তোফায়েল গাজালি
বাংলাদেশের নারী সংস্কার কমিশনের সাম্প্রতিক সুপারিশমালা পড়ে কোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষ স্তম্ভিত না হয়ে পারে না। একদিকে ‘নারী অধিকারের’ কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে সেই অধিকারের আড়ালে মুসলিম সমাজের ঈমান-আক্বিদা, পারিবারিক শৃঙ্খলা, সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় পরিচয়কে ধ্বংসের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে।
এই কমিশন নারী উন্নয়নের নামে যে সুপারিশ দিয়েছে, তার বেশিভাগই পশ্চিমা ‘উন্মুক্ত সভ্যতার’ অনুকরণ। অথচ পশ্চিমে পরিবার ভেঙে গেছে, সন্তান-পরিচয় অন্ধকারে, নৈতিকতা বিলুপ্ত। সেই পথকে বাংলাদেশে অনুকরণ করতে বলা মানে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিকে আত্মবিধ্বংসী পথে ঠেলে দেওয়া।
যেমন ধরুন, ‘যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি’। এ তো ব্যভিচারকে বৈধতা দেওয়ার নামান্তর! কোরআন-হাদিস যেখানে বারবার এই কাজ থেকে দূরে থাকতে বলছে, সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে প্রফেশন বানিয়ে মুসলিম নারীদের কোন মর্যাদা দিতে চায় কমিশন?
এদিকে ‘সমলিঙ্গ বিবাহকে’ স্বীকৃতি দিতে বলেছে কমিশন। মুসলমান হিসেবে এই প্রস্তাব শুনে কার ভ্রু কুঁচকাবে না? লুত (আ.)-এর কওম কি আজও আমাদের জন্য শিক্ষা নয়? সভ্যতার নামে কি ফের সেই ধ্বংসই আমাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে?
আরও বলা হয়েছে, ‘ধর্মীয় শিক্ষা বাতিল করতে’। অর্থাৎ সন্তানদের ‘ধর্মহীন’ করে গড়ে তুলতে হবে। যেন তারা আল্লাহ-রাসুল চিনবে না, কোরআন জানবে না, শুধু পাশ্চাত্য মতাদর্শে দীক্ষিত হবে। এর নাম সংস্কার নয়, এ হলো ধ্বংস।
হিজাব নিষিদ্ধের প্রস্তাব তো যেন মুসলিম নারীর ইজ্জতের ওপর সরাসরি আঘাত। ইসলাম যেখানে পর্দাকে নারীর সম্মান ও নিরাপত্তার ঢাল হিসেবে দিয়েছে, সেখানে এই কমিশন সেটিকে ‘বাধা’ হিসেবে দেখছে!
সবচেয়ে আশ্চর্য হলো, পিতৃপরিচয়ের বদলে ‘মাতার নামকে প্রাধান্য’ দিতে বলছে তারা। বংশধারা মুছে দিয়ে, সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে দিয়ে কোন্ নতুন সমাজ তারা গড়তে চায়?
‘শরীয়াহভিত্তিক আইন বাতিল করে অভিন্ন পারিবারিক আইন’— এই সুপারিশ একটি সুদূরপ্রসারী ইসলাম বিদ্বেষ। এটা কেবল ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, ধর্মবিরোধী আগ্রাসন। মনে রাখতে হবে, মুসলিমের জন্য শরীয়াহ থেকে বিচ্যুতি মানেই পথভ্রষ্টতা। কোরআন তা সরাসরি ‘কুফর’ বলেছে।
প্রশ্ন হলো, এই সুপারিশগুলো কি আদৌ নারী অধিকারের জন্য? নাকি নারীকে ঢাল বানিয়ে ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ধ্বংসের এক গভীর ষড়যন্ত্র?
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্র। এখানে ইসলামবিরোধী কোনো সংস্কার, কোনো ষড়যন্ত্র জনগণ কখনো মেনে নেয়নি। নেবেও না। তাই এমন সুপারিশ কোনো গবেষণা নয়, বরং একটি আদর্শিক যুদ্ধের অংশ; যেখানে ইসলামের শত্রুরা ‘মানবাধিকার’ ও ‘নারী অধিকার’-এর মুখোশ পরে মুসলিম সমাজের ভিত দুর্বল করতে চায়।
সুতরাং, এই প্রতিবেদন শুধু প্রত্যাখ্যান নয় প্রতিহত করাও সময়ের দাবি। শুধু ফাঁকা প্রতিবাদ বা আবেগের জোয়ার দিয়ে এই ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি, গঠনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ এবং সুস্পষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও সামাজিক পরিসরে ইসলামের মানবিক মূল্যবোধ, পারিবারিক জীবনব্যবস্থা এবং নারীর প্রকৃত মর্যাদা তুলে ধরতে হবে।
লেখক : সহসম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর