বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) আশঙ্কা করছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই বিষণ্নতা নামক মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধি বৈশ্বিক বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। গবেষকরাও সতর্ক করে বলছেন, ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা খুবই অপ্রস্তুত।
ফরিদের (ছদ্মনাম) বয়স ৩০ বছর। পেশায় তিনি একজন ডিজিটাল মার্কেটার। ফ্রিল্যান্স কাজ করার সুবাদে ঘরে বসেই তার সব কাজ করতে হয়। একা থাকতে থাকতে তার মধ্যে বিষণ্নতা ভর করেছে। কাজেও যেন তার মন নেই। কিন্তু তার এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না পরিবারের কেউ। আর্থিক সংগতি থাকার পরও তিনি কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিচ্ছেন না। বাকিরা কী ভাববে, সেই নিয়েই তার চিন্তা। আসলে এই সমস্যা শুধু ফরিদের একার নয়।
বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল সায়েন্স অ্যালার্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিষণ্নতা এখন বৈশ্বিক অক্ষমতা সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি কমার কোনো লক্ষণই নেই, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে।
যদিও বিষণ্নতার ক্ষেত্রে এখন বেশ কিছু ভালো ওষুধ রয়েছে। মনোচিকিৎসকরাও এই সমস্যার বিষয়ে ওয়াকিবহাল। তার পরও দুঃশ্চিন্তা রয়েই গেছে।
অনেকেই ধারণা করে থাকতে পারেন, উন্নয়নশীল দেশের বাসিন্দা হওয়ায় হয়তো ফরিদের বিষণ্নতার সমস্যাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না তার পরিবার কিংবা কাছের মানুষজন। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বিষণ্নতায় ভুগে চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছে উন্নত দেশের মানুষও।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উন্নত দেশগুলোয় বিষণ্নতায় আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে মাত্র ২৩ শতাংশের ভাগ্যেই ন্যূনতম চিকিৎসা জোটে। আর নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় এ হার মাত্র ৩ শতাংশ। ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৮৪টি দেশের ১৪৯টি গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এই বিশ্লেষণটি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারার দেশগুলো থেকে প্রাপ্ত উপাত্ততে কিছুটা ঘাটতি থাকলেও সামগ্রিক যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা ভয়াবহ।
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এলিজ ফেরারি বলেছেন, ‘বিষণ্নতা থেকে তৈরি হওয়া মনোরোগগুলোর ক্ষেত্রে চিকিৎসাব্যবস্থায় পুরো বিশ্বেই ঘাটতি রয়েছে।‘
এর প্রধান কারণ এ-সংক্রান্ত গবেষণা ও চিকিৎসা ব্যয়ে অর্থ সংস্থান পর্যাপ্ত হয়।
আর এটি শুধু অনুন্নত কিংবা মধ্যম আয়ের দেশগুলোতেই নয়, মানসিক স্বাস্থ্যে অর্থায়নের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে বিশ্বব্যাপী। ২০১৯ সালে বিষণ্নতা ও অন্যান্য মানসিক রোগের মতো ‘অসংক্রামক’ রোগের জন্য স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মোট অর্থের ২ শতাংশেরও কম বরাদ্দ ছিল।
বিষণ্নতার কারণে মানুষের নিদ্রাহীনতা, খাবারের অরুচিসহ অন্যান্য মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা হতে পারে। এমনকি কাজের প্রতি অনীহা, মনোযোগের অভাব তার অর্থনৈতিক জীবনেও প্রভাব ফেলতে পারে। সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক জীবনে এর ব্যাপক প্রভাব থাকলেও চিকিৎসাক্ষেত্রে এ সমস্যাকে খুবই কম গুরুত্ব দেয়া হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) আশঙ্কা করছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই বিষণ্নতা নামক মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধি বৈশ্বিক বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। গবেষকরাও সতর্ক করে বলছেন, ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা খুবই অপ্রস্তুত।
যদিও সব ধরনের বিষণ্নতা চিকিৎসাযোগ্য নয়, তার পরও আজ অবধি যতগুলো মানসিক রোগের সঙ্গে মানুষ পরিচিত হয়েছে, তার মধ্যে এটিই সবচেয়ে নিরাময়যোগ্য। প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষ ওষুধ সেবন, মনোচিকিৎসায় ও থেরাপির মাধ্যমে ভালো হয়ে যায়।
করোনা মহামারির কারণে পুরো বিশ্বেই বিষণ্নতায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি এ রোগ মোকাবিলায় সতর্কতা ও গুরুত্বও সমানভাবে প্রয়োজন।