নাজমুল হুদা মজনু
প্রতিটি মুমিনের মনের মণিকোঠায় লালিত ছাফ কথা হলো– ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়তে হবে। ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। মুসলিম বিদ্বেষী ইসরাইল ফিলিস্তিনে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ এমনকি অসহায় নারী-শিশুকে নির্বিচার হত্যা করছে। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডে হাজারো শিশুর লাশ পড়ে আছে গাজার পথে-প্রান্তরে। এই পাষণ্ডরা হাসপাতালে পর্যন্ত বোমা মেরে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে।
মা-বাবা, ঘরবাড়িহারা অশংখ্য ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি শিশুর আর্তনাদে মুমিনদের অন্তরে অনবরত রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। ঠিক সেই সময়ে নরপিশাচ ইসরাইলের অর্থমন্ত্রীর নিষ্ঠুর হুংকার– ‘গাজা-ফিলিস্তিনে খাদ্যশস্যের একটি দানাও ঢুকতে দেয়া হবে না।’ অবাক দৃষ্টিতে পৃথিবী দেখছে– মানবতা আজ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী জালিমের পদতলে দলিত। তাই বিশ্ব-মুসলিমের চিরশত্রু বর্বর ইহুদি জায়নবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে হবে। তাদের জুলুমের ভয়ে ভীত হয়ে পিছে পড়ে থাকা যাবে না। কেননা মহীয়ান গরিয়ান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআনুল কারিমে নির্দেশ দিয়েছেন– ‘কুতিবা আলাইকুমুল কিতাল’
অর্থাৎ, ‘তোমাদের ওপর যুদ্ধ ফরজ করা হয়েছে। অথচ তোমাদের কাছে তা অপছন্দনীয়। কখনো কখনো তোমরা কোনো জিনিস অপছন্দ করে থাকো অথচ তা তোমাদের জন্য ভালো। আবার কখনো কখনো তোমরা কোনো জিনিস পছন্দ করে থাকো অথচ তা তোমাদের জন্য মন্দ। বস্তুত আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’ (সূরা বাকারাহ-২১৬)
তবে একথা সত্য যে, আল্লাহর পথে যুদ্ধ করা খুবই কষ্টকর একটা উদ্যোগ; কিন্তু কষ্টকর হলেও তা অবশ্য করণীয় ফরজ। কেননা তাতে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ব্যক্তিগতভাবে, মুসলমান সমাজের জন্য, সমগ্র মানবজাতির জন্য এবং স্বয়ং সত্য ও ন্যায়ের জন্য প্রভূত কল্যাণ রয়েছে। আর প্রকৃত মুমিন মুসলিম দায়িত্বের মুখোমুখি হয়ে ঘাবড়ে যায় না। কষ্ট দেখে সে কাপুরুষের মতো পলায়নপর হয় না; সে বরং আল্লাহর সাহায্যের ওপর আশাবাদী ও আস্থাশীল হয়ে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কষ্ট ও পরিশ্রমের ওপর অবিচল থাকে। কারণ সে জানে যে, কষ্টের পর শান্তি ও কল্যাণ আসতে পারে; তাই সে কেবল আরাম আয়েশের জন্য লালায়িত হয় না। কেননা আরাম আয়েশের পেছনে অনুশোচনা ও ব্যর্থতা লুকিয়ে থাকা বিচিত্র্য নয়। প্রিয় জিনিসের পেছনে অপ্রিয় জিনিস এবং লোভনীয় জিনিসের ভেতরে ধ্বংস লুকিয়ে থাকতে পারে। যারা আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল তাদের কাজকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু সহজ করে দেন।
কুরআনুল কারিমের পাশাপাশি প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসেও যুদ্ধ- জিহাদের স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত– তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মক্কা বিজয়ের পর আর হিজরত নেই; বরং রয়েছে কেবল জিহাদ ও নিয়ত। যদি তোমাদের জিহাদের ডাক দেয়া হয় তাহলে বেরিয়ে পড়ো। (বুখারি-২৫৯২)
যুদ্ধ কার বিরুদ্ধে কখন কিভাবে করতে হবে– এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। উল্লিখিত প্রশ্নের সুস্পষ্ট উত্তর কুরআন মাজিদে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জানিয়ে দিয়েছেন।
আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে বলেন, যাদের বিরুদ্ধে (কাফেরদের পক্ষ থেকে) যুদ্ধ চালানাে হচ্ছিল, তাদেরও (এখন যুদ্ধ করার) অনুমতি দেয়া গেল, কেননা তাদের ওপর সত্যিই জুলুম করা হচ্ছিল; নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা এ (মাজলুম)-দের সাহায্য করতে সম্পূর্ণ সক্ষম, (এরা হচ্ছে কতিপয় মাজলুম মানুষ,) যাদের অন্যায়ভাবে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে– শুধু এ কারণে যে, তারা বলেছিল, আমাদের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা; যদি আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির একদলকে আরেক দল দিয়ে শায়েস্তা না করতেন তাহলে দুনিয়ার বুক থেকে (খৃষ্টান সন্ন্যাসীদের) উপাসনালয় ও গির্জাসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যেত, (ধ্বংস হয়ে যেত ইহুদিদের) এবাদাতের স্থান (মুসলমানদের)ও, যেখানে বেশি বেশি পরিমাণে আল্লাহ তায়ালার নাম নেয়া হয়। আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন যে আল্লাহ তায়ালার (দ্বীনের) সাহায্য করে, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা শক্তিমান ও পরাক্রমশালী। (আল-হাজ : ৩৯-৪০)
যুদ্ধ-জিহাদ কোনো আবেগ তাড়িত ব্যাপার নয়; এটি ইসলামের একটি বুনিয়াদি বিষয়। জিহাদের জন্য শারীরিক মানসিক আর্থিক সামর্থ্য ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তাদের মোকাবেলা করার জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি ও অশ্ব-বাহিনী প্রস্তুত করো। তা দিয়ে তোমরা ভয় দেখাবে আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদেরকে এবং এরা ছাড়া অন্যদেরকে যাদেরকে তোমরা জানো না, আল্লাহ তাদের জানেন। তোমরা যা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করো তা তোমাদেরকে পরিপূর্ণ দেয়া হবে। তোমাদের ওপর জুলুম করা হবে না। (সূরা আনফাল-৬০)
উপরোক্ত সূরার ৯ নম্বর আয়াতে কারিমায় আরো বলা হয়েছে–
‘(স্মরণ করো) যখন তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে সকাতর সাহায্য প্রার্থনা করেছিলে তখন তিনি তা মঞ্জুর করেছিলেন এবং বলেছিলেন– আমি তোমাদেরকে একের পর এক আগমনরত এক সহস্র ফিরিশতা দিয়ে সাহায্য করব।’ রাহমানুর রাহিম আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুমিনদেরকে আরো
আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে,
তোমরা হতোদ্যম হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না, তোমরা যদি সত্যিকার অর্থে ঈমানদার হও তাহলে তোমরাই বিজয়ী হবে। (সূরা আল ইমরান-১৩৯)
মনে রাখতে হবে– জুলুমবাজ কাফের ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-জিহাদ আল্লাহর হুকুম এবং আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশিত তরিকা তথা সঠিক পথ। কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যেই লুকিয়ে আছে মুমিনের জীবনের মূল সাফল্য ও কামিয়াবি।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক