পৃথিবী কি বাসযোগ্য থাকবে?

শফিকুল ইসলাম খোকন

ধরা, ধরিত্রী, দুনিয়া, পৃথিবী… এসব শব্দের সঙ্গে আমরা অতি পরিচিত। প্রতি মুহূর্ত না হলেও প্রতিদিনই কোনো না কোনো সময় এ শব্দগুলো মুখে উচ্চারণ করে থাকি। সংসারের প্রধান যেমন অলিখিত রীতিনীতি দ্বারা হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতি লালন করে সংসার তার নিজের মতো করে পরিচালনা করেন এবং পরিবারের সদস্যদের তৈরি করেন বসবাসযোগ্য করে, ঠিক তেমনি পৃথিবীও হাজার হাজার বছর ধরে কিছু অলিখিত কিছু লিখিত রীতিনীতি অনুযায়ী প্রকৃতির মতো করে বাসযোগ্য তৈরি করে মানবজাতি। সংসার যেমন পরিবারিক এবং সামাজিক বন্ধন তেমনি পৃথিবীও হচ্ছে প্রকৃতির বন্ধন। ঠিক সংসারের বন্ধন ঐতিহ্য ধরে রাখা যেমন মানুষের দায়িত্ব তেমনি প্রকৃতির অস্তিত্ব এবং বন্ধন টিকিয়ে রাখার দায়িত্বও মানুষের। আর যখনই এর ব্যত্যয় ঘটে তখনই পরিবর্তন হয়, আর পরিবর্তন হলেই ঐহিত্যের সংকট তৈরি হয়, সংকট মানেই হলো হাজার হাজার বছরের অস্তিত্ব সংকটে পড়া। আজ পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধন যেমন হারিয়ে যাচ্ছে তেমনি প্রকৃতির গতিপথ হারিয়ে যাচ্ছে পাশাপাশি পৃথিবীর অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে।

যদি বলি পৃথিবী আজ স্বাভাবিক নয়; পৃথিবীর স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে বা ফেলেছে? বর্তমান পরিবেশ, প্রতিবেশ, আবহাওয়ার দিক বিবেচনা করলে অনেকেই আমার এ কথার সঙ্গে একমত হবেন। একটু ভেবে দেখুন তো? পৃথিবী আজ কোন পথে হাটছে, পৃথিবী আগের মতো আছে কিনা, পৃথিবী কি প্রকৃতির মতো করে চলছে? পৃথিবীর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত দুনিয়ার বিবর্তন কি? এমন প্রশ্নের উত্তর রয়েছে অনেকের কাছেই। কিন্তু কেউ বলবে, কেউ বলতে পারছে অথবা কেউ বলবেই না। কেউ বলুক আর নাই বা বলুক পৃথিবীর অস্তিত্ব সংকটের জন্য প্রকৃতি দায়ী নয়, দায়ী আমরা। আর তাই পৃথিবী গড়ার দায়িত্বও আমাদের। যদি বলি পৃথিবীর উষ্ণতম বছর হলো ২০২৪ সাল। তাহলে মনে হয় ভুল হবে না। বছরটি উষ্ণতার দিক থেকে আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এতে বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস সত্য প্রমাণ করে নিশ্চিত হওয়া গেল ২০২৪ ছিল এ গ্রহের এ যাবৎকালের উষ্ণতম বছর। ২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল বিশ্ব ধরিত্রী দিবসে ‘নিজেদের বাঁচাতে ধরিত্রী রক্ষা করতে হবে’ এ শিরোনামে প্রবন্ধে লিখছিলাম ‘পৃথিবীর অস্তিত্ব সংকটের জন্য দায়ী মানুষ’। ২০২৩ সালে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়ে আরো বলেছিলেন, পৃথিবীর এ অবস্থা মানুষেরই সৃষ্টি। এ গ্রহ গরম হয়ে ওঠার পেছনে জীবাশ্ম জ্বালানির বহুল ব্যবহারই দায়ী। তাই আর সময়পেণ নয়, দ্রুত নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথে আমাদের হাঁটতে হবে। তা না হলে বর্তমান পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ক্লাইমেট সার্ভিসের তথ্যমতে, জীবাশ্ম জ্বালানির বহুল ব্যবহার শুরুর দীর্ঘ সময়ের গড় উষ্ণতা বাড়ার তুলনায় ২০২২ সালে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৪৮ ডিগ্রি। গেল বছরের জুলাই মাস থেকে প্রতিদিনই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার রেকর্ড সৃষ্টি হয়। অথচ বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধের ল্যমাত্রা অর্জন এখন সত্যিই ব্যর্থতার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে তাই দরকার গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন ও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের রাশ শক্ত হাতে টেনে ধরা। ২০২৩-এর নভেম্বর মাসও তার আগের বছরের নভেম্বর মাসের উষ্ণতার চেয়ে উষ্ণতর মাস হিসাবে রেকর্ড গড়ে। গেল বছরের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ছিল শিল্পায়ন যুগের আগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয় নতুন রেকর্ড। ইউরোপভিত্তিক জলবায়ুবিষয়ক পর্যবেক সংস্থা কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের (সিথ্রিএস) এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। সেখানে আরো বলা হয়, শিল্পপূর্ব অক্টোবর মাসের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস ছিল অনেক বেশি উষ্ণ। এর তাপমাত্রা ছিল ১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কোপারনিকাস সার্ভিসের উপপ্রধান সামান্তা বারগেসের মতে, ২০২৩ সালের ছয়টি মাস এবং দুটি মৌসুম উষ্ণতার বেলায় নতুন রেকর্ড গড়ে। তাই ২০২৩ সাল হলো স্মরণকালের উষ্ণতম বছর। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জোরদার হয় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রেখে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার দাবি। ২০২৪ সালে এসে আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ২৯ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৪৩.৮ ডিগ্রি। এর আগে, ১৯৯৫ সালের ১ মে দেশটির সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওই বছরের ২৫ এপ্রিল তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৩ ডিগ্রি। ১৯৮৯ সালেও একবার ৪৩ ডিগ্রি ছাড়িয়েছিল জেলাটির তাপমাত্রা। ওই বছরের ৪ মে তাপমাত্রা ৪৩.৩ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়, এই নিয়ে ৪০ বছরে চারবার থার্মোমিটারের পারদ এই মাত্রা স্পর্শ করেছে।

এ তো বললাম তাপমাত্রা আর বৈশ্বিক জলাবয়ু পরিবর্তনের ফলে নানা সংকট। এখন বলবো ভিন্ন কথা। সবাই বলছেন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নানা সংকটের কথা, দাবিও করা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তিগ্রস্তদের তিপুরণ দেয়ার। কিন্তু উপকূলের কথা কি কেউ ভাবছেন? উপকূলের কথা বলার আগে একটু নগর নিয়ে কিছু বলতে চাই। ধরুন আপনি তরকারি দ্রুত রান্না করতে রাইস কুকার ব্যবহার করেন। রাইস কুকার চালু করার পর তার মধ্যে বাস্প তৈরি হয় যা দ্রুত বের হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে ঢাকা শহরের দিকে তাকালে ওইরকম রাইস কুকারের মতো মনে হলেও বাস্প বের হতে পারছে না। আমি যদি আরো ক্লিয়ার করে বলি তা হলো ঢাকা শহরের বাস্প তৈরি হচ্ছে কিন্তু বের হওয়ার কোনো পথ নেই অর্থাৎ ঢাকা শহরে কোনো গাছ নেই, আশপাশে কোনো জলাধর বা জলাশয় নেই। খুব সহজে বুঝা গেলো গাছের অভাবের কারণেই দাবদাহ, তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং অ্যান্ড জিআইএসের একটি চলমান গবেষণার তথ্য অনুযায়ী দেখা গেছে, ২০২০ থেকে ২০২৪ এই চার বছরে ১ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত দেড় মাসের তাপমাত্রা তুলনা করা হয়েছে। বছরের এ সময়টায় তাপমাত্রা বেশি থাকে। দেখা গেছে, এ সময় জাহাঙ্গীরনগরের চেয়ে ঢাকায় তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি বেশি থাকে। জাহাঙ্গীরনগরের তাপমাত্রা কম থাকার কারণ, এখানকার গাছপালা, ওয়েট ল্যান্ডস (জলাভূমি), লতাগুল্মের সবুজ আচ্ছাদন।’ স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য ঢাকা শহরে ২০ শতাংশ স্থানে গাছপালায় আচ্ছাদিত রাখা উচিত ছিল, সেখানে আছে মাত্র ২ শতাংশ। অপর একটি পরিসংখ্যানের তথ্যমতে, ১৯৯৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৯ বছরে ঢাকা নগরাঞ্চলের সবুজ ও ফাঁকা জায়গা ৫২ দশমিক ৪৮ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে ২৯ দশমিক ৮৫ বর্গকিলোমিটার হয়েছে। গত ২৮ বছরে রাজধানী থেকে ২৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জলাধার উধাও হয়ে গেছে। এ সময়ে প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার সবুজের মৃত্যু হয়েছে। ১৯৯৫ সালে রাজধানীতে জলাধার ও জলাভূমি ছিল ৩০ দশমিক ২৫ বর্গকিলোমিটার। ২০২৩ সালে সেটা মাত্র ৪ দশমিক ২৮ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে রাজধানীর মাত্র ২ দশমিক ৯১ শতাংশ জলাধার ও ৭ দশমিক ০৯ শতাংশ সবুজ রয়েছে। অথচ একটি আদর্শ শহরে ১২ শতাংশ জলাভূমি ও ১৫ শতাংশ এলাকায় সবুজ থাকা প্রয়োজন। এখন বলতে হচ্ছে রাইস কুকারের মতো যদি বাস্প বের হতে না পারে ভেতরের তরকারি উপযোগি হবে অথবা নষ্ট হয়ে যাবে ঠিক তেমনি রাজধানীর দাবদাহ বের হওয়ার মাধ্যম যে গাছ পর্যাপ্ত নেই ফলে একটা সময় ঢাকা শহর অস্তিত্ব হারানোর পাশাপাশি বসবাস অযোগ্য হবে, ফলে দেখা যাবে মানুষের শ্বাস কষ্টসহ নানাবিধ রোগের সৃষ্টি হবে এবং যার শেষ প্রাণহানিও হতে পারে। হাস্যকর হলেও দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, পরিবেশ উপযোগী নয়, এমন গাছে ভরে আছে রাজধানী ঢাকা শহর। মাটির গঠন মূলত লাল মাটির। এই মাটিতে শালগাছ ভালো হয়। কিন্তু বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় বনসাই, চায়নিজ টগরসহ নানা দামি বিদেশি গাছ লাগানো হচ্ছে, যা পরিবেশ এবং মানুষের উপকারে নেই।

এখন আসছি উপকূলের বিষয়ে। উপকূললে মানুষের নেই কোনো কুল। উপকূলবাসীর প্রতিনিয়তই প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় আমাদের উপকূলীয় এলাকার প্রতিবেশ ব্যবস্থা অনেক সমৃদ্ধ। সেখানে লোনা ও মিঠাপানির মিশ্রণ আছে, বন তৈরির জন্য অনুকূল জলবায়ু আছে। বৃষ্টিপাতও ভালো। বেড়িবাঁধ এবং নদীর পাড়ে বনাঞ্চল হলো উপকূলের রাকবজ। কিন্তু এসব এলাকায় আমরা বনভূমি টিকিয়ে রাখতে পারিনি। বিগত সময়ে যতগুলো ঘূর্ণিঝড় হয়েছে সব ঘুর্ণিঝড়েই কমবেশি তিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবে যে বন গড়ে উঠছে, তাকে রক্ষা করতে হবে। উপকূলের চর ও নতুন জমি ছাড়াও অনেক ব্যক্তিগত জমি আছে, সেখানে বনায়ন সম্ভব। উপকূলের বনাঞ্চলের সঠিক পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপরে কাছে আছে বলে মনে হচ্ছে না। অথচ দিনদিন বনভূমি ধংস করা হচ্ছে। আর বন বা বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে তারও সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। অথচ এ বিষয় ভুরি ভুরি আইন বিধি রয়েছে।

উপকূলের পাঠকদের কাছে প্রশ্ন- একটু ভেবে দেখুন তো উপকূলীয় অঞ্চলে আপনাদের বাড়ির চারপাশে যেসব নদী, খাল, জলাশয় ছিল তা কি এখন বিদ্যমান আছে? আগে যেমন চারপাশে গাছ গাছালি ছিল এখন তা আগের মতো আছে? আগে যেমন গরমের দিনে বাতাস ঠান্ডা ছিল এখন কি আছে? না গরমের দিনে গরম বাতাসই আছে? আগের মতো কি পানি পাওয়া যায়? আর পানি পেলেও কি সুপেয় পানি আছে না লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। আগের চেয়ে ঝড়, জলোচ্ছাস কি বেড়েছে না কমেছে? আপনার বাড়ির মধ্যে জলাশয়, খালগুলো কি ভরাট করেছেন? আগের মতো প্রাকৃতিক বাগান এবং জীববৈচিত্র কি আছে? এরকম কত শত প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু এর উত্তর কি আসবে? হ্যা, একেক জনের মনে একেক রকমের জবাব আসবে। আমার কাছে এক কথায় জবাব রয়েছে আর তা হলো বর্তমানে প্রকৃতির দৃশ্যমান যে অবস্থা তা ভালো নেই। আগের মতো পানি নেই, জলাশয় নেই, বাগান নেই, জীববৈচিত্র বা প্রাণিকুল নেই, নদী-খালের গতি নেই, বন নেই। যা নেই তা আমাদের কারণেই নেই। পৃথিবী যেমন স্বাভাবিক গতি নেই, তেমনি মানুষের জীবনযাপনও স্বাভাবিক নেই। তাহলে কী করতে হবে? আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। নদী-নালা, বিল, হাওর, বাঁওড়ের মতো বহু জলাভূমি রয়েছে বাংলাদেশে। দেশের ৭ থেকে ৮ লাখ হেক্টর ভূমি কোনো না কোনোভাবে জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এসব ভরাটের মাত্রা দিনদিন বেড়েই চলেছে। এতে প্রকৃতি, জীববৈচিত্র সংরণ ও নগরের ভারসাম্য ব্যহত হচ্ছে। ২০২৩ সালের ‘আমাদের কৃষি, প্রকৃতি, জলাভূমির সুরা এবং নদী দখলদারি প্রতিরোধে করণীয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় জলাধার সংরণ বিষয়টি নতুন করে উঠে এসেছে। বক্তারা বলেন, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরাই নদী, বন, জলাভূমি দখল করে। এগুলোর আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) তথ্য বলছে, সারাদেশে প্রতি বছর ৪২ হাজার একর কৃষিজমি ও জলাশয় ভরাট হচ্ছে।

১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে পাঁচ হাজার ৭৫৭ একর জলাভূমি ভরাট হয়েছে। এর ফলে জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নদী, খাল, বিল, পুকুর ইত্যাদি পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়া চারপাশের বাতাসকে শীতল রাখা, বর্ষা মৌসুমে বন্যা প্রতিরোধ, শহরে জলাবদ্ধতা নিরসন, পানির চাহিদা পূরণ ও আবর্জনা পরিশোধনে জলাভূমিগুলোর গুরুত্ব অনেক। কিন্তু পৌরসভার কী কাজ? প্রাকৃতিক জলাধার সংরণ আইন-২০০০ এর ধারা ৫ অনুযায়ী, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। এছাড়া এ ধরনের জায়গার অন্য কোনোভাবে ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তরও করা যাবে না। একই আইনের ধারা ৮(১)-এ বলা হয়েছে, কেউ এই আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। এছাড়া উচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত করারও বিধান রয়েছে। ধারা ৮(২) ও ৮(৩)-এ এ ধরনের কারাদণ্ডের জন্য শাস্তি এবং নিজ খরচে সেটা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। ২০১৪ সালের ৬ মে এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সব খাল, খেলার মাঠ ও পার্ক রায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন অনুযায়ী প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত দুটি করে খেলার মাঠ থাকার কথা রয়েছে। সব ধরনের আইনকানুন ও আদালতের নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে খেলার মাঠ দখল চলছেই। এছাড়া সারাদেশেই নদী-খাল দখল-দূষণের মহোৎসব চলছে। চর পড়ে এবং দখল-দূষণের কারণে দেশের নদী-খালগুলো এখন মৃতপ্রায়। হারিয়ে যাওয়ার পথে বহু নদী-খাল-জলাশয়। যখন যেভাবে প্রয়োজন তখন সেভাবে নদী-খাল-জলাশয় ব্যবহার করা হচ্ছে। ভরাট করে দখল করার উৎসবে মেতে উঠেছে প্রভাবশালীরা। সারাদেশ যেন এখন নদী-খাল-জলাশয় বৈরী দেশে পরিণত হয়েছে। একের পর এক জলাভূমি হারিয়ে যাওয়া মানে জেনে বুঝে দেশের ক্ষতি ডেকে আনা। এখন পর্যন্ত উপকূল অথবা প্রান্তিকের জলাভূমির পরিসংখ্যান বা ভরাটের তথ্য সরকারের কাছে আছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। তাই জলাভূমি রক্ষায় প্রচলিত আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। জলাধার রক্ষা সরকারের দায়িত্ব, পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সচেতনসহ সম্পৃক্ত করতে হবে। স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে জলাভূমিগুলো সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।

পৃথিবী বাসযোগ্য করতে আমাদের যত্ন নিতে এবং টিকিয়ে রাখতে আমাদের করণীয় রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে সব মানুষকে পরিবেশসচেতন করে তুলতে হবে। বৃক্ষ কর্তনরোধ, বৃরোপণ ও বনসৃজনের দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বনাঞ্চল, জলাশয়, নদনদী, খাল-বিল সংরণ করতে হবে। নদী সাগরে প্লাষ্টি ফেলা বন্ধ করতে হবে, প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানি যথাসম্ভব কম ব্যবহার করতে হবে। জীববৈচিত্র্য সংরণের দিকে সব মানবজাতিকে নজর দিতে হবে। রি-সাইকেল পদ্ধতির মাধ্যমে দ্রব্যের পুনর্ব্যবহার করতে হবে। পরিবেশ রক্ষার জন্য মাঠ পর্যায় সচেতনামুলক কর্মসূচি করতে হবে, তরুণদের উদবুদ্ধ করতে হবে, বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজে প্রশাসনকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উপহার হিসেবে কাছের মানুষদের একহাতে বৃক্ষ আরেক হাতে বই দিতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিবেশ রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয় বাধ্যতামূলক পাঠদানে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। একটি নিরাপদ, টেকসই ও সুন্দর ধরিত্রীর জন্য আসুন, বাসযোগ্য পৃথিবী করতে নিজেদের এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক কলামিস্ট ও গবেষক

এ জাতীয় আরো সংবাদ

জলবায়ু প্রতিশ্রুতি পূরণে উন্নত বিশ্বের প্রতি পরিবেশমন্ত্রীর উদাত্ত আহ্বান

নূর নিউজ

নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব অনেকটাই কেটে গেছে

নূর নিউজ

ঢাকা মেডিকেলে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগী শনাক্ত

আনসারুল হক