ফরিদপুরীর রাজনৈতিক চিন্তা

আলমগীর মুরতাজা:

রাজনীতিকে ক্ষমতার সিংহাসনে আরোহণের সিঁড়ি হিসেবে বেছে নেয়ার নজির অত্যধিক। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে পৌঁছানো যদিও মন্দ কিছু নয়, কিন্তু একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের রাজনীতি যদি শুধুই আধিপত্যবাদী মনোভাব ও তৎপরতায় পরিচালিত হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার রাজনীতির শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে৷

আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.-এর গোটা জীবনের রাজনৈতিক তৎপরতা মূলত সংস্কারবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালিত হয়েছে৷ রাজনীতিকে কখনোই তিনি ক্ষমতায় আরোহণের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেননি৷ বরং দিকভ্রান্ত সমাজের আমূল সংস্কার ও ইসলামি আদর্শ বাস্তবায়নের বড় এক হাতিয়ার হিসেবে একে বেছে নিয়েছিলেন।

তবে সামগ্রিকভাবে তাঁর মধ্যে রাজনীতির চেয়ে নেতৃত্বদানের গুণটিই বেশি বিকশিত হয়ে উঠতে দেখা যায়। একজন রাজনীতিকের চেয়ে তিনি একজন দিকনির্দেশক হয়ে উঠেছিলেন বেশি৷ যখনই জাতীয় পর্যায়ে ভুলের অগাধ বিস্তার দেখতে পেয়েছেন, ক্ষমতাসীন ও বিশিষ্টজন নির্বিশেষে সকলকে এ থেকে উত্তরণের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, দিয়েছেন দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ, আদেশও করেছেন কখনও কখনও৷ মাদরাসায় ইলমে নববির পাঠদানের পাশাপাশি প্রয়োজনবোধে বিক্ষোভ-মিছিল ও হরতালেরও নেতৃত্ব দিয়েছেন৷ দিয়েছেন বিভিন্ন দল ও সমাবেশের নেতৃত্ব৷ স্বৈরাচারী জুলুমবাজ শাসকদের বিরুদ্ধে হয়ে উঠেছিলেন বজ্রকণ্ঠ৷ অসীম সাহসে তাদের শুনিয়েছেন অন্তরাত্মায় কাঁপন-ধরানো হুমকি-ধমকি৷ তাঁর এইসব হুমকির মুখে কেঁপে উঠেছে স্বৈরশাসকদের পায়ের তলার মাটি৷ অত্যন্ত বিচক্ষণতায় তাদের অসুস্থ রাজনীতি ও রাষ্ট্রের সার্বিক পরিস্থিতির মূল সমস্যার গোড়ায় তিনি হাত দিয়েছেন, বাতলে দিয়েছেন উত্তরণের উপায় ও উপকরণের কথাও৷

পাকিস্তানি স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে তাঁকে জোরদার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে৷ কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের চেয়ারে বা সম্মুখসারিতে তাঁকে কখনোই দেখা যায়নি৷ তবে হ্যাঁ, যখন মানুষকে সঠিক পথে আহ্বানের, তাদের ভেতর সংস্কার ও সংশোধনের এবং ধর্ম ও জনগণের স্বার্থের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তখন ক্ষমতা ও নেতৃত্বকে তিনি এসবের উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে চেয়েছেন৷

ভোগবাদী ক্ষমতার প্রতি তাঁর অনাসক্তির একটি দারুণ চিত্র আমরা দেখে উঠতে পারি নিচের এই ঘটনায় :

১৯৪৫ সালের ২৫ জুন৷ ভারতের হিমাচল প্রদেশের সিমলা শহরে কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক সিমলা কনফারেন্স৷ এতে অংশগ্রহণ করেন শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নিজামুদ্দীন, মওলানা আকরম খাঁ, জনাব তমিজউদ্দীন ও মাওলানা আতহার আলি-সহ বিশিষ্ট অনেক নেতৃবর্গ৷ এই কনফারেন্সে শামছুল হক ফরিদপুরী এক ঐতিহাসিক বিপ্লবাত্মক ভাষণ দেন৷ তাঁর ভাষণ শুনে স্তম্ভিত হয়ে যান কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ৷ তখন তিনি শামছুল হক ফরিদপুরীকে অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সভাপতি হওয়ার জোরালো প্রস্তাব দেন৷ কিন্তু, পূর্বেই বলেছি, ফরিদপুরী রহ. মূলত ক্ষমতার লোভে রাজনীতি করতেন না৷ পাকিস্তানে ইসলামি শাসনব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যেই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছিলেন তিনি৷ জীবন বাজি রেখে করছিলেন সমাবেশের পর সমাবেশ৷ উচ্চকিত করেছিলেন ভাষণের পর ভাষণ৷

তাই জিন্নাহর প্রস্তাব শুনে তিনি স্মিত হেসে মাথা দুলিয়ে তা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন৷ তারপর নিজ উদ্যোগে এই পদে বসালেন খাজা নিজামুদ্দীন সাহেবকে৷

ছাত্রজীবনেই তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের জার্নি আরম্ভ করেছিলেন৷ এ সূত্রে গত শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজের নাম লেখান তিনি৷ তারপর মাওলানা শিব্বির আহমাদ উসমানির নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পতাকাতলে অংশগ্রহণ করেন৷ এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৩৬৫ হি. থেকে ১৩৬৬ হি. পর্যন্ত ব্যাপক প্রচেষ্টা চালান।

ছোটবেলা থেকেই তিনি কোরআনি রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। অসত্যের বিরুদ্ধে চির সংগ্রামই ছিল তাঁর রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি৷ জাতীয় আদর্শকে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে সমাসীন করতে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালেই বিজাতির সামনে গর্বের সাথে ইসলামি পোশাকের জিহাদি প্রদর্শনী দেখিয়েছিলেন তিনি৷ কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে যখন পড়েন, কলেজ-ক্যাম্পাসে তখনকার অবিভক্ত বাংলার প্রেসিডেন্ট শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হকের লক্ষাধিক জনতার এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। আসরের নামাজের সময় অনেকটা পেরিয়ে গেলেও ফজলুল হক যখন বক্তব্য বন্ধ করছিলেন না, উপস্থিত জনতার ভেতর থেকে দাঁড়িয়ে শামছুল হক ফরিদপুরী তাকে মাঝপথে থামিয়ে দেন, এবং আদায় করে নেন আসরের নামাজের বিরতি৷

১৯২০ সালে বৃটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন, এবং কলেজে পড়া বন্ধ করে কোরআন-হাদিসের শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন৷ পরবর্তী পর্যায়ে স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে এবং অখণ্ড ভারত ও পাকিস্তানের নামে আলাদা স্বাধীন ইসলামিক স্টেট কায়েমের জন্য দুইটি পৃথক গতিধারার সৃষ্টি হয়৷ শামছুল হক ফরিদপুরী তখন পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন৷

মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর উত্থাপিত অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেও পরে তিনি ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আশায় ১৩৬৬ হিজরিতে মুসলিম লীগের পার্লামেন্ট সদস্য হয়েছিলেন, এবং ১৩৭৩ হিজরির সংসদ নির্বাচনে এ লক্ষ্যে বেশ তৎপরতাও দেখিয়েছিলেন৷ কিন্তু যখন বুঝতে পারেন, মুসলিম লীগের নেতারা মূলত ধোঁকার আশ্রয় নিয়েছে, ইসলামি শাসনব্যবস্থা কায়েমের কথা তুলে তারা মূলত সুবিধা ভোগ করতে চেয়েছে, তখন মুসলিম লীগকে পরিহার করেন তিনি৷

মোটকথা, তাঁর পুরো রাজনৈতিক জীবনের পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও সমাজ-সংস্কারের চেতনা৷ আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. গত শতকের ইসলামি রাজনীতির অঙ্গনের এক মহাবিস্ময়৷ আল্লাহ তায়ালা উম্মাহর প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের ব্যাপক আবির্ভাব ঘটান৷ আমীন৷

এ জাতীয় আরো সংবাদ

ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে এই ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটাতে হবে

নূর নিউজ

কারামুক্তির পর প্রথম বক্তব্যেই ঐক্যের ডাক দিলেন মাওলানা মামুনুল হক

নূর নিউজ

চালু হচ্ছে আরও ৬ ট্রেন

আনসারুল হক