জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গতকাল রোববার তিন দিনের সফরে ভারতে গেছে। এই সফরের প্রেক্ষাপটে আজ সোমবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’। প্রতিবেদনটি লিখেছেন কল্লোল ভট্টাচার্য।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদলকে আতিথ্য দেওয়ার দিন কয়েক পর ঢাকার রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে ভারত। তারা জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদেরের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদলকে ভারতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। জি এম কাদের ইতিমধ্যে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে একটি সর্বদলীয় সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতীয় পার্টির এই প্রতিনিধিদলের ভারত সফরে আসাটা তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, ভারত আসন্ন জি-২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আতিথ্য দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। এই সম্মেলনে বাংলাদেশকে ‘অতিথি দেশ’ হিসেবে ইতিমধ্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কেন্দ্রে রয়েছে দেশটির প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে দলটির দাবি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আসন্ন নির্বাচন যথাসময়ে করার ব্যাপারে জোর দিয়ে আসছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ছাড়াই এই নির্বাচন করতে চায় তারা। কারণ, ২০১১ সালে এক সংসদীয় আইনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) বাতিল হয়ে গেছে।
টেলিফোনে দ্য হিন্দুকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় জি এম কাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ও বিএনপি—উভয় পক্ষের সঙ্গে নিজের একটা সমদূরত্বের ভাব বজায় রাখেন। তিনি বলেন, ‘সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে এগিয়ে আসাটা সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই, সব পক্ষ বসুক। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার উপায় নিয়ে তারা আলোচনা করুক।’
জি এম কাদের অবশ্য বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারা (বিএনপি) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টিতে জোর দিয়ে আসছে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন ঠিক কেমন হওয়া উচিত, তা তারা স্পষ্ট করেনি।
জি এম কাদেরকে একটি তৃতীয় বিকল্প সমর্থন করতে দেখা গেছে। এটি একটি সমঝোতামূলক ফর্মুলা, যা পক্ষগুলোর অনমনীয় অবস্থানের একটা সমাধান দিতে পারে। তিনি দ্য হিন্দুকে বলেন, ‘আমাদের ভাবনায় একটি ফর্মুলা আছে। যখন সর্বদলীয় সংলাপ হবে, তখন আমরা তা আলোচনার টেবিলে উপস্থাপন করব।’
গত পক্ষকাল ধরে বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দিক থেকে যোগাযোগসহ নানা মন্তব্য আসতে দেখা গেছে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হলো জি এম কাদেরের ভারত সফর।
গত সপ্তাহে মার্কিন কংগ্রেসের দুই সদস্য রিচ ম্যাককরমিক ও এড কেইস বাংলাদেশ সফর করেন। সফরকালে তাঁরা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনসহ বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বৈঠক শেষে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘দুজনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ কংগ্রেসম্যান (এড কেইস) স্পষ্টভাবে আমাদের বলেছেন, তাঁরা এমন একটি নির্বাচন দেখতে চান, যা নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে এবং বিশ্ব এই নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু হিসেবে গণ্য করবে।’
১৭ আগস্ট উভয় কংগ্রেসম্যানকে ভারতের অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে (ওআরএফ) আতিথ্য দেওয়া হয়। সেখানে তাঁরা একটি ‘রুদ্ধদ্বার আলোচনায়’ যোগ দিয়েছিলেন।
বৈঠকটির এক দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তন প্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট ফোরামের ওয়াশিংটন প্রজেক্টের পরিচালক ক্লিফোর্ড স্মিথের সঙ্গে ওআরএফের একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশে বিকাশমান পরিস্থিতির ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্র সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
বৈঠকে ক্লিফোর্ড স্মিথ যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর কার্যক্রমের বিস্তারিত বিবরণ দেন। একপর্যায়ে তিনি বলেন, জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ছিল ‘বিশ্বের সবচেয়ে সহিংস’।
ক্লিফোর্ড স্মিথ অবশ্য উল্লেখ করেন, শেখ হাসিনা সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী সংস্থা র্যাব দেশটিতে ধর্মীয় মৌলবাদীদের দমনে যথেষ্ট কাজ করেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এমন মন্তব্যের প্রেক্ষাপটে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ও মিয়ানমার বিভাগের যুগ্ম সচিব স্মিতা পন্তকে ঢাকার বিষয়ে নয়াদিল্লির বিদ্যমান অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করতে দেখা যায়। ১৫ আগস্ট তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ‘শেখ মুজিবের খুনিরা তাঁর আদর্শকে মুছে দিতে পারেনি।’
গত শনিবার ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের একটি ‘বিশ্বস্ত অংশীদার’ ভারত।
ভারতে জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিদের আগমনের মাধ্যমে চলমান যোগাযোগ-বিনিময় স্পষ্টতই প্রসারিত হচ্ছে। ঢাকার কিছু সূত্রের ইঙ্গিত, অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মহলেও একই ধরনের যোগাযোগের উপায় খোলা রয়েছে।
এগুলো ছাড়াও সরকারের সঙ্গে সরকারের আলোচনা আরও গভীর হবে। কারণ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা—উভয়ে ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে যাবেন। ব্রিকসের সদস্যপদ চাইছে, এমন কয়েকটি দেশ এই সম্মেলনে অংশ নিতে যাচ্ছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
সূত্রঃ প্রথম আলো