চট্টগ্রাম মহানগরীর শাহ আমানত সেতুসংলগ্ন ফুটপাতে এক বয়োবৃদ্ধ নারী কিছুক্ষণ পরপর কেঁদে উঠছিলেন আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছিলেন। সেখানে বাঁশখালীর গাড়ি ধরার জন্য অপেক্ষা করছিলেন মাওলানা গোলামুর রহমান রাব্বানী। কিছুক্ষণ লক্ষ করার পর এগিয়ে গিয়ে তার বাড়ি কোথায় জানতে চান। প্রত্যুত্তরে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বৃদ্ধা গালাগাল করে ওঠেন, ‘কী জন্য জিগাস, ভাত দিবি?’
এ কথা শুনে পাশের হোটেল থেকে ভাত নিয়ে এসে খেতে দিলেন মাওলানা। কিন্তু বৃদ্ধা ভাতের প্লেটই ধরতে পারেন না ঠিকমতো। শরীরের একপাশ অবশ তার। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। বাড়ি আর যাওয়া হবে না বোধহয়! পরম ধৈর্য নিয়ে ফুটপাতে বসে পড়লেন মাওলানা, হাত দিয়ে সস্নেহে খাইয়ে দিতে লাগলেন বৃদ্ধাকে। খাবার পেয়ে কথায় ও আচরণে পরিবর্তন এল বৃদ্ধার। জানালেন তার সন্তানরাই তাকে এখানে রেখে গেছে। মাওলানা ওই মাকে নিয়ে যান তার বাসায়। এভাবে একে একে মাওলানার বাসা হয়ে উঠেছে ১১ জন ঠিকানাবিহীন, ছিন্নমূল মায়ের নতুন ঠিকানা। চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়ার হাটখোলা এলাকার গোলামুর রহমান রাব্বানীর বাসাটি এখন সবাই ‘মাওলানার বৃদ্ধাশ্রম’ নামে চেনে।
দেড় বছর আগে, নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায়, জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যেতে থাকা সত্তরোর্ধ্ব ‘সুমির মা’ (ওই নারীকে এই নামেই স্থানীয়রা জানে) নামে এক বয়োবৃদ্ধ নারীকে উদ্ধারের মাধ্যমে জড়িয়ে যান এই কাজে। নিরাশ্রয় সুমির মা মাওলানাকে একটু ঘুমানোর জায়গা করে দিতে বলেন। তখন তিনি তাকে নিয়ে যান নগরীর বাকলিয়ার বাস্তুহারা এলাকায়। সেখানে একটি ঝুপড়ি ঘরে রাখা হয় তাকে। এরপর এই ঝুপড়ি ঘরেই ঠাঁই মেলে একে একে সুমি আকতার (কক্সবাজার), আলিয়া বেগম (নোয়াখালী, লক্ষ্মিপুর), মিনু আকতার, মাজেদা বেগম, নুর নাহান বেগম, (পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম), জোৎনা আরা বেগম, লায়লা বেগম, ছেনুয়ারা বেগম (কতুবদিয়া) জুবাইদা বেগম, (চকরিয়া), কুলছুমা বেগম, রোকেয়া বেগম নামে পরিচয়হীন অসহায় মায়েদের। স্থান সংকট হওয়ায় সম্প্রতি হাটখোলা এলাকায় ১৫ হাজার টাকায় ভাড়া বাসায় উঠেছেন।
মাওলানা গোলামুর রহমান রাব্বানী বলেন, ‘এখানে যারা আছেন, তাদের সবাইকে সড়ক কিংবা ফুটপাত থেকে নিয়ে এসেছি। কারও মাধ্যমে এমন অসহায় মায়ের খবর পেলেই আমাদের টিম গিয়ে তাকে নিয়ে আসে। ভাড়া বাসা, নতুন করে কাউকে উদ্ধার করতে গেলে দুবার চিন্তা করতে হয়।’ ব্যয়ভার কীভাবে নির্বাহ করছেন এই প্রশ্নের জবাবে মাওলানা জানান, ‘এক আত্মীয় একটা আইফোন উপহার দিয়েছিল, ভাড়া বাসায় ওঠার সময় ওটা বিক্রি করে দিই। মাদ্রাসার চাকরির বেতন বাবদ ৮ হাজার টাকা পাই, এভাবে চালিয়ে নিচ্ছিলাম। পরে উপায়ন্তর না দেখে মসজিদে নামাজ পড়ানো শেষে রাত ৮টার পর দানবাক্স হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ি। পরবর্তী সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এটা নিয়ে অনেকে পোস্ট করলে অনেকে খবরাখবর নেয়। একজন প্রবাসী ভাই কাপড় ধোয়ার জন্য একটি ওয়াশিং মেশিন কিনে দেন। এ মাসে কিছু সনাতন ধর্মাবলম্বী ভাই মাসের খাবারের ব্যবস্থা করছেন। অনেকে অল্পস্বল্প সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, চলে যাচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ।’
পাশাপাশি চিকিৎসাসেবা ও নানা পরামর্শ দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন ডা. আমজাদ হোসেন। নগরীর কয়েকটি হাসপাতালে এ মায়েদের চিকিৎসায় ভূমিকা রাখছেন তিনি।
ডা. আমজাদ হোসেন বলেন, ‘গত তিন মাস ধরে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি। মাওলানা রাব্বানির এই মহৎ কাজের অংশীদার হতে পেরে নিজেরও ভালো লাগছে।’
এখানে বৃদ্ধ মায়েদের দেখভাল করা সালেহা আক্তার বলেন, ‘অনেকে কানে ভালোমতো শুনতে পায় না, আবার অনেকে ভালোমতো দেখতে পায় না। মানসিকভাবে অনেকে বিপর্যস্ত। অসংলগ্ন কথায় বোঝা যায় একসময় তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন কিছু না কিছু ছিল, সময়ের ব্যবধানে ভাগ্যের ফেরে আজ তারা ঠিকানাবিহীন। স্বামী-সন্তানের নাম ধরে বিলাপ করে ওঠেন। তাদের জন্য মায়ায় পড়ে গেছে।’
গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ, বাকলিয়া ইউনিটের একজন সদস্য স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী তরুণ মো. ইরহান জানান, ‘আমরা রাব্বানী হুজুরের এই মহতী কার্যক্রম সম্পর্কে জানার পর একটা ভালো জায়গায় হুজুরকে বাসাটা ঠিক করে দিই। সেই সঙ্গে মায়েদের চিকিৎসা কাজে নিজেদের অবস্থান থেকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি।’
মাওলানা গোলামুর রহমান রাব্বানীর গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার, বাঁশখালী উপজেলার, ছনুয়ার বলিরবাজারে। ব্যক্তিগত জীবনে নিসন্তান এই মানুষটি নিজের দায়িত্ববোধ আর মানবিক মূল্যবোধ থেকেই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, যাদের খবর কেউ নেয় না সমাজে। তাদের সেবায় কেটে যাচ্ছে তার দিন, রাত, মাস, বছর। আর্থিক সীমাবদ্ধতা তার ঔদার্য আর মানবসেবার পথে বাধা হতে পারেনি বিন্দুমাত্র।