মহানবী সা.-কে যেভাবে স্বাগত জানিয়েছিলেন মদিনাবাসী

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতের বিষয়টি আগে থেকেই জেনেছিলেন মদিনার আনসার সাহাবিগণ। মহানবী সা. মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার পর থেকে মদিনাবাসী সাহাবিরা প্রতিদিন ফজরের পর শহরের প্রান্তে গিয়ে আল্লাহর রাসূলের জন্য অপেক্ষা করতেন। রৌদ্রতাপ প্রখর ও তীব্র না হওয়া পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করতেই থাকতেন। তাপপ্রবাহ সহ্যের বাইরে চলে গেলে সবাই নিজ নিজ ঘরে ও কাজে ফিরে যেতেন। নবীজির হিজরতের সময়কালটি ছিল গ্রীষ্ম মৌসুমে। তাই এ সময় রোদের তীব্রতা ছিল প্রচণ্ড।

রাসূল সা. যেদিন হিজরতের সফর শেষে মদিনা উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়েছিলেন সেদিন অন্যান্য দিনের মতো অপেক্ষা শেষে আনসার সাহাবিদের সবাই যার যার ঘর ও কাজে ফিরে গিয়েছিলেন। এ সময় একজন ইহুদি রাসূল সা.-কে সবার আগে দেখতে পেয়েছিল। সে প্রতিদিন আনসার সাহাবিদের নবীজির জন্য অপেক্ষা করতে দেখতো। তাই আল্লাহর রাসূলকে দেখতে পেয়ে সে সবাইকে নবীজির আগমনী বার্তা সম্পর্কে জানালো।

সাহাবিরা রাসূল সা.-এর আগমনী বার্তা পেয়েই নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। তারা বের হয়ে দেখতে পেলেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি খেজুর গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছেন, সঙ্গে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু রাসূল সা.-এর সমবয়সী ছিলেন। আনসার সাহাবিদের অধিকাংশই ইতোপূর্বে আল্লাহর রাসূল সা.-কে দেখেননি। আগ্রহের আতিশায্যে তারা দুজনকেই ঘিরে ধরলেন এবং অনেকে আল্লাহর রাসূল মনে করে আবু বকর রা.-কে সালাম দিতে শুরু করলেন।

আবু বকর রা. বিষয়টি অনুভব করতে পারলেন যে, অনেকেই তাকে ও আল্লাহর রাসূল সা.-কে চিনতে ভুল করছেন। তাই তিনি তাদের বিভ্রান্তি দূর করতে রাসূল সা.-এর মাথার ওপর একটি চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। যাতে আল্লাহর রাসূল সা. গরম থেকে স্বস্তি পান এবং মদিনাবাসীর ভুল ভাঙে ও তারা সহজেই রাসূল সা.-কে চিনতে পারেন।

আবু বকর রা. এই পদ্ধতি অবলম্বনের ফলে সবার ভুল ভেঙে গেল। এবার তারা আবু বকর রা. ও আল্লাহর রাসূল সা.-এর মাঝে পার্থক্য বুঝতে পারেন।

আল্লাহর রাসূলকে স্বাগত জানানোর এই কাফেলায় অংশ নিয়েছিলেন প্রায় ৫০০ আনসার সাহাবি। তারা অত্যন্ত সম্ভ্রম ও সৌজন্যতার সঙ্গে রাসূল সা.-কে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন—

হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আগমন করুন। এখানে আপনি সবকিছু থেকে নিরাপদ। আপনি যা বলবেন তাই শোনা হবে এবং মানা হবে।

রাসূল সা. সফরসঙ্গীকে নিয়ে এই কাফেলার একেবারে সম্মুখে থেকে রওয়ানা হলেন। রাসূল সা.-কে স্বাগত জানাতে পুরো মদিনা যেন ভেঙে পড়লো। সবাই তাকে খোশআমদেদ জানাতে উদগ্রীব। নারীরা দালানকোঠার ছাদে উঠে এই কাফেলা দেখছিলেন এবং একে-অপরকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, এর মধ্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে?

মহানবী সা.-এর হিজরতের সময় আনাস রা. শিশু বয়সের ছিলেন। নবীজির আগমনকে কেন্দ্র করে মদিনাবাসীর এই উচ্ছ্বাস সম্পর্কে তিনি বলেন, যেদিন রাসূল সা. মদিনায় আগমন করেন আমি সেদিন উপস্থিত ছিলাম। আমি এর চাইতে সুন্দর ও আলোকোজ্জ্বল দিন আর কখনো দেখিনি।এরপর আমি আর কখনো মদিনায় এমন দৃশ্য দেখিনি। ( মুসনাদে আহমাদ, ইবনে কাসির, ২/২৬৯)

নবীজিকে স্বাগত জানাতে মদিনার পথে-ঘাট, চলাচলের রাস্তা, বাড়ির ছাদ, জানালা সব জায়গায় উৎসুক জনতার ভিড় ছিল। সেদিন, বৃদ্ধ, যুবক, তরুণ, কিশোর, মনিব-গোলাম সবাই বলে উঠেছিলেন, আল্লাহু আকবার, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসেছেন।  আল্লাহু আকবার মুহাম্মদ এসেছেন, আল্লাহু আকবার আল্লাহর রাসূল আগমন করেছেন।

হজরত বারা ইবনে আজিব রা. তখন অল্প বয়স্ক শিশু ছিলেন। তিনি বলেন,  আমি রাসূল সা.-এর আগমনে মদিনাবাসীকে যেভাবে খুশি হতে দেখেছিলাম, অন্য কিছুতে তাদের এভাবে খুশি হতে দেখিনি। সেদিন দাস-দাসিরাও আনন্দের আতিশয্যে এই বলে চিৎকার করছিল যে, রাসূলুল্লাহ এসেছেন, আল্লাহর রাসূর এসেছেন।

মদিনার আনসারগণ অল্লাহর রাসূলের আগমনে তাকবির ধ্বনি দিচ্ছিলেন। তাদের দেখে মনে হয়েছিল তাদের জীবনে এর থেকে আনন্দের মুহুর্ত আর কখনো আসেনি। মদিনার শিশুরা সেদিন হেলেদুলে এই কবিতাটি আবৃত্তি করেছিল—

طَلَعَ البَدْرُ عَلَيْنَا ** مِنَ ثَنِيَّاتِ الوَدَاع

وَجَبَ الشُّكْرُ عَلَيْنَا ** مَا دَعَى لِلَّهِ دَاع

أَيُّهَا المَبْعُوثُ فِينَا ** جِئْتَ بِالأَمْرِ المُطَاع

جِئْتَ شَرَّفْتَ المَدِينَة ** مَرْحبَاً يَا خَيْرَ دَاع

উচ্চারণ : 

তালা আলবাদরু আলাইনা, মিন ছানি’য়া তিল –ওয়া’দা
ওজাবাশ শুক’রু আলাইনা, মা দা আ লিল্লাহি দা
আইয়্যুহাল মাব উ’ছু ফিনা, জি’তা বি’ল-আম্রিল -মু’তা
জি’তা শার’রাফ তা’ল-মাদিনা, মারহাবান ইয়া খাইরা দা

তরজমা : 

পূর্ণিমার চাঁদ (বিশ্বনবী সা:) আমাদের ওপর উদিত হয়েছে ওয়া’দা উপত্যকা থেকে।
এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য, যতদিন আল্লাহকে ডাকার মত কেউ থাকবে।

ওহ, আমাদের পথ প্রর্দশক আজকে আমাদের মধ্যে যিনি উপদেশ নিয়ে এসেছেন, যার প্রতি আমাদের কর্ণপাত করতে হবে।

আপনি এই শহরের জন্য মর্যাদা বয়ে নিয়ে এসেছেন স্বাগতম আপনাকে, যিনি আমাদের সঠিক পথ দেখাবেন।

(নবীয়ে রহমত সা., সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী, ২১১)

এ জাতীয় আরো সংবাদ

বৃষ্টির সময়ের ৬টি সুন্নাহ

নূর নিউজ

ওয়াক্ত ছুটে গেলে কাজা নামাজ আদায়ের বিধান

নূর নিউজ

কিয়ামতের দিন অবিশ্বাসীরা যে আফসোস করবে

নূর নিউজ