মূল্যস্ফীতিতে বিদ্যমান চাপও কিছুটা হ্রাস পাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে এনার্জি সেক্টরে দেশে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় জ্বালানি তেল। মোট আমদানি ব্যয়ের প্রায় ২৫ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয় জ্বালানি খাতে। এর মধ্যে তেল আমদানিতে ১৫ শতাংশ। বাকি ১০ শতাংশ গ্যাস ও বিদ্যুৎ আমদানিতে।
গত কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম হু হু করে বাড়ছে। দাম বাড়ায় এ খাতে ব্যয়ও বাড়ছে। এই অবস্থায় ডলারের ওপর চাপ কমাতে সরকার বাকিতে তেল আমদানি করতে চাচ্ছে। বাকিতে তেল আমদানি করতে পারলে রিজার্ভের ওপর চাপ অনেকাংশে কমে যাবে। অর্থাৎ জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ প্রায় ১৫ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। এর পরিমাণ বছরে প্রায় ৯০০ কোটি ডলার। জ্বালানি তেলের সাশ্রয় ও দাম কমার কারণে আমদানি ব্যয় কিছুটা কমেছে। তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের আমদানি কমিয়ে ডলার সাশ্রয় করার উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, এতে দেশের শিল্প বসে যাচ্ছে। তারা বাড়তি দামে হলেও জ্বালানি আমদানির পক্ষে। এ ক্ষেত্রে তারাও বাড়তি দামে জ্বালানি কিনতে সম্মত।
সূত্র জানায়, জ্বালানি তেল আমদানি করতে প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে এলসি খুলতে হয়। এ খাতে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০ কোটি থেকে ৩০ কোটি ডলারের প্রয়োজন হয়। মাসে প্রয়োজন হয় গড়ে ৭০ থেকে ৮০ কোটি ডলারের। তিন মাসের তেল আমদানি পাইপলাইনে রেখে এলসি খুলতে হয়। তিন মাসে প্রয়োজন হয় ২৫০ কোটি ডলারের। ছয় মাসের তেল রিজার্ভে রাখতে হয়। এ হিসাবে প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের প্রয়োজন হয়। ছয় মাসের বাকিতে তেল আমদানি করতে পারলে ৫০০ কোটি ডলারের ওপর ছাপ কমবে।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বাকিতে তেল আমদানির সুযোগ রয়েছে। কমোডিটি ক্রেডিট বা সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিটের মাধ্যমে তেল আমদানি করা যায়। এ ক্ষেত্রে ঋণ নিতে হয় ও সুদের হার বেশি। আর সৌদি আরব থেকে বাকিতে তেল আমদানি করলে ওই কোম্পানিকেই পরে দেনা পরিশোধ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে বাড়তি সুদের প্রয়োজন হয় না। একই সঙ্গে এলসি খুলতে আগাম ডলারেরও প্রয়োজন হয় না। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের অনিষ্পন্ন এলসি রয়েছে। সেগুলো পর্যায়ক্রমে নিষ্পত্তি করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী দেশে জুলাই সেপ্টেম্বরে এলসি খোলা হয়েছিল ২৬৩ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের। আমদানি করা হয়েছে ২৯৭ কোটি ১৫ লাখ ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে এলসি খোলা হয়েছিল ১৭৪ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের। আমদানি করা হয়েছিল ১৪০ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের। আলোচ্য সময়ে এলসি খোলা বেড়েছে ৫১ শতাংশ। আমদানি বেড়েছে ১১২ শতাংশ। গত অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় আমদানি বেড়েছিল ১১৬.১৮ শতাংশ। মোট আমদানি ব্যয়ের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশই জ্বালানি তেল। গ্যাস ও বিদ্যুৎসহ জ্বালানি খাতে মোট আমদানির ২৫ শতাংশ ব্যয় হয়। গত অর্থবছরের জুলাই সেপ্টেম্বরে খোলা এলসির মধ্যে ৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারের এলসি অনিষ্পন্ন ছিল।
গত অর্থবছরের এলসি খোলা হয়েছিল ৯৩৭ কোটি ডলারের। আমদানি হয়েছিল ৯২৭ কোটি ডলারের। অনিষ্পন্ন ছিল ১০ কোটি ডলারের এলসি। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪২৯ কোটি ডলারের এরসি খোলা হয়েছিল। নিষ্পত্তি হয়েছিল ৪৪১ কোটি ডলারের। অনিষ্পন্ন ছিল ১২ কোটি ডলারের এলসি।