দ্য প্রিন্টের সিনিয়র কনসাল্টিং এডিটর: জ্যোতি মালহোত্রা
ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা মাত্র ১.২৩ কোটি রুপির একটি চালান গত ৭৫ বছর ধরে চলা এ উপমহাদেশের বাণিজ্যের কঠিন রূপকে বদলে দিতে সক্ষম। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার পূর্বে এ অঞ্চলের মধ্যে যে অর্থনৈতিক যোগাযোগ ছিল তাও এখন পুনরুদ্ধার হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এই একটি চালান এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার কারণ হচ্ছে, ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য শুরু হয়েছে। তবে হতাশাবাদীরা এই উদ্যোগকে প্রত্যাখ্যান করবেন। আবার বাস্তববাদীরা বলবেন যে, সময়েই বলে দেবে এই উদ্যোগ কতোটা সফল হবে। কিন্তু শুধুমাত্র যারা ইতিহাস জানেন এবং সমসাময়িক রাজনীতির খোঁজ রাখেন, তারা এ ধরনের অর্থনৈতিক স্বাভাবিকীকরণকে স্বাগত জানাবেন।
প্রথমেই এই হতাশাবাদী এবং বাস্তববাদীদের যুক্তি দিয়েই শুরু করা যাক। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিকল্প মুদ্রায় বাণিজ্য শুরু হওয়ায় মার্কিন ডলারের ওপর দেশ দুটির নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে। কিন্তু এই সংখ্যা এতটাই ছোট যে, এখনো ডলারের প্রয়োজনীয়তা সব থেকে বেশি থেকে যাবে। দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ১৮ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে ১৬ বিলিয়ন ডলারই ছিল ভারতের রপ্তানি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মাত্র ২ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ভারতীয় রুপি ব্যবহার করতে পারবেন। অর্থাৎ বাংলাদেশ ভারতে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করতে পারবে, সে পরিমাণ বাণিজ্যই বাংলাদেশ রুপিতে করতে পারবে।
আবার ভারতীয় ব্যাংকগুলো বাংলাদেশে তাদের এক্সপোজার কমিয়ে দিচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি কঠিন ধাক্কা খেয়েছে। ঢাকার বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৩.৫৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এ দিয়ে শুধুমাত্র চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে বাংলাদেশ। এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে অতিরিক্ত ঋণ পেতে যে ন্যূনতম ২৪ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ প্রয়োজন, সেটিও নেই বাংলাদেশের।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গোটা বিশ্বই বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার ওপর এর প্রভাব ছিল সব থেকে বেশি। শ্রীলঙ্কাকে ২.৯ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আইএমএফ। পাকিস্তান এরই মধ্যে আইএমএফ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পেয়েছে। দেশটিতে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। গত জুলাই মাসে পাকিস্তানের রিজার্ভ ৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়। এরপর অবশ্য সৌদি আরব ২ বিলিয়ন ডলার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ১ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ইসলামাবাদকে ভাসিয়ে রেখেছে। চীনও পরে ৩ বিলিয়ন ডলারের অর্থ সহায়তা দেয় পাকিস্তানকে। এতে পাকিস্তানের অর্থনীতি খাদে পড়া থেকে কোনোমতে বেঁচে গেছে।
এদিকে বাংলাদেশের ওপর চীনের প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে যে মডেলটি কাজ করছে, তা এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোও গ্রহণ করতে পারে। এই দুই দেশ আরও এক বছর আগেই নিজেদের মধ্যকার বাণিজ্যে ইউয়ান ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অর্থাৎ, বিষয়টি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রুপিতে বাণিজ্যের মতোই। তবে সব থেকে বেশি অবাক করা বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার থেকে নেয়া ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলার ঋণও ইউয়ানে ফেরত দিতে চেয়েছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেম সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন রাশিয়া। তারাও বাংলাদেশের এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই বিশ্বজুড়ে ডি-ডলারাইজেশন বা ডলারের বিকল্প মুদ্রার ব্যবহার বৃদ্ধি নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। বিশ্বজুড়ে ডি-ডলারাইজেশন কতোটা বাস্তবায়িত হচ্ছে তা নিয়ে যদিও বিতর্ক রয়েছে। তবে এটি নিশ্চিত যে, নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের প্রভাব বৃদ্ধি ও পুনরায় ক্ষমতায় আসার জন্য নতুন নতুন উপায় ভাবছেন।
যদিও সম্প্রতি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের উইপোকার সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু শেখ হাসিনা জানেন যে, নির্বাচনের সময় ভারতীয় সমর্থন তাকে প্রচুর সহায়তা করবে। খুব সম্ভবত এটাই প্রধান কারণ, যে কারণে তিনি অমিত শাহের ওই মন্তব্য নিয়ে প্রকাশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেননি। তিনি বুঝতে পারছেন যে, তার পুনরায় জয়ী হওয়ার প্রধান কারণ হতে পারে এটাই যে, ভারত দৃঢ়ভাবে তার সঙ্গে আছে।
নিশ্চিতভাবেই এর অর্থ হচ্ছে, শেখ হাসিনা এখন ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যকে আরও সহজ করতে আগ্রহী। এটি তার ও ভারতের জন্য লাভজনক। ভারত থেকে বাংলাদেশে এই একটি ট্রাক ঢুকতে ১৩৮ ঘণ্টা সময় এবং ৫৫টি স্বাক্ষরের বাধা পাড় হতে হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের সিসিল ফ্রুম্যান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মোট বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ হয় এই উপমহাদেশের দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে। অথচ চাইলেই এই বাণিজ্যের পরিমাণকে ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার এই রুপি-রুপি বাণিজ্য এমন টার্গেটে পৌঁছাতে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করবে।
উপমহাদেশে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক একত্রীকরণের সম্ভাবনাকে বাস্তব করার জন্য ভারত এখন স্পষ্টতই তার সব প্রচেষ্টা শেখ হাসিনার পেছনে ব্যয় করছে। আগামী সেপ্টেম্বরে টাকা-রুপি ডুয়াল কারেন্সি কার্ড চালু হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। এরফলে বাংলাদেশিরা ভারত সফরের সময় রুপিতে কেনাকাটা করতে পারবেন, মাঝে আবার টাকাকে ডলারে কনভার্ট করার ঝামেলায় তাদের যেতে হবে না। এরফলে রুপি-রুপি বাণিজ্য আরও উৎসাহিত হবে।
অবশ্যই এ ধরনের উদ্যোগগুলো পরীক্ষামূলক এবং বেশ ক্ষুদ্র। নিজের অর্থনীতি উন্মুক্ত করে দেয়া ভারত ও বাংলাদেশি উভয়ের জন্যেই ঝুঁকির। চীন এ ক্ষেত্রে একটি বড় উদ্বেগ হতে পারে। সম্প্রতি কক্সবাজারে ১.২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত একটি সাবমেরিন ঘাঁটির উদ্বোধন করেছেন শেখ হাসিনা। একদম বঙ্গোপসাগরের মুখে অবস্থিত এই ঘাঁটি নির্মাণ করেছে চীন। এ নিয়ে ভারত বেশ উদ্বিগ্ন।
তবে বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সত্ত্বেও দিল্লি ও ঢাকা উভয়েই জানে যে এ অঞ্চলের উন্নয়নে ভারতের বড় ভূমিকা রয়েছে। আর যেহেতু অর্থনীতি ও রাজনীতি একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ভারত তার পূর্বদিকে নিজের মিত্রকে সমর্থন দিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। দিল্লি এখন যোগাযোগ প্রকল্প, রেলওয়ে যোগাযোগ পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশকে সহায়তা করছে। অপরদিকে মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে দিয়ে এর প্রতিদান দিচ্ছে ঢাকা। আবার শেখ হাসিনার সঙ্গে সাম্প্রতিক এক বৈঠকে ভারতের গৌতম আদানি বাংলাদেশকে ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছেন।
এসব পদক্ষেপের অর্থ কি এটাই দাঁড়ায় যে, ভারত চাইছে শেখ হাসিনা আবারো ক্ষমতায় ফিরুক? অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষই ঠিক করবেন যে তারা কাকে ক্ষমতায় চান। কিন্তু দিল্লি নিশ্চিতভাবেই আশা করে যে, দুই দেশের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সম্পর্ক তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলবে।
সুত্র: মানবজামিন