- সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ
এক.
আব্বার কাছে শৈশবেই যখন বোখারা, সমরকন্দ, কাশগড়, গ্রানাডা, কর্ডোভার ইতিহাস পড়েছি তখন আমার কোমল হৃদয়ে বেশ আশ্চর্য হতো! কীভাবে সম্ভব! পৃথিবীতে এত এত আমরা মুসলমানরা বেঁচে থাকতে আমাদের চোখের সামনে হাতছাড়া হল আমাদের পিতৃপুরুষের রক্ত-জলে নির্মিত তিলোত্তমা নগরীগুলো!! সেখানে সেসব শহর পরাজিত হয়নি, পরাজিত হয়েছিল আলেমদের চেতনা, ঈমানী স্পীট আর ইলমের গভীরতা। পরাজিত হয়েছিলেন শায়খুল মাশায়েখরা। সাথে পরাজিত হয়েছিল একটি সভ্যতার। একটি ঐতিহ্য আর ইতিহাসের। ইমাম বুখারী (রহঃ) এর জন্মস্থান বোখারার ইতিহাস পড়ে কেঁদেছি! এ ইতিহাস ইলমে হাদীসের সূতিকাগার থেকে ইসলাম বিতাড়ণের করুণ ইতিহাস! কেন কিভাবে? কাদের কারণে?! আজকের আধুনিক বোখারা ও সমরকন্দ দেখলে কি এটা ভাবা যায়! একদা এ নগরীগুলো ছিল হাদিসচর্চার সূতিকাগার!! পাড়ায় পাড়ায় ছিল ইলমে নববীর দরসগাহ। শহরজুড়ে ছিল শায়খুল মাশায়েখদের অগনিত খানকা। দরস তাদরিসের কোলাহল ত্বোলাবাদের পদচারনায় মূখরিত হত যে সৌভাগ্য নগরী। নিত্যদিন মসজিদে মসজিদে বসতো দরসুল কুরআনের মাহফিল। কলাল্লাহ আর কলার রাসূলের মুহুর্মুহু উচ্চারণে এখানকার পথ-ঘাট, বাড়ি-ঘর মুখরিত ছিল। সারা দুনিয়া থেকে দ্বীন ইসলাম শিখতে হেদায়তের পথিকরা ভীর জমাতেন সে বরকতময় শহরহুলোতে। আজকের গ্রানাডা আর কর্ডোভা দেখলে কি মনে হবে, একসময় এ নগরীগুলো ছিল ইসলামের স্বর্ণশিকড়ে। ইমলামি ইতিহাসে জ্ঞানচর্চার আতুড়ঘর! ছিল এসব নগর বন্দর। উলামাদের শান শওকত আর প্রভাব প্রতিপত্তিরর সীমাহীন এক বুনেদী যৌলুস ছিল সেখানে। এখানকার পথে পথে ঘোড়া হাকিয়ে ছুটেছিলেন ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মুজাহিদগণ। আমি আজ ইতিহাস থেকে সেখানকার আলেমদের পতনের নিমর্মসত্য কিছু কথা লিখব। যা বিগত কয়েক বছরের বাংলাদেশের আলেমদের সাথে হবহু মিল খোঁজে পাওয়া যায়। সবাই আমার সাথে একমত নাও হতে পারেন। তবে ইতিহাসকে অস্বিকার করার কোন সুযোগ নেই কারো। ইচ্ছে অনিচ্ছায় তা মানতে বাধ্য জগতের মানুষ। এটাই সত্যের বাস্তবতা। এখন এটা থেকে শিক্ষা গ্রহন করা বা না করা সেটা আপনার বিষয়। আজ বোখারা-সমরকন্দ, গ্রানাডা আর কডোর্বা কেবলি ইতিহাস। বেদনার নীল পাঠ। বোবা কান্না আর দীর্ঘশ্বাসের করোন কাহিনী। নির্মম এক বেদনার অশ্রু বিরহগাথা। সমরখন্দ -বোখারার মাদরাসা, খানকা ও মারকাজগুলোর ভগ্ন দেয়ালে আজো লেখা, সে কান্নার কাহানী। নিজেদের লোকদের হাতে নিষ্টুরতা আর পরাজয়ের ইতিহাস। ভুলের খেসারত দিতে দিতে এভাবে আমরা মাথার মুকুট হারিয়েছি দজলা, ফোরাত আর তাউসিবিয়ার রক্তাক্ত তীরে। দুই. কেন এমনটি হয়েছিল? ইতিহাসের পাতায় পাতায়, আমি বহু খোঁজেছি সে কারণ। যা পেয়েছি তা হল, বোখারা যখন জ্ঞান, বিজ্ঞান ও এলেম চর্চা এবং তাসাউফের মুসলিম মনীষাদের দাপট চলছিল। তখন অপশক্তির চোঁখ পরে সেখানে। তারা সরাসরি যুদ্ধে না এসে বেঁচে নেয় ভিন্নপথ। টার্গেট করে কিছু দুনিয়ালোভী আলেমদের। অপরদিকে শিল্প সংস্কৃতি ও দেশজাতি সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন ক্রমশ অবরোদ্ধ হতে হতে যখন সবকিছু উলামাদের হাতছাড়া হবার পথে, তখন সেখানকার উলামারা বাতিলদের চক্রান্তে নিজেরা নিজেদের মাঝে লড়াইয়ে মেতে উঠেন। দ্বীনী দাওয়াতি মিশন বাদ দিয়ে নিজেরা মেতে উঠেন ভোগ বিলাসে। আলেমরা ধর্মীয় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে পারস্পরিক চরম মতবিরোধে লিপ্ত হয় পড়েন। এ মতবিরোধ পারস্পরিক হিংসা-বিদ্ধেষে রূপ নিয়েছিল। একে অপরের উপর কুফরি ফতোয়া, বাতিল, দালাল, নাস্তিক মুরতাদ, পথভ্রষ্ট, গোমরা বলার প্রচলন বেড়ে গিয়েছিল। বিবি তালাকের ফতোয়া আর এক অপরের জানাজার নামাজ না পড়ানোর মেকী হংকারে কাটতো আলেমদের সময়। অমুক বেদাতী, তমুক এই, ফতোয়া শুরু হয়েছিল। জিকির জোড়ে না আস্তে হবে এনিয়ে চলতো লড়াই। আলেমরা একে অপরকে ঘায়েল করা নিয়ে প্রচণ্ডভাবে সোচ্চার হয়ে পড়লেন। নিজেকে একমাত্র হকের জান্ডাবাহী প্রমানে, অন্যকে বাতিল, গোমরা নির্ণয়ে ব্যস্ত জীহাদে সময় পার করতে লাগলেন। আজ বাংলাদেশে অনুরূপ কেউ কেউ কুরআন হাদীসকে তাহরিফের চরম বাড়াবাড়ি পর্যায়ে করে যাচ্ছেন, আবার তরুণরা ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে ব্যাস্থ সময় পার করছেন, কথা বলছেন অন্যদের শেখানো সুরে। একটু বিচক্ষণতার সাথে দৃষ্টি ভুলালে বুঝা যায় এদেশের তরুণ আলেমদের দুর থেকে কারা যেন পরিচালনা করছেন খুব সুক্ষ্মভাবে! আবার সত্য সঠিক কোন বিষয়ে কোন আলেম কুরআন হাদীস থেকে বললে তার উপর সদলবলে হামলে পরি ফতোয়া আর গালাগালির ফসরা নিয়ে। আমার মতের উল্টো কেউ বলতে পারবে না। ভিন্নমতকে সহ্য না করে ফ্যাসিবাদী আচরণে আজ আমাদের তরুন সমাজের করুণ হাল। সমরখন্দে তখন ছিলনা কোন বুদ্ধিভিত্তিক কাজ বা সুপরিকল্পিত দাওয়াহ র্চচা কিংবা খারাপ পরিস্তিতি থেকে উত্তরনে সীরাত ও সুন্নাহ ভিত্তিক কোন কোন র্কম প্রদ্ধতি। ফলে ক্রমশ এই বিভিষিকাময় পরিস্তিতে সাধারন মুসলমানরা আলেমদের উপর থেকে আস্থা হারাতে লাগল। কিছু আলেমরা বড়বড় শায়েখদের নাম ব্যাবহার করে বাতিলের ক্রিড়নকে পরিনত হলেন। নানান অপকর্মে জড়িয়ে পড়লেন। বাহিরের জোব্বার আবরনের নিচে চারিত্রিক অধঃপতন শুরু হয়েছিল নিলজ্জ ও নেক্কারজনকভাবে। নেতৃত্ব দেয়ার মতো আর্দশিক কোন লিডার ছিলেন না। প্রকাশ্যে গোপনে নিজেদের স্বার্থের জন্য স্থানে স্থানে আতাত শুরু হতো থাকল। যে আলেম দুদিন আগে একটি বিষয়কে হারাম বলতেন, তিনিই দুদিন পর নিজের র্স্বাথে এটিকে হালাল বলতে থাকেন। কেউ তাদের মতের উল্টো গেলেই তার জানাজা পড়া বন্ধ করে দিতেন। মসজিদে তালা মেরে দিয়ে তা নিজের দখলে রাখতে কুন্ঠিত হতেন না কেউ কেউ। মসজিদে আলেমদের হাতেই নিগৃহীত হতেন বাবা চাচার বয়েসের মুরুব্বিরা। যা ছিল ওয়ারাসাতুল আম্বিয়াদের শানের খেলাফ। আখলাকের চুড়ান্ত বির্পযয় শুরু হয়েছিল। অযাচিত হুংকার আর র্গজন ছাড়া তাদের জীবনের কোন মিশন ও ভিষন ছিলনা। বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন কেউ কেউ ইতিহাস তাই বলে। একেক করে আলেমদের নানান আচরনে কুলষিত হতে থাকল নিজেদের অহংকার আর গর্বের স্থানগুলোকে। এপরিস্থিতে সহিংসতা আর হট্টগুলের কারনে দেশ বিদেশ থেকে আলেমদের কাছে দ্বীন শিখার জন্য সাধারন মানুষের আসা বন্ধ হতে শুরু করে। আলেমরা বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে পরলেন। ‘ঘোড়ার গুস্ত খাওয়া মাকরুহ না মুবাহ’ এরকম মামুলি বিষয় নিয়ে তখন বিশাল বিশাল বাহসের অনুষ্টান চলতে লাগল। সমাধান না হয়ে সেখানে দুপক্ষে খুন খারাবী হতে থাকল। কাকে পরাজিত করে কে বিজয়ী হবে এ নিয়াই ছিলেন তারাঁ মত্ত। দেশ র্ধম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তরুনরা বিগড়ে যাচ্ছে, চারদিকে নষ্ট আর ভ্রষ্টতার সয়লাভ হচ্ছে অথচ এ নিয়ে তাদেঁর চিন্তা করার সময় ছিলনা মোটেও। ফলে ইতিহাস বলে, যে দ্বীনদ্বার মানুষটি শায়খের পা ধুয়ে দিত, অযুর পানি ঢেলে দিত পরম শ্রদ্ধা আর যতনের সাথে, সেই লোকটিই একদিন খোলা তরবারি হাতে এসে এই বুজুর্গের মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করল চরম ঘৃনা আর আক্রোশ নিয়ে। সাধারন মানুষদের হাতে, নিজেদের গোলাম প্রকৃতির লোকদের হাতেই একের পর এক নির্মমভাবে খুন হতে থাকেন বড়বড় আলেমরা। ভাবতে পারেন আওয়ামদের কাছে আলেমদের নিয়ে কি পরিমান ঘৃনার মাস্যাজ পৌছেছিল তখন। ফলাফল: বাতিল খুশি হল, দ্বীনের পরাজয় হল। তিন. জগতখ্যাত পণ্ডিত সৈয়দ আবুল হাসান আলী মিয়া নদভী রহ. একবার তাবলীগের উলামায়ে কেরামের মজমায় বলেছিলেন, ‘আপনারা যদি সাধারন মানুষের সাথে না মিশেন, তাদের মনের ভাষা, মেজাজ, সময় ও পরিস্তিতি না বুঝে কথা বলেন। তাহলে একদিন সমাজের সাথে এতোটাই দুরত্ব তৈরি হবে যে তাদেরকে আলেমদের ভাষা বুঝাতে দুভিষীর প্রযোজন হতে পারে। আপনারা যদিও ভাববেন সাধারন মানুষ আপনাদের বয়ান বুঝছে কিন্তু বাস্তবে তারা দুভাষীর উপর নির্ভর করে চলবে। দুভাষীরা আপনাদের বয়ানের যে তরজমা জনগনের সামনে পেশ করবেন তারা সেটাই গ্রহন করবে। ইতিহাস দেখুন সমরকন্দ -বোখারাতে তাই হয়েছিল। একটা সময় জনগন আর আলেমদের কথাকে গ্রহন করেনি। তাদের বিপদে পাশে এসে দাড়ায় নি”। চার. বুখারার ইতিহাস পাঠ করে জানা যায়,লেলিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় যখন কমিউনিষ্টরা ক্ষমতায় আসে সে সময় বোখারা ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র ছিল। সারা বিশ্ব থেকে ছাত্ররা সেখানে দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণের জন্য যেত। একমাত্র বোখারায় অসংখ্য এমন মাদ্রাসা ছিল, যেসব মাদ্রাসায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার পর্যন্ত ছাত্র পড়াশোনা করত। বুখারার কেন্দ্রীয় মাদরাসা এত বিশাল ছিল যে, একমাত্র সহীহ বুখারীর দারস নিত একসাথে ৪০০০০ হাজার ছাত্র বসে। আমি ভাবছি আমরা আজ সে পথে হাটছেন কি না? এই সব নগরীতে আলেম ও উলামাদের পতনের আগে যত আলামত ছিল। আজ বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতি ধর্মীয় অঙ্গনে সহ সকল সেক্টরে আলেমদের অবস্থান হুবহু সমরখন্দ, বোখারা, কাশগড়, স্পেন, বাগদাদ, গ্রানাডার পতনের পূর্ব মুহুর্তের পরিবেশ। নিজেরা লোভ লালসা, আবেগ আর জিদের হীন স্বার্থের কারনে, চারিত্রিক অধঃপতন আজ সে পথে। আজ একইভাবে অযাচিত ফতোয়া আর ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম বিষয় নিয়ে চরম বাড়াবাড়ি চলছে। দেশে মদকে আম করা হচ্ছে আর আলেমরা আছেন ইল্লাল্লাহু জিকির নিয়ে জায়েজ নাজায়েজ বির্তকে। ফলে সমাজ ও রাষ্টে আলেমদের নিয়ে কি ম্যাসেজ যাচ্ছে প্রিয় হযরাতগন আপনারা যদি একবার অন্তত ভাবতেন! আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার করুণ দশা, পরিকল্পিত দাওয়াহ ভিত্তিক সামগ্রিক কাজ নেই বললেই চলে। খুব একটি হচ্ছেনা বুদ্ধিভিত্তিক কাজ। তরুণরা বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। যারা আম উম্মতের হেদায়তের জন্য কাজ করছেন নানান অঙ্গন থেকে নানানভাবে, তাদেরকে আপন জায়গা থেকে সহযোগীতা -উৎসাহ দেয়ার পরিবর্তে গলা চিপে ধরার ও বিভিন্নভাবে কলুষিত এবং অপমান করতে আমরা মড়িয়া। অপর দিকে আলেমরা যখন আদর্শের রাজপথ আর নববী মেহনত ছেড়ে সুর ও সুরায় লিপ্ত হয়েছেন , দ্বীনের নামে দুনিয়া তলব করেছেন আর অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা, ইলম অপচয়ের খাতগুলো অর্জনে সচেষ্ট হয়েছেন, উম্মতের কসছে ইলম পৌছানোর খেয়ানত করেছেন, ইলমের সঠিক আমানত নষ্ট করেছেন, তখনই সে পরিণত হয়েছে অনাগত প্রজন্মের জন্য মর্মান্তিক ও শিক্ষণীয় দৃষ্টান্তে। ইতিহাস বারবার ফিরে এসেছে, মুসলমান যখনি অবনত হয়েছে অর্থের সামনে, ক্ষমতার সামনে এবং নারীর সামনে, ত্যাগের জীবন ছেড়ে ভোগের জীবনে মত্ত হয়েছে, অথবা লিপ্ত হয়েছে অন্ত কলহে তখনই তাদের পতন ঘটেছে। মুসলমান হচ্ছে এমন এক জাতির উপাধি, যারা ‘ফোরসানুন বিননাহার’ ও ‘রোহবানুন বিল লায়ল’। দিবসে দ্বীনের মেহনত আর রজনীর রোনাযারীই হল এই জাতির পরিচয়। পৃথিবীতে তাদের আবির্ভাব ভোগ-বিলাসের জন্য নয়; বরং একমাত্র আল্লাহর বন্দেগীর জন্য আর নিস্বার্থ মানবজাতিকে দাওয়াতে ইলাল্লাহর মাধ্যমে তার রবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া।কিন্ত হায় আমাদের করার কী ছিল আর করছি কী আজ? দয়াময়। এই খারাপ অবস্থা থেকে পানাহ চাই তোমার দরবারে। তুমি কঠিন পরিক্ষা আর বেজ্জতির থেকে দুনিয়া আখেরাতে আমাদের হেফাজত কর। আমিন।