তুর পাহাড়ের শৃঙ্গায় আরোহন, পূরণ হলো বহুদিনের স্বপ্ন

১. তূর পাহাড় বা সিনাই পর্বত৷ আরব বেদুইনদের কাছে যা জাবালে মুসা আ. (মুসার পর্বত) হিসেবেও পরিচিত৷ যেখানে অবতরণ হয়েছিল তাওরাত ৷ যেখানে অবস্থানকালে নবুয়ত লাভ করেছিল হযরত মুসা আ.৷ এটা সেই পবিত্র পর্বত যার সরাসরি আলোচনা পবিত্র কোরআনে মোট দশবার এসেছে৷ অন্য কোনো পর্বতের আলোচনা পবিত্র কুরআনে এতোবার আসেনি৷

এটা সেই পর্বত যার নামে মহান আল্লাহ কসম করেছেন৷
এটা সেই পর্বত যাতে উঠার সময় মুসা আ: তার জুতা খোলার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল৷
এটা সেই পাহাড় যা বনী ইসরাঈলের মাথার উপর উঠিয়ে তাদের তাওরাতের বিধান মানতে বাধ্য করা হয়েছিল৷ এটা সেই পাহাড় যেখানে মহান আল্লাহর নুরের তাজাল্লী পড়েছিল৷

তূর পাহাড় মুসলমানদেক পাশাপাশি ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানদেরও নিকটও একটি পবিত্র ও ঐতিহ্যবাহী স্থান। নানামুখী ধর্মীয় তাৎপর্যও রয়েছে এই পর্বতটির৷ বহু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে কয়েক হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে মিশরের সিনাই উপদ্বীপের সেন্ট ক্যাথেরিন নগরীতে৷ এই পাহাড়ের পাদদেশেই রয়েছে হযরত মুসা (আ.)-এর ভাই হযরত হারুন (আ.)-এর কবর৷

২. গত ১৯ জানুয়ারী অনার্স লাস্ট ইয়ারের ফাস্ট টার্মের পরীক্ষা সমাপ্ত হলো৷ চলছে পরীক্ষার ছুটি৷ এই ছুটিতে কাঙ্খিত সেই তূর পাহাড় সফরের সুযোগ হলো৷
২৬ -০১-২০২৩ বৃহস্পতিবার রাত তখন নয়টা ৷ দুটি বাসে শতাধিত মানুষের কাফেলার সাথে রওনা হলাম তূর পাহাড় ও দাহাব সি বীচ এর উদ্দেশ্যে৷ শুক্রবার দাহাবে কাটানোর পর সন্ধায় রওনা হলাম সিনাই উপদ্বীপের সেন্ট ক্যাথেরিন নগরীর উদ্দেশ্যে৷ রাত তিনটার দিকে পৌঁছলাম কাঙ্খিত সেই তূর পাহাড়ের পাদদেশে ৷

হাড় কাঁপানো শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে পর্যাপ্ত পরিমান শীতের পোশাক পরিধান করলাম৷ সাথে নিলাম কিছু খাবার ও পানীয়৷

রাত সাড়ে ৪ টার দিকে পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম৷
আমাদের সাথে ছিল কয়েকজন বেদুইন গাইড৷ তাদেরকে অনুসরণ করে টর্চ লাইটের সাহায্যে অন্ধকার রাতে পাহাড়ের আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু পথ ধরে চললাম তূরের চূড়ার পানে৷
আকাশের কোল ভরা তারকারা আমাদেরকে সাহস যোগাচ্ছিল৷

শীতের অন্ধকার রজনীতে পবিত্র তূর পাহাড়ে আরোহণের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়৷ পাহাড়ী পথের চেয়ে কষ্টকর কোন পথ নেই৷ কিছুক্ষণ পর পর ক্লান্ত হয়ে গেলাম৷ ক্লান্ত শরীরকে নতুন উদ্যোমে আরোহণের উপযোগী করতে মাঝে মাঝে একটু বিশ্রাম নিলাম৷

মাঝ পথে ফজরের নামাযের সময় হলো৷ তায়াম্মুম করে ফজর নামায আদায় করে নিলাম৷ আরো কিছুদূর ওঠার পর পূর্ব দিগন্ত সূর্য উঁকি দিলো৷ তূর পাহাড় থেকে সূর্যোদয় দেখার অসাধারণ লাগে৷ সূর্যোদয়ের পর পরেই রক্তিম সূর্যকিরণগুলো যখন তূর পাহাড় নিজের গায়ে মেখে নিলো তখন মনে হলো যেন এক‘ গোল্ডেন হিল’৷ একটু পর যখন সূর্যের আলোতে তূর পাহাড় ঝলমল করছিলো তখন তূরের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলী দেখে অভিভূত হচ্ছিলাম৷ অপলক দৃষ্টিতে তূরের অপরূপ দৃশ্যাবলীর দেখছিলাম আর তূরের উর্ধপানে উঠছিলাম৷

শীত কালে তূর পাহাড়ের তাপমাত্রা প্রায়ই মাইনাস ডিগ্রীর নিচে থাকে৷ তবে আজ তাপমাত্র ততটা কম ছিল না৷ তবে কিছুদিন আগেও তুষার পাত হয়েছিলো এই এলাকায়৷
তূর পাহাড় পুরোটাই পাথরের৷ শীতের সকালে তূর পাহাড়ের পাথরগুলো যেন একেকটি বরফ খন্ড৷
তূর পাহাড়ের চূড়ায় উঠার রাস্তা পাথর কেটে কেটে রাস্তা বানানো হয়েছে। তিন ঘন্টা পাহাড়ের চড়াই-উতরাই পথ পাড়ি দেওয়ার শুরু হয় পাথরের তৈরি ৭৫০ টি সিড়ি উঠার পালা৷ সিড়ি উঠা যেমন কষ্টকর তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ৷

প্রায় দীর্ঘ সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে ৭৪৯৭ ফুট পথ পাড়ি দিয়ে তূর পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গায় উঠতে সক্ষম হলাম। ঘড়ির কাঁটা তখন নয়টার ঘরে৷

তুর পাহাড়ের উপরে একটি ছোট্ট একটি গূহা রয়েছে, বলা হয় এখানেই হযরত মুসা (আ:) ৪০ দিন ইতিকাফ ও ইবাদতে মগ্ন ছিলেন৷ সেখানে প্রবেশ করলাম৷ এর পাশেই রয়েছে একটি মসজিদ৷ মসজিদে দুই রাকাআত নামায পড়লাম৷ দুয়া করলাম৷

মসজিদের পাশেই রয়েছে একটি গির্জা৷ ইয়াহুদি-খ্রিস্টানরাও তূরের এই চূড়ায় আসে৷ এই স্থানটি তাদের কাছেও অনেক পবিত্র স্থান৷

তূরের শৃঙ্গায় দাঁড়িয়ে চারপাশে গভীরভাবে তাকিয়ে দেখলাম৷ দেখলাম আল্লাহর সৃষ্টির নিদর্শন সুবিশাল পার্বতমালা৷ যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়৷
তূর পাহাড়ে উঠে সূরা তীন পাঠ করলাম৷
পাঠ করলাম, وطور سينين. যে পর্বতের নাম পবিত্র কুরআনে দশবার উল্লেখ করা হয়েছে৷ যে পর্বতে তাওরাত নাজিল হয়েছে৷ যে পর্বতে আল্লাহর নূরে তাজাল্লী পড়েছে সেই পর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে কুরআনের সেই সব আয়াত তিলাওয়াত করার অনুভূতিটা কেমন হতে পারে!!

কিছু সময় তূরের চূড়ায় অতিবাহিত করে নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম৷ তখন তূরের গিরিপথে সূর্যের ঝলমলে রোদগুলো আছড়ে পড়ছিল৷ তূর পাহাড়ের বিভিন্ন টিলার বিভিন্ন দৃশ্যগুলো বার বার দেখছিলাম৷ আর মনে পড়ছিল হযরত মুসা আ: এর ঘটনাগুলো আর হারিয়ে যাচ্ছিলাম ভিন্ন কোনো জগতে৷

তূর পাহাড়ের একেক স্থানের রূপ একেক ধরণের৷ বিস্ময়কর এসব দৃশ্য মানবজাতিকে হাজার হাজার বছর ধরে অনেক কিছু শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে৷

ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীরে দ্রুত গতিতে নামছিলাম বার বার মনে করছিলাম পবিত্র কুরআনের নিচের আয়াতটি:

سِيرُوا۟ فِى ٱلْأَرْضِ فَٱنظُرُوا۟ كَيْفَ بَدَأَ ٱلْخَلْقَۚ ثُمَّ ٱللَّهُ يُنشِئُ ٱلنَّشْأَةَ الآخِرَةَۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ

বলো, পৃথিবীতে একটু ভ্রমণ করে দেখো, আল্লাহ কিভাবে মাখলুককে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন। তারপর আল্লাহই (তাদেরকে) আখেরাতকালীন উত্থানে উত্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে শক্তিমান। (সূরা আনকাবুত:২০)

তূর পাহাড়ে ঈমান বৃদ্ধির অনেকগুলো উপাদান রয়েছে৷

লেখক: মুহাম্মদ তাওহীদুল ইসলাম
শিক্ষার্থী: চতুর্থ বর্ষ, হাদিস ও উলূমুল হাদিস বিভাগ ,জামিয়াতুল আযহার, কায়রো, মিসর৷
০১-০২-২০২৩

এ জাতীয় আরো সংবাদ

ভারতীয় মুসলিমদের যে আহ্বান জানালেন মুসলিম ল’ বোর্ডের সভাপতি

নূর নিউজ

ভারতে লাভ জিহাদ আইন ও মসজিদ ধ্বংস নিয়ে আমেরিকার উদ্বেগ

আনসারুল হক

হামাসের প্রধান হিসেবে ইসমাইল হানিয়া পুননির্বাচিত

আনসারুল হক