দান করার দুটি দিক রয়েছে একটি পাপের ও অপরটি পুণ্যের। একটি কল্যাণের ও অপরটি অকল্যাণের। একটির মাধ্যমে মানবকল্যাণ, সমাজকল্যাণ ও সৃষ্টিকল্যাণ হয়ে থাকে। আর অপরটির মাধ্যমে অকল্যাণ হয়ে থাকে। কেবল সেই দান উপকারী হয় ও পুণ্য নিয়ে আসে যা আল্লাহর পথে প্রদান করা হয়, কল্যাণের পথে ব্যয় করা হয় ও পুণ্যের পথে প্রদত্ত হয়। পক্ষান্তরে পাপের পথে দান করা হলে তা উপকারের পরিবর্তে অপকার বয়ে আনে।
দানকৃত অর্থ অনর্থ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। তাই শিরোনামের দান দ্বারা আল্লাহর পথে, পুণ্যের পথে ও কল্যাণের পথের দানই উদ্দেশ্য। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমরা শরিয়ত সমর্থিত দান সম্পর্কে কুরআন-হাদিসের নিরিখে আলোকপাত করছি; যেন কল্যাণকর খাতে দান করার মাধ্যমে ইহ ও পরকালে উপকৃত হওয়া যায়।
রিজিক বৃদ্ধির কারণ
আল্লাহর পথে দান করা দাতার রিজিক বৃদ্ধির কারণ। যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে প্রচুর প্রতিদান প্রদান করেন। তার রিজিক বৃদ্ধি করে দেন।
সম্পদে ভরপুর বরকত দান করেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এসেছে : ‘আমার পালনকর্তা তার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা রিজিক বাড়িয়ে দেন এবং সীমিত পরিমাণে দেন। তোমরা যা কিছু ব্যয় কর, তিনি তদস্থলে বিনিময় প্রদান করেন। তিনি উত্তম রিজিক দাতা।’ (সুরা সাবা, আয়াত : ৩৯) মহান আল্লাহ দান খয়রাতকে বর্ধন করার স্পষ্ট ঘোষণা আলকুরআনে প্রদান করে বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৬) কোন ব্যক্তিকে ধার দেওয়া হলে সেই ব্যক্তি অনুরূপ বস্তু ফিরিয়ে দেয়। অনেক সময় ফিরিয়ে দিতে টালবাহানা ও কালক্ষেপণ করে।
কিন্তু আল্লাহ তাআলাকে ধার দেওয়া হলে অর্থাৎ তার পথে ব্যয় করা হলে তিনি দাতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেন। তার সম্পদ বিপুল পরিমাণে বর্ধিত করে ইহ বা পরকালে ফিরিয়ে দেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে এমন কে আছে যে, আল্লাহকে করজ দেবে, উত্তম করজ; অতঃপর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেবেন। আল্লাহই সংকোচিত করেন এবং তিনিই প্রশস্ততা দান করেন। আর তারই নিকট তোমরা সবাই ফিরে যাবে। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৪৫)
সম্পদ বৃদ্ধির কারণ
দান করার মাধ্যমে লোভ-লালসা ও কার্পণ্য হতে আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন হবার সঙ্গে সঙ্গে আপন সম্পদে বরকত অর্জিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের মালামাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর যাতে তুমি তাদেরকে পবিত্র করতে পার এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পার এর মাধ্যমে। আর তুমি তাদের জন্য দোয়া কর, নিঃসন্দেহে তোমার দোয়া তাদের জন্য সান্ত্বনা স্বরূপ। বস্তুতঃ আল্লাহ সবকিছুই শোনেন, জানেন।’ (সুরা তওবা, আয়াত : ১০৩)
দান করার মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিসের মাধ্যমেও প্রমাণিত। ‘হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক বান্দা যখন সকালে ওঠে তখন দু’জন ফেরেশতা অবতীর্ণ হন। তাদের একজন বলেন, ‘হে আল্লাহ! দাতার সম্পদ আরো বাড়িয়ে দিন’ এবং দ্বিতীয়জন বলেন, ‘হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দিন!’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২২২৬)
বিপদ হতে মুক্তি
মানুষের অন্যায়, অনাচার ও পাপাচারের কারণে আল্লাহ তাআলা অসন্তুষ্ট হন! আর পরাক্রমশালী আল্লাহর অসন্তুষ্টি হতে নিষ্কৃতি পাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।
রাজাধিরাজ আল্লাহর অসন্তোষ মহাবিপদ তুল্য। তাছাড়া প্রতিদিন আমরা বিভিন্ন দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করি, দুঃসংবাদ শুনে থাকি ও বিপদাপদের শিকার হই! কেউ অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে! বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে কারো মৃত্যু হয় বা ট্রেন, বাস কিংবা ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে কেউ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে!
এ রকম বিভিন্ন ঘটনা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মানুষ মৃত্যুবরণ করছে প্রতিনিয়ত! আল্লাহর অসন্তুষ্টি, বিপদাপদ ও মন্দ মৃত্যু হতে পরিত্রাণ পাওয়ার কার্যকর উপায় হলো সুমহান আল্লাহর পথে দান করা। দান খয়রাতের মাধ্যমে বিপদাপদ ও বালা-মুসিবত দূর হয়। সঙ্গে সঙ্গে অকালমৃত্যুও রোধ হয়। ‘হযরত আনাস ইবনু মালিক রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দান-খয়রাত আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টি কমিয়ে দেয় এবং মন্দ মৃত্যু রোধ করে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৬৬৪)
দাতার হাত উত্তম
দান করা ও গ্রহণ করা দুটি হাতের মাধ্যমে নিষ্পন্ন হয়। একটি দাতার হাত ও অপরটি গ্রহীতার হাত। দান করা প্রশংসনীয় এবং গ্রহণ করা অবাঞ্চনীয়। তাই যথাসাধ্য দান করায় মনোযোগী হতে হবে এবং অন্যদের কাছ থেকে গ্রহণ করায় পিছিয়ে থাকার চেষ্টা করতে হবে। হাদিস শরিফে দাতার হাতকে গ্রহীতার হাত অপেক্ষা উত্তম বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
যারা মানুষের দান-অনুদানের প্রতীক্ষা না করে স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা করে প্রতিপালক আল্লাহ তাদেরকে স্বাবলম্বী করে দেন। তাই অন্যের দিকে তাকিয়ে না থেকে এবং ভিক্ষার হাত সম্প্রসারিত না করে কাজে নিমগ্ন হয়ে আত্মনির্ভরশীল হবার প্রয়াস চালাতে হবে। এতে মহান আল্লাহ স্বাবলম্বী করে দেবেন।
হযরত হাকিম ইবনু হিযাম রা. বলেন, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, উপরের হাত নিচের হাত অপেক্ষা উত্তম। প্রথমে তাদেরকে দেবে যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তুমি বহন কর। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ হতে দান করা উত্তম। যে ব্যক্তি (পাপ ও ভিক্ষা করা হতে) পবিত্র থাকতে চায়, আল্লাহ তাকে পবিত্র রাখেন এবং যে পরমুখাপেক্ষিতা হতে বেঁচে থাকতে চায়, আল্লাহ তাকে স্বাবলম্বী করে দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস ১৪২৭) উল্লিখিত হাদিসে উপরের হাত দ্বারা দাতার হাত এবং নিচের হাত দ্বারা গ্রহীতার হাত উদ্দেশ্য।
দানে পাপমোচন হয়
প্রাত্যহিক জীবনে আমাদের অন্যায়-অপরাধ, ভুল-ভ্রান্তি ও পাপ-পঙ্কিলতা হয়েই যায়। এসব পাপের ক্ষতি ও পরিণতি হতে নিষ্কৃতি পাওয়ার এবং সর্বপ্রকার গুনাহ খাতা মোচন করার অন্যতম উপায় হলো আল্লাহর পথে দান করা।
আল্লাহর পথে দান করা হলে অন্যায়-অপরাধ ও পাপ-পঙ্কিলতা মোচন হয়ে যায় এবং রকমারি অনাচার ও দুরাচার ক্ষমা করে দেওয়া হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা কতইনা উত্তম। আর যদি খয়রাত গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্যে আরও উত্তম।
আল্লাহ তাআলা তোমাদের কিছু গুনাহ দূর করে দেবেন। আল্লাহ তোমাদের কাজ কর্মের খুব খবর রাখেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭১) দান খয়রাতের মাধ্যমে পাপমোচন হওয়ার বিষয়টি হাদিসের মাধ্যমেও প্রমাণিত। হযরত আনাস রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হিংসা বা পরশ্রীকাতরতা নেক আমলসমূহ খেয়ে ফেলে, যেমন আগুন জ্বালানী কাঠ খেয়ে ফেলে। দান-খয়রাত গুনাহসমূহ বিলীন করে দেয় যেমন পানি আগুনকে নির্বাপিত করে দেয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২১০)
প্রতিদান সাতশত গুণ
দান করার বহুবিধ ইহলৌকিক উপকারিতার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে পারলৌকিক অশেষ উপকারিতা। আল্লাহর পথে এক টাকা দান করা হলে সাতশত টাকা দান করার সওয়াব পাওয়া যায়।
এমনকি আরো বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি কুরআন-হাদিসে উচ্চারিত হয়েছে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন : ‘যারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৬১)
হাদিস শরিফেও এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। ‘হযরত খুরাইম ইবনু ফাতিক রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় কোন কিছু দান করবে, তার জন্য সাতশত গুণ সওয়াব লেখা হবে।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩১৮৬) এই প্রতিদান সাতশত গুণ অপেক্ষা আরও বেশি হতে পারে।
একটি হাদিসে হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে লোক তার হালাল ও পবিত্র উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণও দান করে, আল্লাহ তা তার ডান হাত দ্বারা কবুল করেন। আর পবিত্র ও হালাল বস্তু ব্যতীত আল্লাহর দিকে কোন কিছু আগে গিয়ে পৌঁছে না।
তারপর এটি তার মালিকের জন্য লালন-পালন ও পরিচর্যা করতে থাকে, তোমরা যেমন ঘোড়ার বাচ্চাকে লালন-পালন করতে থাক। অবশেষে তা পর্বতের মত বিরাট আকার ধারণ করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৪৩০)
আল্লাহর ছায়ায় আশ্রয় লাভ
দানকারী ব্যক্তি সবচেয়ে বড় যে পুরস্কার পাবে তা হলো আল্লাহ তাআলার ছায়াতলে অবস্থান করার সুযোগ। যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর পথে দান করে আল্লাহ তাআলা এমন দিনে আপন ছায়া তলে তাকে আশ্রয় দান করবেন যেদিন তার ছায়া ছাড়া অন্য কোন ছায়া থাকবে না।
হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে দিন আল্লাহর আরশের ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া থাকবে না, সে দিন আল্লাহ তাআলা সাত প্রকার মানুষকে সে ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন।
যে ব্যক্তি গোপনে এমনভাবে দান করে যে, তার ডান হাত যা দান করে বাম হাত তা জানতে পারে না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৪২৩) অপর একটি হাদিসে এ ব্যাপারে এসেছে, ‘হযরত উকবা ইবনু আমের রা. বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দান অবশ্যই কবরবাসীর কবরের উত্তাপ ঠান্ডা করে দেবে এবং মুমিন ব্যক্তি কেয়ামতে তার ছায়াতে অবস্থান করবে।’ (শুআবুল ঈমান-বায়হাকি, হাদিস : ৩৩৪৭)
দানশীল ও কৃপণের উদাহরণ
জ্ঞানী ও মূর্খ যেমন সমান হতে পারে না, আলো ও অন্ধকার যেমন সমান হতে পারে না, গরম ও ঠান্ডা যেমন হওয়া সমান হতে পারে না, ঠিক তেমনিভাবে দানশীল এবং কৃপণ ব্যক্তিও সমান হতে পারে না। হাদিস শরিফে তাদের দুজনের উদাহরণ উল্লেখ করা হয়েছে। ‘হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, মহা নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কৃপণ ও দানশীল ব্যক্তির উদাহরণ এমন দু’ ব্যক্তির মত, যারা লৌহ বর্মে আচ্ছাদিত।
বর্ম দু’টি এত আঁটসাঁট যে, তাদের উভয়ের হাত কব্জায় আবদ্ধ রয়েছে। দানশীল ব্যক্তি যখন দান করতে ইচ্ছে করে, তখন বর্মটি তার দেহের উপর প্রসারিত হয়, এমনকি তা তার পায়ের চিহ্ন মুছে ফেলে। আর কৃপণ ব্যক্তি যখন দান করতে ইচ্ছে করে তখন বর্মের কড়াগুলো পরস্পর গলে গিয়ে তার শরীরকে আঁকড়ে ধরে এবং তার উভয় হস্ত কন্ঠের সঙ্গে লেগে যায়। অতঃপর আবু হুরায়রা রা. বলেন, তিনি মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, সে হাত দু’টিকে প্রসারিত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে; কিন্তু প্রসারিত করতে পারে না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৯১৭)