পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের সভাপতি ইমরান খান একের পর এক মামলায় সাজা পেয়ে কারাগারে রয়েছেন। মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যাওয়ায় নিজে নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না। দলের শীর্ষ অনেক নেতাও কারাবন্দি। দলীয় প্রতীক বরাদ্দও পাননি। ফলে দলের ব্যানার থেকে বাকিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না, অংশ নিতে হচ্ছে স্বতন্ত্র হিসেবে।
তবে এখনো আশা ছাড়েননি ইমরান খান ও তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগে থেকেই পিটিআই নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় করা হয়েছে। নির্বাচনি প্রচারেও তাদের সশরীরে খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। এবার পিটিআই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে হাতিয়ার বানিয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে পাল্টা জবাব এবং নির্বাচনি প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। দলের অনেক মাঝারি সারির নেতা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। যদিও তাদের বেশিরভাগই পরীক্ষিত নন এবং দলীয় প্রতীকে নয় বরং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তারা ভোটের ময়দানে নেমেছেন।
এমনই এক প্রার্থী রেহেনা দার। বয়স ৭০ এর কোটার এই নারী শিয়াল কোটের একটি সরু রাস্তায় প্রচারপত্র বিলি করছেন। তার কর্মীরা ড্রাম বাজিয়ে তার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে এবং ওপর থেকে গোলাপের পাপড়ি ছেটানো হচ্ছে।
রেহেনার সহকর্মীদের অনেকেই ধরপাকড় ও মামলার ভয়ে পালিয়ে রয়েছেন। ফলে অপ্রত্যাশিতভাবে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা রেহেনা বলেছেন, আমার শহর শিয়ালকোটের গর্বিত ছেলে ও মেয়েরা, ভাইয়েরা এবং মায়েরা আমার পাশে আছেন। এটা দারুণ কিছু।
তিনি বলেন, আমি ইমরান খানের সঙ্গে আছি, থাকব। জনসম্মুখে একা ছেড়ে দিলেও আমি ইমরান খানের পতাকা নিয়ে রাস্তায় নামব।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেহেনাকে ঘিরে ছোট্ট যে দলটি রয়েছে তাদের দেখে বোঝাই যাচ্ছে তিনি যা বলছেন তা সত্যি। কারণ, তার পাশে জড়ো হওয়ার সবার হাতেই ইমরান খানের ছবি। পিটিআই এর পতাকা মাথার ওপর উড়ছে।
পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন একেবারে শেষ মুহূর্তে পিটিআইকে তাদের দলীয় প্রতীক ‘ব্যাট’ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যা নিয়ে পাকিস্তানে এবং পাকিস্তানের বাইরে সমালোচনা হয়েছে।
একজন প্রার্থী কী প্রতীক পেলেন সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে না হলেও ৫৮ শতাংশ নিরক্ষর মানুষের দেশে তেমনটা ভাবার অবকাশ নেই। কারণ, তারা পিটিআইকে ভোট দিতে চাইলেও ঠিকমত বুঝে ঠিক ঠিক প্রতীকে সিল মারা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ, পিটিআইয়ের যেসব নেতা স্বাতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে নেমেছেন তারা এক একজন এক এক প্রতীক পেয়েছেন। রেহেনা পেয়েছেন ‘বেবি কট’। কেউ ঘুড়ি, কেউবা স্যাক্সোফোন।
রেহেনা এবার যে আসন থেকে নির্বাচন করছেন গত নির্বাচনে সে আসনে প্রার্থী ছিলেন তার ছেলে উসমান দার। যিনি পিটিআই এর একজন জ্যেষ্ঠ নেতা এবং ইমরান খানের আমলে যুবমন্ত্রণালয়ের বিশেষ উপদেষ্টা ছিলেন।
গত বছর অক্টোবরের শুরুর দিকে উসমান হঠাৎই উধাও হয়ে যান। তিন সপ্তাহ তার পরিবার তার কোনো খোঁজ পায়নি। পরে তারা দেখেন উসমান গত ৯ মে মাসের দাঙ্গার জন্য ইমরান খানকে দায়ী করে টেলিভিশনে বিবৃতি দিচ্ছেন।
গত ৯ মে পুলিশ ইমরান খানকে গ্রেফতার করলে দেশজুড়ে তীব্র বিক্ষোভ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন পিটিআই এর নেতা কর্মীরা। যদিও আন্দোলন মাত্র দুইদিন স্থায়ী হয়েছিল। পরে ইমরান মুক্তি পান কিন্তু তার দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় অব্যাহত থাকে।
ইমরান বর্তমানে তোষাখানা মামলায় কারাগারে রয়েছেন। কারাগারে বিশেষ আদালত বসিয়ে তার বিরুদ্ধে হওয়া আরো বেশ কয়েকটি মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন হয় এবং তিনি বিভিন্ন মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড পান। এক সপ্তাহের মধ্যেই তার তিনটি মামলার রায় হয়। সেগুলোয় তিনি ১৪ বছর, ১০ বছর ও ৭ বছরের কারাদণ্ড পান।
রেহেনা দার বলেন, যখন উসমান দার টেলিভিশনে বিবৃতি দেয় তখন আমি তার সঙ্গে একমত ছিলাম না। আমি তাকে বলেছিলাম, যদি এর বদলে তোমার মৃত্যুও হতো তবু সেটাই ভালো ছিল। তুমি মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছো।
অক্টোবরের বিক্ষোভ-সহিংসতার পর, মামলা-হামলার ভয়ে পিটিআইয়ের বহু নেতাকর্মী পালিয়ে যান। উসমানের মতো অনেকেই এখনো কারাগারে রয়েছেন। কয়েকজন প্রার্থী কারাগার থেকেই প্রচার চালাচ্ছেন। দোষী সাব্যস্ত না হলে কারাগার থেকেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন তারা। অন্যরা পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে আছেন। এমন একজন প্রার্থী হলেন খাইবার পাখতুনখাওয়ার প্রাদেশিক মন্ত্রী আতিফ খান। গত মে মাস থেকে পালিয়ে আছেন তিনি। ভোটের প্রচার চালাচ্ছেন ভিডিও বার্তার মাধ্যমে। তার প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, তার বিশ্বাস, সুষ্ঠু বিচার পাবেন না তিনি। তাই প্রকাশ্যে আসছেন না।
তাদের মতে, পিটিআই-এর সবচেয়ে বড় সমর্থক তরুণ ভোটাররা। তারা মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সক্রিয়। তাই তাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ডিজিটাল পদ্ধতিই ব্যবহার করছেন তারা।
পিটিআইয়ের প্রচারের জন্য প্রযুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দলের অফিসিয়াল এক্স, ইনস্টাগ্রাম এবং টিকটক একাউন্টে লাখ লাখ ফলোয়ার। যা অন্য দুটি প্রধান দল – পিপিপি এবং পিএমএল-এন – এর সমন্বিত সংখ্যার চেয়েও বেশি। তাছাড়া এসব মাধ্যমে ইমরান খানের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যার মাধ্যমে তার বার্তা সরাসরি জনগণের কাছে পৌঁছাচ্ছে।
এবার পিটিআই নতুন একটি ওয়েবসাইটও তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে ভোটাররা নির্বাচনি এলাকায় পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীর প্রতীক সহজেই খুঁজে পেতে পারেন।
নির্বাচনি সভা আয়োজনেও বাধার সম্মুখীন হয়েছে পিটিআই। পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীদের সভায় পুলিশ বাধা দিয়েছে। ধরপাকড় চালিয়েছে। যেভাবেই হোক, তাদেরকে প্রচার চালানো থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতেও ইমরান খানের কারাদণ্ডের খবর ছাড়া তাকে বা তার দলকে নিয়ে অন্য কেন খবর প্রচারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
এমন সমস্যার সমাধান হিসেবে দলটি হাজির হয়েছে ভার্চুয়াল সমাবেশের ধারণা নিয়ে। পিটিআইয়ের সোশ্যাল মিডিয়া প্রধান জিবরান ইলিয়াস শিকাগো থেকে ফোনে বিবিসিকে বলেছেন, এটি সস্তা, নিরাপদ ও দ্রুত। শারীরিক উপস্থিতির সমাবেশের তুলনায় হয়ত এগুলোর প্রভাব কম। কিন্তু আমাদের বার্তা পৌঁছানোর চেষ্টা তো করতে হবে। ইমরান খানকে ছাড়া আমরা আগে কোনো রাজনৈতিক সমাবেশ করিনি। তাকে ছাড়া এসব সমাবেশ কাজে আসবে কিনা তা স্পষ্ট নয়।
ইলিয়াস বলছেন, মানুষ ইমরান খানের বক্তব্য শুনতে চাইছে। কিন্তু তিনি কারাগারে। ফলে সমাধান হিসেবে গত ডিসেম্বরে একটি অনলাইন সমাবেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরি ইমরানের বক্তব্য প্রচার করা হয়েছিল।
এমন উদ্যোগগুলোতেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পিটিআই সমাবেশকে ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় একাধিকবার ব্যাঘাত ঘটেছিল।
এ বিষয়ে ওয়াশিংটন ভিত্তিক উইলসন সেন্টার থিংক ট্যাংক এর সাউথ এশিয়া ইন্সটিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, পাকিস্তানে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে পিটিআইয়ের নির্বাচনি প্রচার চালানোয় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আগেও এমনটা দেখা গেছে। বিশেষ করে গত নির্বাচনের সময় যখন নওয়াজ শরীফ কারাগারে ছিলেন।
তিনি বলেন, এবারও সম্ভবত একই ঘটনা ঘটবে, কারণ সবই এক; শুধুমাত্র খোলোয়াড় বদলে গেছে।
তাই গতবার নওয়াজের ভাগ্যে যা ঘটেছে এবার ইমরানকেও একই ভাগ্য বরণ করে নিতে হবে, এমনটাই মনে করতে পারেন তারা ভোটাররা। তারা ভাবতে পারেন, পিটিআই কোনো ভাবেই জিততে পারবে না। তাই হয়তো তারা ভোট দিতেই যাবেন না।
কুগারম্যান বলেন, পিটিআই নেতাদের কাছে এখন একটাই প্রশ্ন, ইমরান কারাগারে থাকা সত্ত্বেও কীভাবে একটি বৃহৎ সমর্থকগোষ্ঠীকে ভোটের দিন বেরিয়ে আসতে এবং তাদের সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট দিতে অনুপ্রাণিত করবেন। পিটিআইয়ের কেউ কেউ অবশ্য বিশ্বাস করছেন, যদি ভোটের দিন ভোটার উপস্থিতি ভালো হয় তবে অলৌকিক কিছু ঘটতে পারে এবং তারা জিতে যেতে পারেন।
সূত্র: বিবিসি