উচ্চ আদালতের দেওয়া জামিন আদেশে শিগগিরই কারামুক্ত হচ্ছেন হেফাজত নেতা মুফতি হারুন ইজাহার, শিশুবক্তা হিসেবে পরিচিত রফিকুল ইসলাম মাদানী ও আলোচিত হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হক।
মুফতি হারুন ইজাহার ইতোমধ্যে সবগুলো মামলায় জামিন পেয়েছেন। রফিকুল ইসলাম মাদানী হাইকোর্টে সব মামলায় জামিন পেলেও চেম্বার আদালত একটি মামলায় জামিন স্থগিত করে আপিল বিভাগে শুনানির জন্য পাঠিয়েছেন। অন্যদিকে, মাওলানা মামুনুল হক এক মামলায় জামিন পেয়েছেন। সাত মামলার জামিন শুনানি শেষ হয়েছে। এখন শুধু আদেশের জন্য অপেক্ষা।
মুফতি হারুন ইজাহার, রফিকুল ইসলাম মাদানী ও মাওলানা মামুনুল হক খুব শিগগিরই জামিনে মুক্ত হবেন— এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন তাদের আইনজীবীরা।
এদিকে, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘কারাবন্দি হেফাজত নেতাদের মুক্তির জন্য সুপারিশ করা হচ্ছে। তারা যে তালিকা দিয়েছে সে অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে তাদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। সেই তালিকার অধিকাংশ নেতাকে ইতোমধ্যে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।’ মন্ত্রীর এমন বক্তব্যেও পরিষ্কার যে শিগগিরই তারা কারামুক্ত হচ্ছেন।
মুফতি হারুন ইজাহার
মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ের করা মামলা এবং চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে দায়ের করা সব মামলায় মুফতি হারুন ইজাহার হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন।
গত ৩১ জানুয়ারি বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ পাসপোর্ট জমা রাখার শর্তে তাকে জামিন দেন।
হারুন ইজাহারের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারওয়ার হোসেন বলেন, মুফতি হারুন ইজাহারকে সবগুলো মামলায় হাইকোর্ট জামিন দিয়েছেন। আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতও তার জামিন বহাল রেখেছেন। জামিনের শর্ত ছিল পাসপোর্ট জমা রাখতে হবে। কিন্তু হারুন ইজাহারের কোনো পাসপোর্ট নেই। হাটহাজারী থানা পুলিশের তদন্তেও তার পাসপোর্ট না থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে।
বিষয়টি নিয়ে ঈদের পরে উচ্চ আদালত খুললে আমরা জামিন আদেশ সংশোধনের জন্য আবেদন দাখিল করব। সংশোধিত আদেশ পেলে মুফতি হারুন ইজাহার কারামুক্তি পাবেন বলে আশা করছি— বলেন তার আইনজীবী।
২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মুফতি হারুন ইজাহারকে গত বছরের ৩ জানুয়ারি জামিন দেন হাইকোর্ট। পরে ওই জামিন আদেশ স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের শুনানি নিয়ে জামিন স্থগিত করেন চেম্বার আদালত। সেই থেকে জামিন স্থগিত ছিল।
গত বছরের ২৫ জানুয়ারি চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সহিংসতার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মুফতি হারুন ইজাহারকে এক বছরের জামিন দেন হাইকোর্ট। ২০২১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সহিংসতার ঘটনার দায়ের করা মামলায় হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক মুফতি হারুন ইজাহারকে কারাগারে পাঠানো হয়। চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আনজুমান আরার আদালত এ আদেশ দেন।
ওই বছরের ২৮ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রাম নগরীর লালখানবাজার জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসায় অভিযান চালিয়ে মুফতি হারুন ইজাহারকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৭।
গ্রেফতারের পর ওই বছরের ২৬ ও ২৭ মার্চ হাটহাজারীজুড়ে হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনায় দায়ের করা তিন মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে পুলিশ। মুফতি হারুন ইজাহার ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের চেয়ারম্যান মুফতি ইজাহারুল ইসলামের ছেলে।
শিশুবক্তা রফিকুল ইসলাম মাদানী
গত ২৯ মার্চ ভবিষ্যতে কোনো ওয়াজ মাহফিলে রাষ্ট্রবিরোধী ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেবেন না— এমন শর্তে ঢাকা ও গাজীপুরের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চার মামলায় রফিকুল ইসলাম মাদানীকে জামিন দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
পরে ওই আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ২ এপ্রিল গাজীপুরের গাছা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় শিশুবক্তা হিসেবে পরিচিত রফিকুল ইসলাম মাদানীর জামিন স্থগিত করেন চেম্বার আদালত। একই সঙ্গে মামলার শুনানির জন্য আপিল বিভাগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঈদের ছুটি শেষ হয়েছে। এখন যেকোনো দিন আপিল বিভাগে এ বিষয়ে শুনানি হবে।
মাদানীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট আশরাফ আলী মোল্লা বলেন, রফিকুল ইসলাম মাদানী সবগুলো মামলায় জামিন পেয়েছেন। শুধু গাজীপুরের গাছা থানার মামলায় তার জামিন স্থগিত করেছেন চেম্বার আদালত। ঈদের পর আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে তার জামিন বিষয়ে শুনানি হবে। এ মামলায় জামিন পেলেই তিনি কারামুক্ত হবেন।
রাষ্ট্রবিরোধী, উসকানিমূলক, ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে ২০২১ সালের ৭ এপ্রিল রাত সাড়ে ৩টার দিকে রফিকুলকে নেত্রকোনার নিজ বাড়ি থেকে আটক করে র্যাব। ওই সময় তার কাছ থেকে চারটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। ওই বছরের ৮ এপ্রিল ‘শিশুবক্তা’ হিসেবে পরিচিত রফিকুল ইসলাম মাদানীর নামে গাজীপুরের গাছা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হয়। র্যাবের নায়েক সুবেদার আবদুল খালেক বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এরপর গাজীপুরের বাসন এবং রাজধানীর মতিঝিল ও তেজগাঁও থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়।
হেফাজত নেতা মামুনুল হক
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নেতা মাওলানা মামুনুল হক ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ও সহিংসতার পর বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় আসেন। এর মধ্যে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরেরও বিরোধিতা করেন তিনি। এ নিয়ে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররমে সংঘর্ষের জেরে চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সহিংসতায় অন্তত ১৭ জনের মৃত্যু হয়।
দুদকের জালে হেফাজতের যেসব নেতা
এসব ঘটনায় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে মামুনুল হকের বিরুদ্ধে তিন ডজন মামলা হয়। একই বছরের ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার একটি রিসোর্টে এক নারীসহ ঘেরাও হন মামুনুল হক। একপর্যায়ে রিসোর্টে হামলা চালিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নেন হেফাজতের কর্মীরা। ১৮ এপ্রিল মোহাম্মদপুরের একটি মাদ্রাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রয়েল রিসোর্টকাণ্ডের ২৭ দিন পর ৩০ এপ্রিল সোনারগাঁ থানায় হাজির হয়ে কথিত স্ত্রী মামুনুল হকের বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতোমধ্যে মামুনুল হক হাইকোর্ট থেকে একাধিক মামলায় জামিন পেয়েছেন। ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায়ও তিনি জামিন আবেদন করেছেন। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা আরও সাত মামলায় জামিন শুনানি শেষ হয়েছে।
এ বিষয়ে মামুনুল হকের আইনজীবী হেলাল উদ্দিন মোল্লা বলেন, সম্প্রতি বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চে মামুনুল হকের বিরুদ্ধে দায়ের করা সাত মামলার জামিন শুনানি শেষ হয়েছে। ঈদের পর কোর্ট খুললে আদালত জামিন বিষয়ে আদেশ দেবেন। আমরা শুনানিতে তাকে জামিন দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছি। জামিন দেওয়ার বিষয়ে আদালতের মনোভাবও ইতিবাচক মনে হয়েছে। আশা করছি ঈদের পর মামুনুল হক জামিন পাবেন।
এদিকে, গত ১৩ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘কারাবন্দি হেফাজত নেতাদের মুক্তির জন্য সুপারিশ করা হচ্ছে। তারা যে তালিকা দিয়েছে সে অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে তাদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে।’ চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা পরিদর্শনকালে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানে আরও বলেন, ‘হেফাজতের পক্ষ থেকে আমাদের কারাবন্দি নেতাদের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। সেই তালিকার অধিকাংশ নেতাকে ইতোমধ্যে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।’
সুত্র: ঢাকা পোস্ট