ফিলিস্তিনে ঈদ: আনন্দ-বেদনার কথকতা

আগস্ট, ২০১৪। বোমা আর বারূদের গন্ধ নিয়ে ফিলিস্তিনে এসেছে কুরবানির ঈদ। বিবর্ণ, মলিন, রক্তরঙা ঈদ। বারূদের গন্ধ এবং ভয় উপেক্ষা করে আপন মাতৃভূমি ফিলিস্তিনে এবারই প্রথম ঈদ করতে এসেছেন ২৫ বছরের তরুণী বেসান আবু জুদেহ। ফিলিস্তিন তার মাতৃভূমি হলেও জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রে। কাজ করেন দুবাইয়ের একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে।

প্রথমে তাকে যেতে হয় জর্ডানের আম্মানে। সেখানে কাগজ যাচাই করে যেতে হয় ইজরাইলের সীমান্তে। এখানে কাগজ যাচাই শেষে পৌঁছান ফিলিস্তিন সীমান্তে। এত কষ্ট করে নিজের মাতৃভূমিতে করা ঈদ পরিণত হয়েছিল তার ভয়ংকর এক দুঃসহ স্মৃতিতে।

বেসান বলেন, ‘ঈদের প্রথম সকালে গাজায় ইজরাইলি হামলায় আট শিশু নিহত হয়। এ ছাড়া প্রতিদিনই মৃতের সংখ্যা বাড়ছিল। এ অবস্থায় পশ্চিম তীরের মানুষের ঈদ উদযাপন করার মতো কোনো উৎসাহ, আগ্রহ বা অবস্থা ছিল না। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের মানুষকে ইজরাইল বা জেরুজালেমে যেতে দেওয়া হয় না। তাই আমি জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদে যেতে পারিনি। অথচ, এটি মুসলমানদের জন্য অন্যতম পবিত্র একটি স্থান।’

জুন, ২০১৮। ঈদের জন্য জামা-জুতো কিনেছে ফিলিস্তিনের ১৫ বছরের কিশোর হাইতাম আল জামাল। কিন্তু ঈদের আগেই ৭ জুন ইজরাইলি সেনাদের গুলিতে নিহত হয় হাইতাম। নতুন জামা-জুতা পরা হয়নি তার। যেমন ছিল, ঠিক তেমনি রয়েছে।

ছেলের জামা-জুতা বুকে নিয়ে অবলার মতো বসে আছেন হাইতামের মা ওরুদ আল জামাল। তার চোখে নিঃসীম শূন্যতা। রয়টার্সের সাংবাদিক তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তিনি কোনো কথা বলছেন না। মৌনতা ভেঙে শুধু বললেন, ‘এটা আমার জীবনের কঠিনতম ঈদ।’

গাজার পোশাকের দোকানি ওমর আল বায়ুক। পুরো রমজান দোকান খুলে রেখেছেন। কিন্তু দোকানে ক্রেতা ছিল না কেউ। তার দুয়ারেও ঈদ এসেছে হাহাকার হয়ে। রয়টার্সের সাংবাদিককে আল বায়ুক বললেন, ‘পরিস্থিতি খুবই খারাপ। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা একেবারে দুর্বল। অন্য বছরের তুলনায় এবার বিক্রি অনেক কম।’

এমন হাহাকারেও নতুন জামা-জুতা কিনেছিল হাইতাম। মৃত্যুর কালো থাবা থেকে বাঁচতে পারেনি সে। ইজরাইলি নৃশংসতায় ঈদের আনন্দ পরিণত হয়েছে শোকে, বেদনায়।

গাজার নুসরাত শরণার্থী শিবিরে নতুন জামা-জুতা নিয়ে বসে আছে ১৫ বছরের তরুণ আবদেল রহমান নফেল। সামনে ঈদ। তার বাবা তাকে এগুলো কিনে দিয়েছেন ঈদ উদযাপনের জন্য। কিন্তু জুতা জোড়ার দিকে তাকাতেই বারবার তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠছে।

বিক্ষোভ করতে গিয়ে কদিন আগেই তার ডান পা গুলিবিদ্ধ হয়েছে ইজরাইলি সেনাদের গুলিতে। পা’টা বাঁচানো যায়নি। গুলিটা এত তীব্র এবং বিষাক্ত ছিল, গুলি খুলেও রক্ষা হয়নি। পা’টা কেটে ফেলতে হয়েছে। ঈদে সে কেবল একটি জুতা পরতে পারবে। আরেকটু জুতা পরার পা তার উড়িয়ে দিয়েছে দখলদার ইহুদিরা।

নফেল বললো, ‘জুতা জোড়া কিনেছিলাম দু পায়ে পরবো। কিন্তু এখন একটিই পরতে হবে। আরেকটি ঘরে রেখে দিবো।’

জুন, ২০১৯। ইজরাইলের আ্যাশকেলন কারাগারে বন্ধ ঘোষণা করা হয় ঈদুল ফিতর উদযাপন। কারগারটিতে বন্দী হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। অন্যান্য দিনের মতোই কেটেছে তাদের ঈদের দিন। শুধু একটি কারাগর নয়, ইজরাইলের যতটি কারাগারে বন্দী ফিলিস্তিনের অধিবাসী, সব কটি কারাগারেই ঈদ পালন একপ্রকার নিষিদ্ধই।

ফিলিস্তিনের কারাগার বিষয়ক কমিশনের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল কাদরি আবু বকর বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলেছে। অত্যাচার নির্যাতন তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এমনকি ফিলিস্তিনের মুসলিম বন্দিদেরকে তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতরও উদযাপন করতে দেয়া হয়নি।

গত ৭ জুন দেয়া এক বিবৃতিতে জানান, ‘ইজরাইলের কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দিদের ইচ্ছামাফিক অত্যাচার নির্যাতনে তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। বন্দি ও বন্দিদের পরিবার-পরিজনের সঙ্গে খারাপ আচরণ তাদের রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় ফায়েদা তোলার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিভিন্ন কারাগারে ধারাবাহিকভাবে রুটিনমাফিক ফিলিস্তিনি বন্দিদের নির্যাতন করা হচ্ছে। কারাবন্দিরা যেন স্থিরভাবে জীবনযাপন করতে না পারে সে জন্য তাদেরকে ঘন ঘন বিভিন্ন জেলে স্থানান্তর করা হচ্ছে।’

ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই ফিলিস্তিনের মুসলমানরা ঈদ উদযাপন করে আসছে। ফিলিস্তিনের গাজা ও পশ্চিমতীরের মানুষের ঈদ উদযাপন ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। জায়নবাদী ইজরাইল প্রতিষ্ঠার আগে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট ভাল ছিল। ঈদে গাজা ও পশ্চিমতীরের শিশুরা রাস্তাঘাট ও অলিগলিতে গেয়ে বেড়াত আনন্দ-সঙ্গীত। নতুন জামা-কাপড় পড়ে বেড়াতে বের হত পাড়া-মহল্লায়। ঈদের খুশি প্রকাশ করতে রাস্তায় আনন্দ শোভা-যাত্রাও বের করত। ‘মামুল’ নামক পিঠা তৈরি করা হত ঘরে ঘরে। ‘কুকি’ ও মিষ্টান্নের বাহারি আয়োজন হত সবার ঘরে। কুরবানি ঈদে সামর্থবান মুসলমানরা জবাই করত, উট, মহিষ, গরু, ছাগল, দুম্বা ও ভেড়া। ঘরে ঘরে তৈরি হত গোশতের বিভিন্ন রেসিপি।

মূলত ১৯৪৮ সালের ১৫ মে জায়নবাদী ইজরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাদের অভিধান থেকে হাসি-খুশি ও ঈদ আনন্দের মত শব্দগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তারপরও প্রতি বছর ফিলিস্তিনে ঈদ আসে। তারা ঈদের জামাতেও যোগদান করে। কেউ কেউ নতুন জামাও পরিধান করে। কিন্তু কেউ বলতে পারে না, এ পোশাকই তার কাফনের পোশাক কি না! হয়তো জীবনে এ কাপড় বদলানোর সুযোগ আসবে না!

কিন্তু ফিলিস্তিনিরা অদম্য সাহসী। তারা পরোয়া করে না মৃত্যুর। চলমান এ সংগ্রামে ‘বাঁচলে গাজি নইলে শহিদ’- প্রত্যয়ে তারা সামনে এগিয়ে চলে। বুকে অনন্ত সাহস আর গগণ-কাঁপান তাকবিরধ্বনি দিয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা ধরে। তাই তো দেখি নিরস্ত্র এক নিতান্ত কিশোরকে ঠেকাতে জায়নবাদী সন্ত্রাসীদের সতের জন সৈনিক লাগে!

এ জাতীয় আরো সংবাদ

তালেবানকে বাধ্য হয়ে স্বীকৃতি দেবে আমেরিকা

নূর নিউজ

হিজাব নিষিদ্ধই থাকছে : কর্ণাটক হাইকোর্ট

নূর নিউজ

‘ভারতে হিন্দুদের সমাবেশে মুসলমানদের হত্যার ঘোষণায় নিন্দা ও প্রতিবাদ’

নূর নিউজ