মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া
ভারতীয় উপমহাদেশ একসময় ছিল সমুদ্র ও পর্বত দ্বারা পরিবেষ্টিত একটি বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড, যেখানে বহির্বিশ্বের সংস্পর্শ কম ছিল। মুসলমানরা যখন এই অঞ্চলে পদার্পণ করল, তারা পর্তুগিজ বা ফিরিঙ্গিদের মতো শুধু সম্পদের অপার খাজানা লুট করার উদ্দেশ্যে আসেনি; বরং এই মাটি, এর বৃক্ষ, বাতাস—সবকিছুই তাদের নিজেদের মনে হয়েছিল। তারা তাদের সাধ্যের সর্বোচ্চ প্রয়াস দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশকে শিক্ষা, সভ্যতা এবং কালচারের শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। মুসলিম শাসকদের উদারতা এবং বিদ্যোৎসাহের ফলে এই ভূখণ্ডের বহু জাতি ও ধর্মীয় সম্প্রদায় একত্রিত হয়ে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে তোলে। তারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের অন্ত্যজ ও দলিতদেরকেও শিক্ষা এবং ক্ষমতার আলো দান করেছে।
আজও মুসলমানরা এই মাটিকে তাদের রক্ত দিয়ে ভালোবাসে, দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে প্রায়ই তাদের রক্ত ঝরাতে হয়। তবু বর্তমানে তারা এই ভূখণ্ডে সবচেয়ে অনিরাপদ। শতাব্দী ধরে সৃষ্ট তাদের বিপুল সম্পত্তি আজ উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আত্মসাতের আশঙ্কায় রয়েছে।
ওয়াকফ হলো একটি ধর্মীয় ও দাতব্য ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে একজন মুসলিম তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ধর্মীয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজসেবামূলক কাজে চিরস্থায়ীভাবে উৎসর্গ করে দেন। এই দান মোতাওয়াল্লীর তত্ত্বাবধানে সাধারণত মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র বা অন্যান্য ধর্মীয় ও সমাজসেবামূলক কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়। ওয়াকফ সম্পত্তি কখনো বিক্রি বা হস্তান্তর করা যায় না, এবং এটি শুধুমাত্র সেই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, যার জন্য এটি দান করা হয়েছিল। এখানে রাষ্ট্র বা সরকারের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। ওয়াকফকারীর ইচ্ছানুযায়ী মোতাওয়াল্লীই এর রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবহার, এ থেকে প্রাপ্ত আয়ের যথাযথ ব্যয়নির্বাহ করে থাকেন। এই ওয়াকফ সম্পত্তি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মাদরাসা, মসজিদ, খানকা, এতিমখানা এবং দরিদ্রদের আশ্রয়ের স্থান হয়ে উঠেছে। মুসলিম সমাজে ওয়াকফ শুধুমাত্র একটি জমি নয়, বরং এটি একটি পবিত্র আমানত
কিন্তু আজ ভারতে এই পবিত্র ওয়াকফ সম্পত্তি এক বড় সংকটের সম্মুখীন। সম্প্রতি ভারতের সংসদে পাস হওয়া ‘ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল ২০২৫’ মুসলিম সমাজের জন্য এক কালো মেঘের মতো। এই বিলের মাধ্যমে সরকার ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছে, এবং সরকারের সুবিধার জন্য ওয়াকফ সম্পত্তিকে ‘বিতর্কিত’ ঘোষণা করে অধিগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিজেপি সরকারের এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণরূপে অসাংবিধানিক, সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক এবং মুসলমানদের মানবাধিকারের উপর গুরুতর আঘাত। শত শত কোটি ডলার মূল্যের যাবতীয় ওয়াকফ সম্পত্তি দখলের প্রাথমিক ধাপ।
ভারতের সংবিধানের ১৪, ২৯, ৩০ অনুচ্ছেদ স্পষ্টভাবে বলে— দেশের সকল নাগরিক সমান অধিকারের অধিকারী। ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদ বলে, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের অধিকার রয়েছে।
কিন্তু বিজেপি সরকার সংবিধান রচয়িতা বাবাসাহেব আম্বেদকরের সেই সংবিধান প্রতিদিন পদদলিত করছে। এতটাই ঘৃণা মুসলমানদের প্রতি যে, সংসদে দাঁড়িয়ে সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত মিথ্যা বলছে এবং পুরো ভারতব্যাপী ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী মানসিকতা তৈরি করছে। বিজেপি গোটা দেশে ‘ওয়াক্ফ সম্পত্তি’-সম্পর্কে অসত্য তথ্য ছড়াচ্ছে।
ওয়াক্ফ ট্রাইব্যুনালকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যেন এটা কোনো ধর্মীয় আদালত! অথচ বাস্তবতা হলো— ওয়াক্ফ ট্রাইব্যুনাল একটি সরকার-নিয়ন্ত্রিত বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান, যার বিচারক নিয়োগ করে সরকারই।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে বলেছে, ‘ওয়াক্ফ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে কেউ আদালতে যেতে পারে না।’ অথচ বাস্তবতা হলো— ১৯৯৫ সালের ওয়াক্ফ আইনের ৮৩(৯) ধারা অনুযায়ী, হাইকোর্ট ট্রাইব্যুনালের রায় পুনর্বিবেচনা করতে এবং প্রয়োজনে তা পরিবর্তন করতেও পারে। এমনকি ওয়াক্ফ বোর্ডও তার নিজের জমির জন্য বিভিন্ন আদালতে মামলা চালাচ্ছে।
১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার যখন কলকাতার পরিবর্তে দিল্লিকে রাজধানী করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন ‘রাইসিনা হিলস’ এর চারপাশে বহু মুসলিমদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ব্রিটিশরা সেই এলাকায় লুটিয়েন প্ল্যান অনুযায়ী রাজধানী গড়ে তোলে।
কিন্তু সেই সময় মুসলমানরা তাদের মসজিদ ও ধর্মীয় স্থান রক্ষার জন্য ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ফলে একটি সমঝোতা হয়, যাতে ধর্মীয় স্থান ও ধর্মীয় সম্পত্তি স্পর্শ করা হবে না। এরপর ১৯১৩ সালে মুসলিমদের ধর্মীয় সম্পত্তি রক্ষার জন্য ‘ওয়াক্ফ ভ্যালিডেশন অ্যাক্ট’ পাস হয়। তারপর নতুন করে শহর গড়ে ওঠে— যাকে বলা হয় ‘লুটিয়েন জোন’। লুটিয়েন জোনে আজও ১২৫টি মসজিদ রয়েছে, যেগুলো শত বছরের পুরোনো এবং মুসলমানরা সেখানে এখনো নামাজ পড়ে।
বিজেপি সরকার বলছে, এই আইন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনবে। তারা বিলের নাম দিয়েছে ‘উম্মিদ’ তথা ‘মুসলমানদের আশা’। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, যেই সরকার একের পর এক মুসলিমবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে আসছে— গো-মাংসের অজুহাতে মুসলমানদের পিটিয়ে মারছে, বহু ঐতিহাসিক মসজিদ তারা ভেঙে ফেলছে এবং বাবরি মসজিদের জমিতে মন্দির নির্মাণ করছে, সেই সরকার কি সত্যিই মুসলমানদের কল্যাণ চায়? বিজেপি সরকারের মুসলিমবিদ্বেষ কোনো নতুন বিষয় নয়; সিএএ-এনআরসি, হিজাব বিতর্ক, নামাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা— এই সবই তাদের পরিকল্পনার অংশ। অথচ সড়কে, পথে-গলিতে হিন্দু ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই; এটাকে কোনো সমস্যা মনে করা হয় না। এই বিল সেই ষড়যন্ত্রের একটি ভয়ংকর ধাপ।
লোকসভায় ভোটাভুটির সময় বিলটির পক্ষে যেখানে ২৮৮টি ভোট পড়েছে, সেখানে বিপক্ষেও কিন্তু ২৩২টি ভোট পড়েছে, সুতরাং পার্লামেন্টারিয়ানদের একটা বড় অংশই বিলটির তীব্র বিরোধিতা করেছেন। স্পষ্টই বুঝে আসে, বিভিন্ন বিরোধী দলের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও এই হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ওয়াকফ বিলটি জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে।
কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরের ওয়াকফ বোর্ডগুলোতে গরিষ্ঠ সংখ্যক সদস্য যাতে অমুসলিম হতে পারে, সেই পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে এই বিল। এ বিলের মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মীয় স্থাপনায় অমুসলিমদের দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
হিন্দু বা জৈন এনডাওমেন্ট বোর্ডে অথবা শিখদের গুরুদোয়ারা প্রবন্ধক কমিটিতে কিন্তু বিজেপি এই জিনিস কার্যকর করতে পারবে না। গোটা পদক্ষেপটা মূলত চরম অসাংবিধানিক ও মুসলিমবিরোধী।
১৯৪৭ সালে দিল্লির ঐতিহাসিক জামে মসজিদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ভারতরত্ন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন— ‘মুসলমান ভাইয়েরা, তোমরা কোথায় যাচ্ছ? এটাই তোমাদের দেশ। এখানেই রয়েছে তোমাদের পূর্বপুরুষদের কবর।’ সেদিন মাওলানা আজাদের এই আহ্বানে অনেকেই তাদের মাথার বোঝা নামিয়ে রেখেছিল।
আজ বিজেপির পাসকৃত এই বিল মুসলমানদের কাছে প্রমাণ চাইবে সেই জামে মসজিদের সিঁড়িগুলোর। এমনকি হয়তো মাওলানা আজাদকেও তাঁর কবর থেকে উঠে আবার বলতে হবে, ‘এই কবর আমার, এটা কোনো সরকারের সম্পত্তি নয়।’ দিল্লিতে শুয়ে থাকা ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলি আহমদকেও হয়তো তাঁর কবর থেকে বলতে হবে, ‘এই কবর আমার, এটা সরকারের সম্পত্তি নয়।’
মুসলমানরা ভারতের জন্য জীবন দিয়েছেন। হাজার হাজার মুসলমান এই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন। তবু আজ তাদের প্রমাণ করতে হচ্ছে— তারা ভারতের নাগরিক।তাদের কবর, তাদের মসজিদ, তাদের মাদরাসা—সবকিছুর জন্য প্রমাণ দিতে হচ্ছে। তাদের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। বিজেপি সরকার ভুলে গেছে যে— এই দেশ গড়ে উঠেছে সবার সম্মিলিত রক্তে।
ওয়াকফ বোর্ডের আত্মনিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিয়ে সরকার মুসলিম সমাজের দাতব্য কাঠামো ধ্বংস করতে চায়। এতিম শিশুর মাথার ছাদ, দরিদ্র শিক্ষার্থীর শিক্ষার আশ্রয়, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা— অনেকটা এই ওয়াকফ সম্পত্তির ওপর নির্ভরশীল। যদি এই সম্পত্তি সরকারি দখলে চলে যায়, তাহলে মাদরাসার শ্রেণীকক্ষগুলো হয়তো হয়ে যাবে হোটেল, মসজিদের উঠোনে গজিয়ে উঠবে সুপারমার্কেট, মুসলমানদের শতাব্দী-প্রাচীন কবরস্থানগুলো ধুলোয় মিশে যাবে।
এই আইন পাস করার মাধ্যমে মুসলমানদের শুধু সম্পত্তি নয়, তাদের আত্মসম্মান, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাও আক্রান্ত হচ্ছে। বিজেপি সরকারের এই পরিকল্পনা মূলত কোটি কোটি ভারতীয় মুসলমানদেরকে অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও শিক্ষাগতভাবে পঙ্গু করে ফেলার একটি অপকৌশল।
লেখক : প্রিন্সিপাল, জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ মিরপুর-১, ঢাকা