গুলিস্থানস্থ ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে জামে মসজিদের খতীব আল্লামা মুহিউদ্দীন রাব্বানী জুমা পূর্বক বয়ানে বলেন, রমজান মাস। আরবি মাসসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বরকতময় ও মর্যাদাপূর্ণ মাস। বছরের বাকি এগার মাস অপেক্ষা অধিক মর্যাদাশীল ও বরকতপূর্ণ মাস। এ মাসের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য অপরিসীম। দুনিয়ার কোনো সম্পদের সঙ্গে আল্লাহর এ অনুগ্রহের তুলনা চলে না। রমজানের আগমনে বিশ্বনবি অনেক আনন্দিত হতেন। সাহাবাদের উদ্দেশ্যে এভাবে ঘোষণা দিতেন বিশ্বনবি সাল্লাল্রাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-أتاكم رمضان شهر مبارك‘তোমাদের দরজায় বরকতময় মাস রমজান এসেছে।’ তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের ঘোষণা দিয়ে এ মাসের বিশেষ ফজিলত বর্ণনা করতেন। আর তা ছিল এমন-হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা রাখা ফরজ (বাধ্যতামূলক) করা হয়েছে। যেভাবে তোমাদের আগের লোকদের (নবি-রাসুলের উম্মতের) ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)
এ মাসেই মানুষ ও জিন জাতির মুক্তির সনদ কুরআন মজীদ একত্রে লাওহে মাহফূয থেকে প্রথম আসমানে বাইতুল ইযযতে অবতীর্ণ হয় এবং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট সর্বপ্রথম এ মাসেই ওহী অবতীর্ণ হয়। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে- (তরজমা) ‘রমজান মাসই হল সে মাস যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়াত এবং সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ। (সূরা বাকারা ১৮৫)
এ মাসে রহমতের দরজা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। হাদীস শরীফে এসেছে- ‘রমজান মাস শুরু হলেই রহমতের দরজা খুলে দেওয়া হয়।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৭৯/২)
অন্য এক হাদীসে এ মাসের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে যে, ‘রমজান মাসের শুভাগমন উপলক্ষে জান্নাতের দরজাসমুহ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানকে শৃংখলাবদ্ধ করা হয়।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৮৯৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৭৯/১)
এ বৈশিষ্ট্যের অন্যতম ফলাফল হলো- রমজান মাসে মানুষ ধর্ম-কর্ম ও নেক আমলের দিকে বেশি তৎপর হয় এবং নতুন-পুরাতন সব মানুষকেই মসজিদমুখী হতে দেখা যায়।
এ মাস জাহান্নাম থেকে নাজাত লাভের মাস। সুতরাং বেশি বেশি ইবাদত ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে মুক্তির পরওয়ানা লাভ করার এটিই সুবর্ণ সুযোগ। হাদীস শরীফে এসেছে- ‘আল্লাহ তাআলা প্রত্যহ ইফতারের সময় অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন।’ (মুসনাদে আহমদ হাদীস ২১৬৯৮)
অন্য এক বর্ণনায় বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘রমযান মাসে যে ব্যক্তি একটি নফল আদায় করল সে যেন অন্য মাসে একটি ফযর আদায় করল। আর যে এ মাসে একটি ফরয আদায় করল সে যেন অন্য মাসে সত্তরটি ফরয আদায় করল। (শুআবুল ঈমান ৩/৩০৫-৩০৬)
অর্থাৎ এ মাসে নফল আদায় করলে অন্য মাসের ফরযের ন্যায় ছওয়াব হয়। আর এ মাসের এক ফরযে অন্য মাসের ৭০ ফরযের সমান ছওয়াব পাওয়া যায়।
এ তো হল রোযা ছাড়া এ মাসের অন্যান্য আমলের ছওয়াব। আর রোযার ছওয়াব সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা নিজেই ইরশাদ করেন- (তরজমা) ‘নিশ্চয় রোযা আমার জন্য, আর এর প্রতিদান স্বয়ং আমিই দিব।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫১/১৬৫)
প্রত্যেক নেক আমলের বিভিন্ন ফযীলত ও ছওয়াব রয়েছে যা দ্বারা মহান রাববুল আলামীন আমলকারীকে পুরস্কৃত করবেন, কিন্তু রোযার বিষয়টি একেবারেই স্বতন্ত্র। কারণ রোযার বহুবিধ প্রতিদান ছাড়াও এ বিষয়ে একটি অতুলনীয় ঘোষণা রয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন –
‘মানুষের প্রত্যেকটি আমলকে বৃদ্ধি করা হয়। একটি নেকী (সওয়াব) ১০ গুণ থেকে (ক্ষেত্র বিশেষে) ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন : কিন্তু রোযার ব্যাপারটি ভিন্ন। কারণ রোযা আমার জন্য। সুতরাং তার প্রতিদান আমি নিজেই প্রদান করব।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৮৯৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫১/১৬৪)
রোযা ছাড়া অন্যান্য সব আমলের ছওয়াব বৃদ্ধির ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। তা হল ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত। এটি সাধারণ নিয়ম। আল্লাহ তাআলা চাইলে বিশেষ ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশিও প্রদান করতে পারেন। তবে সাধারণত সব আমলের ছওয়াব এ নীতির মাধ্যমেই নির্ণিত হয়। কিন্তু রোযার বিষয়টি স্বতন্ত্র। কারণ এর ছওয়াবের নির্ধারিত কোনো সীমারেখা নেই; বরং আল্লাহ তাআলা নিজে এর ছওয়াব প্রদানের ঘোষণা প্রদান করেছেন। এর পরিমাণ যে কত হবে তা একমাত্র তিনিই জানেন।
আল্লাহর ভয় তথা তাকওয়া অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। এই মাসে ঈমানদারের তাকওয়া তথা আল্লাহ ভীতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। রমজান মাসের রোজা বান্দাকে শিক্ষা দেয় তাকওয়া। কারণ রমজান মাসের রোজা অল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে দেয়া অন্যান্য ইবাদাত থেকে ভিন্ন। এই মাস সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেই দিয়েছেন এটা তাকওয়া অর্জনের মাস।
আল্লাহ তা‘আলা রমজান মাস সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (সুরা বাকারা -১৮৩)
হাদীস শরীফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা বলা এবং মিথ্যা আচরণ থেকে বিরত হলো না, তার ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। ’
এ ছাড়াও রমজান মাসের অনেক ফজিলত ও মর্যাদা রয়েছে। যা মেনে চলা প্রত্যেম মুমিন মুসলমানের একান্ত করণীয়।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজানের ফজিলত ও বিশেষ বেশিষ্ট্যগুলো যথাযথভাবে পালনের তাওফিক দান করুন। রমজানের রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাত লাভে তাওফিক দান করুন। আমিন।