মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে গুরুত্ব

২০ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় এ সংলাপে ওয়াশিংটনের গুরুত্ব প্রতিরক্ষা চুক্তি ও আইপিএস। ঢাকার গুরুত্ব রাজনৈতিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম অংশীদারত্ব সংলাপ। এবারের আলোচনায় রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদার এবং র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে অগ্রাধিকার থাকবে বাংলাদেশের। অন্যদিকে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি এবং ভারত মহাসাগরীয় কৌশলের (আইপিএস) বিষয়ে জানা–বোঝার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেবে যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রে সংলাপের অগ্রাধিকার বিষয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।

করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে দুই বছর বিরতির পর এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০ মার্চ অনুষ্ঠেয় এ সংলাপে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং রাজনীতিবিষয়ক মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড নিজ নিজ দেশের নেতৃত্ব দেবেন।

দুই দেশের অংশীদারত্ব সংলাপ নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার মার্কিন দূতাবাস আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে বলা হয়, এ বছর দুই দেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদ্‌যাপন করতে যাচ্ছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বহুমাত্রিক এই সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র আরও নিবিড় করতে চায়।

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, এবারের সংলাপে রাজনৈতিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা, বিনিয়োগসহ সামগ্রিকভাবে দুই দেশের কৌশলগত সহযোগিতার নানা বিষয়ে আলোচনা হবে।

রাজনৈতিক সম্পর্কে গুরুত্ব

২০ মার্চ অংশীদারত্ব সংলাপের পর নানা পর্যায়ের আরও চারটি আলোচনা দুই দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে গত দুই বছর এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। দুই পক্ষের কর্মকর্তারা আশা করছেন, এসব বৈঠকের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক আরও জোরদারের পথ প্রশস্ত হবে।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘এ বছর দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর। এ বিষয় মাথায় রেখে আমরা সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছি। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের সফর বিনিময় এবং আলোচনায় গুরুত্বের বিষয়টি তাদের জানিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রও এ বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী।’

২০ মার্চে ঢাকায় অংশীদারত্ব সংলাপের পর ৪ এপ্রিল ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। ৬ এপ্রিল ওয়াশিংটনে দুই দেশের নিরাপত্তা সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। ১১ মে ঢাকায় দুই দেশের ব্যবসায়ী পরিষদের সভা এবং ১৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইতে অনুষ্ঠিত হবে প্রতিরক্ষা সংলাপ।

সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘদিন ধরে দুই দেশের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের কোনো সফর হয়নি। ২০ মার্চের অংশীদারত্ব সংলাপে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এটি জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হবে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেবে ঢাকা।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি তুলবে বলে ধারণা করা যায়। বাংলাদেশ সব সময় এ ধরনের পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সনদ অনুসরণ করে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসী। এই সংকটের নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবনা কী, সেটাও বাংলাদেশ বোঝার চেষ্টা করবে।

অর্থনৈতিক সহযোগিতা

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগে জোর দিচ্ছে ঢাকা। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে দেশটির বিনিয়োগের বড় অংশটি জ্বালানি খাতে। বিনিয়োগকে বহুমাত্রিক করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে বিশেষভাবে আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে তুলা রপ্তানি করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়ে আসছে। অংশীদারত্ব সংলাপে এ বিষয়গুলো গুরুত্ব পেতে পারে।

ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২০ সালে ভার্চ্যুয়ালি দুই দেশের ব্যবসায়ী পরিষদের সভা হয়েছিল। এবার মে মাসে অনুষ্ঠেয় আলোচনায় বিনিয়োগের বিষয়ে অগ্রগতি হতে পারে।

মানবাধিকার পরিস্থিতি

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বরে মার্কিন রাজস্ব বিভাগ ও পররাষ্ট্র দপ্তর র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় এবার মানবাধিকারের বিষয়টি অংশীদারত্ব সংলাপে বিশেষ গুরুত্ব পাবে।

পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি প্রত্যাহারের লক্ষ্যে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে একটি আইনি পরামর্শক সংস্থা নিয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

জানা গেছে, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময় বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, শ্রম অধিকার পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় আসবে। এসব বিষয় বাংলাদেশ ইতিমধ্যে নিজের অবস্থান জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশের কাছে তুলে ধরেছে। এবারের আলোচনায় প্রসঙ্গটি এলে বাংলাদেশের অবস্থান জানানো হবে যুক্তরাষ্ট্রকে।

নিরাপত্তা সহযোগিতা

কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে উন্নত প্রযুক্তির সমরাস্ত্র কেনাকাটার লক্ষ্যে দুটি প্রতিরক্ষা চুক্তি সই নিয়ে বাংলাদেশ আলোচনা করছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে জিসোমিয়া (জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট) এবং অন্য হচ্ছে আকসা (অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট)।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, অংশীদারত্ব সংলাপে দুই প্রতিরক্ষা চুক্তির পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা ও ভারত মহাসাগরীয় কৌশল (আইপিএস) নিয়ে আলোচনা হবে।

প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে দুই দেশের সংলাপে আলোচনা হবে কি না, জানতে চাইলে মার্কিন দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিরাপত্তা সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যাপক পরিসরে আলোচনা হবে। তবে সংলাপের আগে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না। আর অবাধ ও মুক্ত ভারত মহাসাগরীয় কৌশলের প্রেক্ষাপটে সংলাপে আইপিএস নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুলে ধরা হবে। তেমনি এ নিয়ে বাংলাদেশের ভাবনা কী, সেটাও যুক্তরাষ্ট্র জানতে চাইবে।’

এবার পৃথক বিবৃতি

প্রতিবার অংশীদারত্ব সংলাপের পর যৌথ বিবৃতি প্রচার করা হলেও এবার তা হচ্ছে না। দুই দেশ আলাদা বিবৃতি প্রচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এ বিষয়ে দুই দেশের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের কিছু অগ্রাধিকার, প্রস্তাব এবং অভিমত সংলাপে তুলবে। দুই পক্ষই যেসব বিষয়ে একমত হবে, এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। তাই দুই দেশই চাইছে যে বিষয়গুলোতে একমত হওয়া যায়নি, সেগুলো যেন তাদের আলাদা বিবৃতির মাধ্যমে জনসমক্ষে আসে।

টানাপোড়েনের পরও বিস্তৃত সম্পর্ক

গত এক দশকের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের দিকে তাকালে দেখা যায়, গ্রামীণ ব্যাংক এবং ড. ইউনূসকে ঘিরে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছিল। একপর্যায়ে তা তিক্ততায় রূপ নেয়। ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে অসৌজন্যমূলক ও কঠোর মন্তব্যের ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিনিধিরা যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। এরপরও ব্যবসা, বিনিয়োগ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রমের পাশাপাশি নিরাপত্তা সহযোগিতা তখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি হয়েছে।

আবার রোহিঙ্গা সমস্যার মতো গুরুতর সংকটের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আর সহযোগিতা অটুট আছে। করোনা মহামারি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতাও বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে ছয় কোটির বেশি করোনার টিকা উপহার দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভার্ন্যান্সের ফেলো অধ্যাপক মো. শহীদুল হক বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা বহুমাত্রিক। এই সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারত্বকে বিবেচনায় নিয়ে খোলামনে ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করতে হবে। বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে গুরুত্ব দিচ্ছে, এর তাৎপর্য আমাদের অনুধাবন করতে হবে।’

এ জাতীয় আরো সংবাদ

নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখুন: পীর সাহেব চরমোনাই

নূর নিউজ

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সফল ও ফলপ্রসূ: তথ্যমন্ত্রী

নূর নিউজ

দ্বিতীয় ডোজ টিকা পেলেন সোয়া ৩ কোটি মানুষ

নূর নিউজ