মুফতি তানজিল আমির:
দেখতে দেখতে রমজানের ২০টি দিন পেরিয়ে গেল। শুরু হয়ে গেল নাজাতের দশক। শেষ হতে যাচ্ছে রমজানুল মোবারক। এই ১০ দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ সময়টুকু আমাদের হিসাব করে কাটাতে হবে।
হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, আউয়ালুহু রাহমাতুন-প্রথম দশক রহমতের। আওসাতুহু মাগফিরাতুন-মাঝের দশক ক্ষমার। ওয়া আখিরুহু ইতকুম মিনান্নারি-শেষের দশক দোজখের আগুন থেকে মুক্তির। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলভী (রহ.) বলেন, মানুষ তিন ধরনের হয়। সেজন্য আল্লাহতায়ালা মাহে রমজানকেও তিন ভাগে ভাগ করে পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছেন।
এক ধরনের মানুষ হলো গুনাহ থেকে মাসুম বা পাপমুক্ত, তারা হলেন নবি-রাসুল আলাইহিস সালাম। গুনাহ থেকে মাহফুজ বা নিরাপদ মানুষ হলেন সিদ্দিক শোহাদা সালেহিন। এদের ওপর রমজানের শুরু থেকেই রহমত বর্ষিত হয়।
আরেক ধরনের মানুষ, যারা আমলে সালেহ করে আবার নফসের তাড়নায় ছোটখাটো গুনাহে জড়িয়ে পড়ে। তারা ১০ দিন সিয়াম পালনের পর রমজানের ওসিলায় ক্ষমা পেয়ে যায়। তৃতীয় ধরনের মানুষ, যারা গুনাহের সাগরে ডুবে আছে। তারা ২০ দিন সিয়াম পালন করে প্রভুর কাছে কান্নাকাটি করার ফলে মাফ পেয়ে যায়।
করোনার কারণে এবারের রমজান একটু ব্যতিক্রমভাবে কাটাতে হচ্ছে। তবুও যেই অপূর্ণতা এবং আমলের ঘাটতি এতদিনে আমাদের হয়ে গেছে, তা এখন পুষিয়ে নেওয়া দরকার। গাফিলতি ঝেড়ে ফেলে এখনই আল্লাহমুখী হওয়া জরুরি। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, নবিজি (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইবাদতের জন্য লুঙ্গি শক্ত করে বেঁধে নিতেন। ইবাদতের জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। সারা রাত জেগে ইবাদত করতেন। পরিবারের সবাইকে জাগিয়ে দিতেন। পরিবারের সবাই যেন ইবাদতে রাত কাটায় সেদিকে লক্ষ রাখতেন।
রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর যে কোনো এক রাতে রয়েছে কদর। কদর এমন এক রাত, যা হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। হাজার মাসে হয় ৮৩ বছর চার মাস। সায়েম যদি ইবাদত-বন্দেগি জিকির-আসগারের মধ্যে এ রাত পেয়ে থাকে তা তার জন্য অনেক বড় পুরস্কার।
রমজানের শেষ সময়ে আল্লাহর প্রেমসাগরে কীভাবে ডুব দিতে হয়, রাসুল (সা.) তা আমাদের শিখিয়েছেন ইতেকাফের মাধ্যমে। পারিভাষিক অর্থে ইতেকাফ হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নিয়তের সঙ্গে মসজিদে অবস্থান করা। ইমাম যুহরি (রহ.) বলেন, রাসুল (সা.) এমন অনেক আমল করতেন যেগুলো তিনি মাঝেমধ্যে ছেড়েও দিতেন। কিন্তু মদিনায় আসার পর থেকে ওফাত পর্যন্ত একবারের জন্যও ইতেকাফ ছাড়েননি।
১০ দিনের সুন্নত ইতেকাফ যদি সম্ভব না হয়, সুযোগ রয়েছে মুস্তাহাব ইতেকাফের। শুধু নিয়ত করে যতটুকু সময় মসজিদে থাকব, তা-ই পরিণত হবে মুস্তাহাব ইতেকাফে। ইতেকাফ একজন মানুষের ভেতর জগৎকে পালটে দিয়ে তাকে নুরানি মানুষে পরিণত করে। মুমিনের ইতেকাফ রমজানে সীমাবদ্ধ নয়। জীবনভর ইতেকাফের প্রশিক্ষণ নিতে হয় রমজানে। পরিমিত কথা, পরিমিত খাদ্যগ্রহণ, পরিমিত জীবনযাপন-সবকিছু যেন মুমিনের স্বভাবে পরিণত হয়, তার চূড়ান্ত প্রশিক্ষণ চলে রমজানে।
এ প্রশিক্ষণে মানবাত্মা হয়ে ওঠে খোদার প্রিয়। তখন মুমিনের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে প্রতিধ্বনিত হয়: নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ, সবই আল্লাহর জন্য। ইবনুল কাইয়্যুম (রহ.) বলেন, ইতেকাফের প্রাণ হলো আত্মাকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নেওয়া। ইতেকাফের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে গায়রুল্লাহর বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর সঙ্গে পরিপূর্ণ ও গভীর প্রেমময় সম্পর্ক স্থাপন করা।
আল্লাহর দুয়ার আজ থেকে প্রশস্ত, ক্ষমার জন্য উন্মুক্ত। আসুন দুনিয়াবি জুট-ঝামেলা ফেলে রেখে প্রভুর দুয়ারে বসে যাই। ইস্তেগফার, তাহাজ্জুদ, তাসবিহ, সদকাহ, তেলাওয়াত আর প্রার্থনায় আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে তুলি।
লেখক : তরুণ আলেম, ধর্মীয় গবেষক