রোযাদারদের জন্য হাদিসে বর্ণিত ১৪ ফযিলত

মুফতী মুহাম্মদ ইসমাঈল 

ইসলামে ঈমান, নামায ও যাকাতের পরই রোযার স্থান। রোযার আরবি শব্দ সাওম, যার আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। পরিভাষায় সাওম বলা হয়- প্রত্যেক সজ্ঞান, বালেগ মুসলমান নর-নারীর সুবহে সাদিক থেকে সূর্যান্ত পর্যন্তÍ রোযার নিয়তে পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও রোযাভঙ্গকারী সকল কাজ থেকে বিরত থাকা। সুতরাং রমাদান মাসের চাঁদ উদিত হলেই প্রত্যেক সুস্থ, মুকীম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং হায়েয-নেফাসমুক্ত প্রাপ্তবয়স্কা নারীর উপর রমাদানের রোযা রাখা ফরয। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার। (সূরা বাকারা: ১৮৩)

অন্য আয়াতে ইরশাদ করেছেন-সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই রোযা রাখে। (সূরা বাকারা : ১৮৫)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- যখন তোমরা (রমাদানের) চাঁদ দেখবে, তখন থেকে রোযা রাখবে আর যখন (শাওয়ালের) চাঁদ দেখবে, তখন থেকে রোযা বন্ধ করবে। আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবে ত্রিশ দিন রোযা রাখবে। (সহিহ বুখারি)

রোযার ফযিলত ও বৈশিষ্ট্যসমূহ

১. রোযার প্রতিদান আল্লাহ তাআলা নিজেই দিবেন
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, বান্দা একমাত্র আমার জন্য তার পানাহার ও কামাচার বর্জন করে, রোযা আমার জন্যই, আমি নিজেই তার পুরস্কার দিব আর (অন্যান্য) নেক আমলের বিনিময় হচ্ছে তার দশগুণ। (সহিহ বুখারি)

২. রোযাদারকে কেয়ামতের দিন পানি পান করানো হবে
হযরত আবু মুসা (রা.) হতে বর্ণিত,আল্লাহ তাআলা নিজের উপর অবধারিত করে নিয়েছেন, যে ব্যক্তি তার সন্তুষ্টির জন্য গ্রীষ্মকালে (রোযার কারণে) পিপাসার্ত থেকেছে, তিনি তাকে তৃষ্ণার দিন (কিয়ামতের দিন) পানি পান করাবেন। -মুসনাদে বাযযার

৩. রোযা জান্নাত লাভের পথ
হযরত আবু উমামা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে আগমন করে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন, যার দ্বারা আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব। তিনি বলেন, তুমি রোযা রাখ, কেননা এর সমতুল্য কিছু নেই। আমি পুনরায় তার নিকট এসে একই কথা বললাম। তিনি বললেন, তুমি রোযা রাখ। (মুসনাদে আহমদ)

৪. রোযাদারগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে ‘রাইয়ান’ নামক বিশেষ দরজা দিয়ে
হযরত সাহল ইবনে সা’দ (রা.) হতে বর্ণিত, নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, জান্নাতে একটি দরজা আছে, যার নাম রাইয়ান। কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে কেবল রোযাদার ব্যক্তিরাই প্রবেশ করবে। অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা করা হবে- কোথায় সেই সৌভাগ্যবান রোযাদারগণ? তখন তারা উঠে দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। অতঃপর রোযাদারগণ যখন প্রবেশ করবে, তখন তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। ফলে কেউ ঐ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (সহিহ বুখারি)

৫. রোযা জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী ঢাল ও দুর্গ
হযরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমাদের মহান রব ইরশাদ করেছেন- রোযা হল ঢাল। বান্দা এর দ্বারা নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে। রোযা আমার জন্য আর আমিই এর পুরস্কার দিব। (মুসনাদে আহমদ)

৬. রোযা কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- রোযা ও কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে রব! আমি তাকে খাদ্য ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, অতঃপর তাদের উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। (মুসনাদে আহমদ)

৭. রোযাদারের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন-যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমাদান মাসের রোযা রাখবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (সহিহ বুখারি)

৮. রোযা গুনাহের কাফফারা
হযরত হুযায়ফা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, মানুষের জন্য তার পরিবার, ধন-সম্পদ, তার আত্মা, সন্তান-সন্ততি ও প্রতিবেশী ফিতনা স্বরূপ। তার কাফফারা হল নামায, রোযা, দান-সদকাহ, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ। (সহিহ বুখারি)

৯. রোযাদারের মুখের গন্ধ মিশকের চেয়েও সুগন্ধিযুক্ত
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, সেই সত্তার শপথ, যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধির চেয়েও অধিক সুগন্ধিময়। (সহিহ বুখারি)

১০. রোযাদারের জন্য দু’টি আনন্দের মুহূর্ত
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, রোযাদারের জন্য দুটি আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে, যখন সে আনন্দিত হবে। এক. যখন সে ইফতার করে তখন ইফতারের কারণে আনন্দ পায়। দুই. যখন সে তার রবের সাথে মিলিত হবে তখন তার রোযার কারণে আনন্দিত হবে। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, যখন সে আল্লাহর সাথে মিলিত হবে, আর তিনি তাকে পুরস্কার দিবেন, তখন সে আনন্দিত হবে। (সহিহ বুখারি)

১১. রোযাদার পরকালে সিদ্দীকীন ও শহীদগণের দলভুক্ত থাকবে
হযরত আমর ইবনে মুররা আলজুহানী (রা.) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর দরবারে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি একথার সাক্ষ্য দিই যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই এবং অবশ্যই আপনি আল্লাহর রাসূল, আর আমি যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করি, যাকাত প্রদান করি, রমাদান মাসের সিয়াম ও কিয়াম (তারাবিসহ অন্যান্য নফল) আদায় করি তাহলে আমি কাদের দলভুক্ত হব? তিনি বললেন, সিদ্দীকীন ও শহীদগণের দলভুক্ত হবে। (মুসনাদে বাযযার)

১২. রোযাদারের দুআ কবুল হয়
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- ইফতারের সময় রোযাদার যখন দুআ করে, তখন তার দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। (অর্থাৎ তার দুআ কবুল হয়) (সুনানে ইবনে মাজাহ)

১৩. রোযা হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে
হযরত ইবনে আববাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, সবরের মাসের (রমাদান মাস) রোযা এবং প্রতি মাসের তিন দিনের (আইয়্যামে বীয) রোযা অন্তরের হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে। (মুসনাদে বাযযার)

১৪. রোযা আল্লাহর নৈকট্য লাভের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম
হযরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে কোনো আমলের আদেশ করুন। তিনি বললেন, তুমি রোযা রাখ, কেননা এর সমতুল্য কিছু নেই। আমি পুনরায় বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে কোনো নেক আমলের কথা বলুন, তিনি বললেন, তুমি রোযা রাখ। কেননা, এর কোনো সমতুল্য কিছু নেই। (মুসনাদে আহমদ)

উপসংহার

রমাদান হল খালেস ইবাদতের মৌসুম। তাই এ মাসের সময়গুলো যতটা আল্লাহর ইবাদতে কাটানো যায় ততটাই ভালো। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে হাদীস অনুযায়ী আমল করার ও রমাদানের অফুরন্ত ফযিলত লাভ করার তাওফীক দান করেন। আমীন।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

অজু ছাড়া মোজা পরলে মাসেহ করা যাবে?

নূর নিউজ

সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াত পড়ার ফজিলত

নূর নিউজ

প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোরআন-হাদিসের নির্দেশনা

নূর নিউজ