স্বপ্নের পদ্মা সেতু শনিবার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পর সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হবে প্রমত্তা পদ্মার ওপর নির্মিত এ সেতু। স্বপ্নের পদ্মা সেতু খুলে দেবে সড়কপথে আরও সহজে দেশের দক্ষিণ জনপদে পৌঁছানোর দুয়ার।
প্রকল্পের নাম
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প।
অবস্থান
রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। দেশের মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলায় প্রকল্পের অবস্থান। সেতুর উত্তর প্রান্তে মাওয়া, লৌহজং, মুন্সীগঞ্জ এবং দক্ষিণ প্রান্তে জাজিরা, শরীয়তপুর, শিবচর ও মাদারীপুর।
যেভাবে শুরু
১৯৯৮-১৯৯৯ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সর্বপ্রথম পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এরপর ২০০১ সালে জাপানিদের সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০০৪ সালের জুলাইয়ে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সুপারিশ মেনে মাওয়া-জাজিরার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করে।
ক্ষমতাগ্রহণের ১৩ দিনের মাথায় ২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শক নিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন এবং ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর জন্য নকশা প্রণয়নে পরামর্শক নিয়োগ দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১০ সালে পরামর্শক সেতুর প্রাথমিক নকশা সম্পন্ন করে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতু করার চূড়ান্ত নকশা করা হয়।
একনেকে অনুমোদন
২০০৭ সালে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন পায়। পরে নকশা পরিবর্তন হয়ে দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয়ও বাড়ে। ২০১১ সালে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকার সংশোধিত প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। একই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণসহায়তার অনুমোদন দেয়। ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঋণচুক্তি সই হয়। একই প্রকল্পে ২০১১ সালের ১৮ ও ২৪ মে যথাক্রমে জাইকা ও আইডিবির সঙ্গে এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঋণচুক্তি সই হয়। ২০১৬ সালে আবারও আট হাজার ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ালে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সবশেষ প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর পুরো টাকাই সরকারি অর্থায়ন।
বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল
পদ্মা সেতু নির্মাণে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ অঙ্গীকার করেছিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু অনিয়মের অভিযোগ তুলে এই অঙ্গীকার থেকে সংস্থাটি সরে যায়। এ ধরনের কাজের শর্ত অনুযায়ী মূল ঋণদাতা চলে গেলে চলে যায় অন্যরাও। কাজেই একে একে এডিবি, জাইকা ও আইডিবিও চলে যায়। এরপর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মোট ব্যয়
৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।
মূল সেতুর ঠিকাদার
পদ্মা সেতু নির্মাণে চুক্তিবদ্ধ কোম্পানির নাম চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের আওতাধীন চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি।
কাজ শুরু
২৬ নভেম্বর, ২০১৪।
চুক্তি অনুযায়ী কাজ সমাপ্তির তারিখ
২৫ নভেম্বর, ২০১৮। পরে কয়েক ধাপে সময় বাড়ানো হয়।
রেল সংযোগ
পদ্মা সেতুতে রেললাইন স্থাপন হচ্ছে স্প্যানের মধ্য দিয়ে।
নকশা
আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম এইসিওএমের (AECOM) নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল।
প্রধান উপকরণ
কংক্রিট ও স্টিল।
দৈর্ঘ্য
পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার।
প্রস্থ
পদ্মা সেতুর প্রস্থ হবে ৭২ ফুট, এতে থাকবে চার লেনের সড়ক। মাঝখানে রোড ডিভাইডার।
ভায়াডাক্ট
পদ্মা সেতুর ভায়াডাক্ট ৩ দশমিক ১৮ কিলোমিটার।
ভায়াডাক্ট পিলার
৮১টি।
পানির স্তর থেকে উচ্চতা: ৬০ ফুট।
পাইলিং গভীরতা: ৩৮৩ ফুট।
মোট পিলার: ৪২টি।
মোট পাইলিং: ২৮৬টি।
সংযোগ সড়ক: পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক দুই প্রান্তে (জাজিরা ও মাওয়া) ১৪ কিলোমিটার।
মোট লোকবল: পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ করছে প্রায় চার হাজার মানুষ।
নদীশাসন
প্রকল্প এলাকায় প্রায় ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন করতে হচ্ছে। এর মধ্যে মাওয়া এলাকায় ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার এবং বাকি ১২ দশমিক ৪০ কিলোমিটার জাজিরা এলাকায়। ঠিকাদারের নাম: সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড চায়না।
ভূমি অধিগ্রহণ: ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ ২ হাজার ৬৯৩ দশমিক ২১ হেক্টর।
সেতু পাড়ে বৃক্ষরোপণ: লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৪ লক্ষাধিক।
পদ্মা সেতু জাদুঘর স্থাপন
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার দোগাছি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পদ্মা সেতু সার্ভিস এরিয়া ১-এ স্থাপিত ওই সংগ্রহশালাটির নাম পদ্মা সেতু প্রাণী জাদুঘর। এটি পদ্মা সেতু প্রকল্পেরই অংশ। বাস্তবায়ন করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ। এই মুহূর্তে জাদুঘরটিতে জনসাধারণের প্রবেশের কোনো সুযোগ না থাকলেও ইতোমধ্যে সেখানে দুই হাজারের বেশি নমুনা সংরক্ষণ করা হয়েছে।
এখানে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রাণিদেহের নমুনা সংরক্ষণ করা হয়েছে। ফলে নমুনাগুলো দৃষ্টিনন্দন ও দীর্ঘস্থায়ীও।
২০১৬ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। পদ্মা অববাহিকার জেলা শরীয়তপুর, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জ অঞ্চলের পশু-পাখি নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে পদ্মা সেতু প্রাণী জাদুঘর। সেতু বিভাগের কাছে হস্তান্তরের পর জাদুঘরটি সবার জন্য উন্মুক্ত হবে।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও অভয়ারণ্য ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি
পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা সম্পন্ন হয়েছে এবং গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। ‘খসড়া ম্যানেজমেন্ট প্লান’ চূড়ান্তকরণের কাজ চলমান।