ঘনিয়ে আসছে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। সরকারি দল ও তাদের মিত্ররা সংবিধানের আলোকে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইছে। বিরোধী দলগুলোর দাবি নির্দলীয় বা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে কয়েকটি দলের অবস্থান এখনো স্পষ্ট নয়। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪২ টি দলের অবস্থান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে বেশির ভাগ দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছে। এর বাইরে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল এবং আরও কয়েকটি দল বিদ্যমান ব্যবস্থায় বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের বাইরে আরও অনেক দল রাজনীতির মাঠে সক্রিয়। এসব দলের বেশির ভাগই নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়।
সংসদের বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন চান। তবে দলের চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলের উপনেতা জিএম কাদের বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না বলে বক্তব্য দিচ্ছেন। তবে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুরো পক্ষে না। জাতীয় পার্টি নির্বাচন কালীন সরকারের বিষয়ে নিজস্ব একটি ফর্মুলা দিতে পারে বলে আলোচনা রয়েছে।
এই মুহূর্তে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবিতে একদফার আন্দোলন করছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। যুগপৎ ধারার এই আন্দোলনে ৫৩ টি’র মতো দল রয়েছে। এর বাইরে আরও বেশ কিছু দল রয়েছে যারা নিরপেক্ষ বা জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। কিন্তু তারা এখনো যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হয়নি। কয়েকটি বাম ধারার রাজনৈতিক দলও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অধীনে নির্বাচন চায়। এসব দলের দাবি সরকারের পদত্যাগ এবং সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ একটি ব্যবস্থার অধীনে যাতে নির্বাচন হয়।
তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছে বিএনপি, কর্নেল অব. অলি আহমেদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি), চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য, আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), ববি হাজ্জাজের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম), আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, গণফোরামের দুই অংশ, বাংলাদেশ পিপল্স পার্টি, বিএলডিপি, সাইফুল হকের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জুনায়েদ সাকির নেতৃত্বাধীন গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদের দুই অংশ।
এছাড়া জাতীয় পার্টি (জাফর), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় দল, এনডিপি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, ন্যাশনাল পিপল্স পার্টি-এনপিপি, ডেমোক্রেটিক লীগ (ডিএল), বাংলাদেশ ন্যাপ, সাম্যবাদী দল, বিকল্পধারা (একাংশ) গণদল, ন্যাপ-ভাসানী, পিপল্স লীগ ও বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়।
দেশপ্রেমিক নাগরিক পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম সমাজ, বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টি, ইসলামী জনতা পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী সমাজতান্ত্রিক পার্টি, বাংলাদেশ স্বাধীন পার্টি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ ও নির্বাচনের সময় নির্দলীয় সরকার চায়।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ-মার্ক্সবাদী), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় না। এছাড়া বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল), সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসডিপি), প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি) বিভিন্ন সময়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে।
সদ্য নিবন্ধন পাওয়া দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) যুগ্ম আহ্বায়ক ও মুখপাত্র ব্যারিস্টার এম. সারোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, বিএনএম মনে করে বর্তমান সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব না। তাই একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি তাদের।
ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশের মহাসচিব মো. রেহান আফজাল (রাহবার) মানবজমিনকে বলেন, বর্তমান সংসদ ভেঙে দিতে হবে। তবে এই সংসদে যারা আছেন তাদেরকে নিয়েও অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হতে পারে।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি বিরোধী জোটের যুগপৎ আন্দোলনে এখনও সরাসরি যুক্ত হয়নি জামায়াত। দলটি সরাসারি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করছে। এ দাবিতে তারা কর্মসূচিও পালন করছে।
এছাড়া সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে দু’টি ধারা বিদ্যমান। সংসদের বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের অনুসারীদের বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে আপত্তি নেই। তবে পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদের বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না বলে মনে করেন। তবে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো ফর্মুলার বিষয়ে এখনও স্পষ্ট করা হয়নি। বলা হচ্ছে দলটি নিজস্ব কোনো ফর্মুলা দিতে পারে নির্বাচনকালীন ব্যবস্থা নিয়ে।
আগের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনে যাওয়া সাবেক প্রেসিডেন্ট একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্প ধারা সামনের নির্বাচন নিয়ে এখনও অবস্থান স্পষ্ট করেননি। এছাড়া বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের অবস্থানও পরিষ্কার নয়। এ বিষয়ে জানতে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি আমার অবস্থান সেপ্টেম্বরে জানাবো। এখন শোকের মাসে আমি এসব বিষয়ে কথা বলতে চাই না।
ওদিকে আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক দলের সবাই বিদ্যামান ব্যবস্থায় নির্বাচন চাইছে। এর বাইরে আরও কিছু দল বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচন হলেও সমস্যা নেই বলে জানিয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলে রয়েছে- রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ, দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দল, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি), সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর নেতৃত্বাধীন তরিকত ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাপ, গণআজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, বাসদ। এছাড়া জাকের পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, সৈয়দ মিজবাহুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্য জোট, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-আম্বিয়া), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টিও বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচনের পক্ষে।
অন্যদিকে ইসলামিক ফ্রন্ট, খেলাফত আন্দোলন, মুসলিম লীগসহ ১৪টি ইসলামিক দলের জোট ইসলামিক ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটকে সমর্থন জানিয়েছিল। বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ’র প্রেসিডেন্ট আবুল কালাম আজাদ মানবজমিনকে বলেন, আমরা সংবিধান সম্মত নির্বাচনের পক্ষে। নির্বাচন করবে ইসি। সেখানে সরকার ও প্রশাসন তাদের সহায়তা করবে। তবে প্রধানমন্ত্রী চাইলে সংবিধান অনুযায়ী বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি নিয়ে তিনি নির্বাচনকালীন একটি সরকার করতে পারেন।
ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী মানবজমিনকে বলেন, আমরা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই না। আমরা দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন চাই। তবে নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের যে দায়িত্ব, সেটা যথাযথভাবে যাতে তারা পালন করতে পারেন-আমরা সেটাও চাই।
সূত্র: মানবজমিন