হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আমির প্রয়াত আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে দেশের কওমি আলেমদের মধ্যে নেতৃত্ব সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
এর মধ্যে দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর প্রাণকেন্দ্র ‘উম্মুল মাদারিস’ বলে খ্যাত চট্টগ্রামের আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা পরিচালনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি শূন্যতার সৃষ্টি হয়।
সম্প্রতি হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষা পরিচালক সদ্যপ্রয়াত আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যু সেই শূন্যতা আরও বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিগত এক বছরের নানা জটিলতা ও অস্থিরতার অবসান ঘটাতে বুধবার (৮ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টায় নেতৃত্ব সংকটে থাকা হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন পদে শূন্যতা পূরণে মজলিসে শূরার বৈঠক ডাকা হয়েছে।
শূরার এ বৈঠকেই আল্লামা আহমদ শফীর উত্তরসূরি নির্ধারণ হবে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শায়খুল হাদিস ও শিক্ষা পরিচালকসহ বিভিন্ন পদে নতুন মুখ আসার কথা রয়েছে। দেশের প্রাচীন এ কওমি মাদ্রাসাটির নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর এককভাবে কাউকে মহাপরিচালক পদ না বানিয়ে তিনজনকে পরিচালনা কমিটির সদস্য করা হয়।
এই তিনজন হলেন- হাটহাজারী মাদরাসার প্রধান মুফতি মুফতি আবদুস সালাম, সহকারী পরিচালক মাওলানা শেখ আহমদ ও মাওলানা ইয়াহইয়া।
এছাড়া মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে শিক্ষা পরিচালক ও শায়খুল হাদিস হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। চলতি বছরের ১৯ আগস্ট তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ওই পদ দুটিও শূন্য হয়।
মাদ্রাসার মহাপরিচালক নির্ধারণে শূরা কমিটির বৈঠকে বসার বিষয়টি নিশ্চিত করে নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক জানান, মাদ্রাসার মহাপরিচালক কে হবেন তা নির্ধারণ করবে মজলিসে শূরার সদস্যরা। হুজুরের (আল্লামা শফী) জায়গা পূরণ হওয়ার নয়। তারপরও নিয়মতান্ত্রিকভাবেই তার সব শূন্যপদ পূরণ করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শূরার বৈঠককে কেন্দ্র করে হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক, ছাত্র ও স্থানীয় এলাকাবাসীর মধ্যে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। এর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে বিগত কয়েক দিনে সরকারের একাধিক সংস্থার পক্ষ থেকে শূরার কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে সাক্ষাতের পর বিষয়টি আরও আলোচনায় আসে।
সূত্র বলছে, গত বছর করোনায় প্রতিষ্ঠান বন্ধের সুযোগে হাটহাজারী মাদ্রাসার কিছু শিক্ষার্থী বিভিন্ন দাবি নিয়ে একটি বিদ্রোহের পরিকল্পনা করে। তাদের সঙ্গে ‘উগ্র মানহাজী’ নামে একটি গ্রুপ সক্রিয় হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তারা হাটহাজারী মাদ্রাসায় জড়ো হয়ে ‘ছাত্র বিক্ষোভ’ দেখিয়ে আল্লামা আহমদ শফীকে পদত্যাগে বাধ্য করে। এর পরদিনই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর থেকে আন্দোলনকারী ছাত্রদের একটি পক্ষ মুফতি আব্দুস সালামকে মহাপরিচালক করার পক্ষে। কারন শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি সেভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননা বলে জানা গেছে। এ সুযোগে গত এক বছর ধরেই মাদ্রাসার বিভিন্ন বিষয়ে ‘বিক্ষোভকারী’ সেই ছাত্ররা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
এমনকি আসন্ন শূরা বৈঠকে ‘নতুন মহাপরিচালক’ নিয়োগ না দিয়ে পরিচালনা প্যানেল তৈরি করতে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনও করেছে তারা।
মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টদের মতে, হেফাজতের মতো হাটহাজারী মাদ্রাসাও নিয়ন্ত্রণে রাখার একটি চেষ্টা হতে পারে। হাটহাজারী মাদ্রাসাকে সরকারের প্রভাব বলয়ে রাখার কারণ হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটি ‘উম্মুল মাদারিস’ হিসেবে পরিচিত। সারা দেশের মাদ্রাসাকে এখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। এক্ষেত্রে শূরা সদস্য হেফাজত মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন।
মূলত আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর থেকে নুরুল ইসলাম হেফাজত ও হাটহাজারী মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। ২০১৩ ও এর পরবর্তী সময়ে হেফাজতের মূল কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট না থাকলেও আল্লামা শফীর ঘনিষ্ঠতার সুবাদে কওমি অঙ্গনে প্রভাব বিস্তার করেন তিনি।
মঙ্গলবার আল্লামা শফী ও বাবুনগরীর পর চট্টগ্রামের নাজিরহাট বড় মাদ্রাসার নতুন মোতাওয়াল্লির পদটিও নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন তিনি। আল্লামা শফীর ব্যক্তিগত ক্ষমতায় নুরুল ইসলামকে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের সহ-সভাপতি করা হয়েছিল। যদিও আল্লামা শফীর শেষ ও মৃত্যুপরবর্তী সময়ে শফীবিরোধী শিবিরের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।
সূত্রে জানা গেছে, মজলিসে শূরা ও মহাপরিচালক নিয়োগ নিয়ে ছাত্রদের পক্ষ থেকে নীরবে আবেদন করা হয়েছে। এই আবেদনে তারা শূরা কমিটি পুনর্গঠনের প্রস্তাব করেন। আবেদনে সারা দেশের প্রত্যেক জেলার আলেম ও বড় বড় মাদ্রাসার মুহতামিমদের অন্তর্ভুক্ত করে শূরা কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ করা হয়।
মাদ্রাসার একাধিক শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শূরা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনজনের বর্তমান প্যানেল থেকে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামীকে ‘মহাপরিচালক’ করা হবে বলে জোরেশোরে আলোচনা চলছে। পাশাপাশি অন্য দুই পরিচালকের মাওলানা শেখ আহমদকে প্রধান শায়খুল হাদিস এবং মাওলানা ইয়াহইয়াকে সহাকারী পরিচালক করা হতে পারে।
তাছাড়া বর্তমান সহকারী শিক্ষা সচিব হাফেজ মাওলানা শোয়াইব জমিরীকে শিক্ষা সচিব, জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মাওলানা আহমদ দিদার কাসেমীকে শায়খুল হাদিস, জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মাওলানা মুফতি জসিম উদ্দিনকে মাদ্রাসার প্রধান হোস্টেল সুপার এবং মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরীকে সহকারী হোস্টেল সুপার পদে রাখা হবে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে শূরা কমিটির সদস্য নাজিরহাট বড় মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা হাবিবুর রহমান কাসেমী বলেন, আগামী বুধবার শূরা কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে আলোচনার মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে মহাপরিচালক নির্ধারণ ও অন্যান্য শূন্যপদ পূরণে বিষয় নিয়ে।
জানতে চাইলে শূরার প্যানেল সদস্য ও হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সদস্য মাওলানা ইয়াহইয়া এবং মাওলানা শেখ আহমদ বলেন, মজলিসে শূরার বৈঠকেই মহাপরিচালক ঠিক করা হবে। আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর প্রায় এক বছর যাবৎ তিনজনের (মজলিসে এদায়ি) পরিচালক কমিটি মাদ্রাসা পরিচালনা করছেন। শূরার মিটিংয়ে হাটহাজারী মাদ্রাসার একক নেতৃত্ব নির্ধারণ করে একজনকে মহাপরিচালকের স্থায়ী দায়িত্ব দেওয়া হবে। এছাড়া আল্লামা বাবুনগরীর মৃত্যুর কারণে সদ্য দুইটি শূন্য পদও পূরণ করা হবে।
এদিকে শূরা বৈঠককে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলার রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন বিষয়টির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে হাটাহাজরী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, মাদ্রাসার শূরা বৈঠকের কথা শুনেছি। এটি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
প্রসঙ্গত, উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাটহাজারী মাদ্রাসা। প্রায় ১২০ বছর ধরে দেওবন্দের মূলনীতির ওপর ভিত্তিতে পরিচালিত হয়ে আসা বন্দরনগরী চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত দেশের মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে এটি সর্বপ্রাচীন ও বৃহত্তম কওমি মাদ্রাসা।